ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

কর্মজীবী মায়েদের করোনাকাল

তামান্না ইসলাম | প্রকাশিত: ০৯:০৬ এএম, ০৯ মে ২০২০

আমরা যারা চাকরি করি, আমাদের অনেকেরই স্বপ্ন যদি বাসা থেকে কাজ করতে পারতাম। বিশেষ করে যাদের বাচ্চা ছোট তাদের কাছে এটা একটা অত্যন্ত দুর্লভ স্বপ্ন। ছোট বাচ্চারা ঘন ঘন অসুস্থ হয় এবং বাচ্চার অসুস্থতায় সাধারণত মায়েরাই ছুটি নেয় বেশি দেখাশোনা করার জন্য। এটা একটা বড় কারণ যে কর্মজীবী মায়েরা বাসা থেকে কাজ করাকে সুবিধাজনক মনে করে। আবার যাদের বাচ্চা একটু বড়, মায়েরা ভাবেন স্কুল থেকে বাচ্চা ফিরলে চোখের সামনেই থাকