ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

লকডাউন পরবর্তী লাইফস্টাইল যেমন হবে

নাঈমা জান্নাত | প্রকাশিত: ০৯:৩৭ এএম, ১২ মে ২০২০

প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ কতটা উত্তম, কোভিড-১৯ বা সার্স কভ-২ এর কারণে তা কমবেশি এখন সবারই জানা। এটা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি এবং ভবিষ্যতে হয়তো আরও টের পাব। আমরা বুঝে গেছি কিছুক্ষণ পরপর হাতধোয়া, পরিচ্ছন্নতা, সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব ইত্যাদির গুরুত্ব। ধরে নিচ্ছি, করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়াবহতা আমরা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছি। তাহলে সামাজিক দূরত্বের ভবিষ্যত কী হবে? দেশের বড় বড় মার্কেট খুলে যাবে; স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় খুলে যাবে; রাস্তাঘাটে আবার সেই জ্যাম; পুরোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি। কী করব আমরা তখন?

আবার কি সেই তিনজনে মিলে এক রিকশায় চড়ে ঢাকার মজা উপভোগ করব? আচ্ছা, কখনও কি ভেবে দেখেছি, অতিরিক্ত ১০ কেজি ভার নিয়ে পথ চলতে আমাদের কতটা কষ্ট হয়! সেখানে অল্প কিছু টাকা কীভাবে তিন-চারটি বিশাল দেহ টানার দাম হয়ে যায়, তার দুর্বলতা কখনও ভেবে দেখেছি কি? যা বলছিলাম, কোভিড পরিস্থিতির পর গাদাগাদি করে কনসার্ট দেখা, বাচ্চার স্কুলের সামনে হাত না ধুয়ে বা সামান্য ধুয়ে ভাবিদের সাথে ঝালমুড়ি খাওয়া; ক্যাম্পাসে, অফিসে বা রেস্টুরেন্টে গাদাগাদি করে আড্ডা দেয়া, অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, এসব কি থাকবে তখন?

আমরা যারা চাকরিজীবী, তারা ধরেই নিই নিজের হাতধোয়া থেকে শুরু করে পরিচ্ছন্নতা মেনে চলার সব উপকরণ প্রতিষ্ঠান দেবে। অবশ্যই দেবে, কিন্তু যে প্রতিষ্ঠান দিতে পারছে না, সেখানে কি আমি নিজ দায়িত্বে স্বাস্থ্যবিধি মানব না? ভাবুন, ভালো করে ভাবুন। লকডাউনে সবাই ভাবতে শিখি। অকারণে বাইরে ঘোরা, যখন তখন সাপ্তাহিক ছুটিতে বেড়াতে যাওয়া কখনও স্বাস্থ্যকর নয়। আবার অনেকে অতিরিক্ত সৃজনশীল কাজের চাপ দিয়ে শিশুকে বহির্মুখী করে তুলছেন। ২০ বছর পর আপনার ওপর সন্তানের এই অতিরিক্ত বহির্মুখী অভ্যস্ততার কী কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে এক মিনিট চিন্তা করুন? উত্তরটা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়। আপনার একই নেতিবাচক আচরণের ফলাফল বর্তমানেও প্রিয়জনদের কাউকে না কাউকে দুঃসহভাবে পোহাতে হচ্ছে।

এবার আসি সামাজিক দূরত্বের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে। ঈদে অতিরিক্ত কেনাকাটা, ভিড়ভাট্টা, হুমড়ি খেয়ে একজনের জন্য তিন-চারটি পোশাক কিনে প্রতিযোগিতার মাঠে নামা, এই সবই করেছি আমরা। এটা কি চলতেই থাকবে, নাকি থামিয়ে দেব? অনেকেই বলে থাকেন এতে পোশাকশিল্পে অবদান রাখা হয়। ঠিক আছে, তবে আপনি সারাবছর ধরেই কিনতে থাকুন। তাতে বরং এই খাতের শ্রমিকদের কর্মের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে। উৎসবের আগে অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে দিনরাত পরিশ্রম করলেও এর উপযুক্ত মূল্য কর্মীরা পায় না। তাই এখন থেকেই চিন্তা করতে পারেন বছরব্যাপী ভারসাম্যপূর্ণ কেনাকাটার। আপনার অতিরিক্ত খরচের টাকাটা আরও ভালো খাতে ব্যয় হতে পারে কি? বিশ্বের অনেক দেশে শুধু না খেতে পেয়ে প্রতিদিন কতশত মানুষ মরছে! তাই আবারও ভাবুন।

সৌন্দর্যবর্ধক পণ্যের ওপর চাপ কমিয়ে অন্য খাতে আমরা উৎপাদন বাড়াতে পারি। এ রকম অনেক কিছুই আছে যা আমরা নিতান্তই অপ্রয়োজনে করি। বর্তমান কঠিন পরিস্থিতি আমাদের কাছে সামাজিক দূরত্ব ও মানবিক নৈকট্যের সমন্বয় আহ্বান করছে। এই পরিস্থিতি আমার প্রকৃত সত্তাকে চিনতে সাহায্য করছে। সেই সাথে চিনছি আপনজনকেও। দুর্যোগকালেই আমরা প্রকৃত বাস্তবতাকে উপলব্ধি করি। দুর্যোগ পরবর্তীকালে এই আমি কি আবার দ্রুত বেগে ছুটতে শুরু করব? নাকি মহামারি থেকে রক্ষা পাওয়ার পর নতুন জীবনটাকে আরও সুন্দর ও ভারসাম্যপূর্ণ করে গড়ে তুলব?

মনে রাখতে হবে, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন আমাদের ওষুধশিল্প আর স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করে। সেই সাথে আপনার অসচেতন জীবনযাপনের কারণে দৌরাত্ম বাড়ে এক শ্রেণির অসাধু লোকের। তাই সুন্দর জীবন আপনার, পছন্দ আপনার, সিদ্ধান্তটাও আপনার। অন্যের কষ্টের কারণ না হওয়ার দায়িত্বও আপনার।

করোনাভাইরাস এই দুনিয়ারই একটি অনুসঙ্গ। এটা আগেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। এমন অসংখ্য ভাইরাসের অস্তিত্ব রয়েছে এই মহাবিশ্বে। এসব ভাইরাস মোকাবিলা করেই টিকে থাকতে হবে মানুষকে। তাই লকডাউন পরবর্তী সামাজিক ও ব্যক্তিগত দূরত্ব কেমন হবে, মানুষের পরিবর্তিত জীবনাচরণ কী হবে, তা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। এর ব্যক্তিগত, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কার্যকর নীতিমালা থাকতে হবে। যাতে হাতধোয়া থেকে শুরু করে করমর্দন ও থুথু ফেলা পর্যন্ত সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এতে করে আশা করা যায় পরবর্তীতে একটি সুবোধ প্রজন্মের আবির্ভাব হবে। যাদের দৈনন্দিন জীবনের উদ্দেশ্যই হবে অতিরিক্ত ও অবাঞ্ছিত সবকিছুকে ত্যাগ করে কেবল উন্নত, ভারসাম্যপূর্ণ ও কল্যাণকর জীবনাচরণ গ্রহণ করা।

আপাতত কঠোরভাবে লকডাউনের নিয়মনীতি মেনে চলুন। শরীর সুস্থ রাখতে কিছু নিয়মকানুন চর্চা করুন। ঘরে থাকাকালে শরীরে যাতে অবসাদ না আসে, তাই বড়দের ৩০ মিনিট এবং ছোটদের প্রতিদিন এক ঘণ্টা শরীরচর্চার পরামর্শ দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বাসার সিঁড়িতে ওঠানামা করেও শরীরচর্চা করা যেতে পারে। শিশুদের যত্নে বাবা-মা হিসেবে আপনারা যা করবেন- তাদের দৈনন্দিন কাজের একটি সময়সূচি তৈরি করবেন, যাতে সকালে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে আবারও বিছানায় যাওয়া পর্যন্ত সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত হবে।

একটু বড় শিশুদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশের জন্য গাণিতিক সমাধান, বিভিন্ন ভাষার ছোট ছোট শব্দ শেখানো এবং শিশুর যে বিষয়ে ঘাটতি আছে বলে মনে হয়, ঘরে থাকাকালে সেই সব বিষয় বেশি বেশি চর্চা করুন। ঘরের কাজে শিশুদের সাথে নিন। বয়স অনুযায়ী ছোট ছোট ঘরের কাজে তাদের অভ্যস্ত করুন। শিশুর পছন্দের খাবারগুলো খেতে দিন। প্রত্যেক নেতিবাচক ঘটনা কিছু ইতিবাচক দিক নিয়ে আবির্ভূত হয়। তাই এমন কিছু করুন, যাতে আপনার সন্তান খুশিতে থাকে।

মাঝে মাঝে বড়রা সবাই মিলে শিশুর সাথে সৃজনশীল কাজের চর্চা করুন। কেন আমরা ঘরে থাকছি, তা নিয়ে শিশুর সাথে খোলাখুলি কথা বলুন। বড়রা বাজারে বা সুপারশপে গেলে অবশ্যই অন্যদের সাথে শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। আপনি যদি হোম অফিসে থাকেন, তবে একই স্থানে দীর্ঘক্ষণ একভাবে বসে থাকবেন না। ৩০ মিনিট পরপর তিন মিনিটের জন্য উঠুন, এরপর আবার কাজে মন দিন।

মানসিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে আপনার বিশ্বস্ত মানুষের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলুন। তিনি আপনার পরিবারের বাইরের হলে ফোনেই বলুন। কথা বলার সময় প্রয়োজনে হেডফোন ব্যবহার করুন। দৈনন্দিন রুটিন অনুযায়ী পরিবারের সাথে নিয়মমাফিক সময় কাটান। দিনে দুইবারের বেশি করোনা সম্পর্কিত খবর দেখবেন না। নিয়মিত রিলাক্সেশন বা শিথিলায়ন করুন। বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক পোর্টালে রিলাক্সেশনের নিয়ম-কানুন খুঁজে পাবেন।

চলমান এই দুর্যোগ আপনাকে, আমাকে ও সবাইকে আহ্বান করছে অন্যের প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়াতে। প্রাকৃতিকভাবেই আমরা কেউ কেউ হয়তো সহমর্মী। তবুও প্রতিদিন অন্তত একটি করে সহমর্মিতার স্বাক্ষর রাখি। লকডাউন শেষ হলেও এই স্বাস্থ্যবিধিগুলো চর্চায় রাখি। সুরক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্যরোগ প্রতিরোধে আপনার সক্ষমতা বাড়াবে।

লেখক : ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, টাইগার আইটি বাংলাদেশ লিমিটেড।

এইচআর/বিএ/জেআইএম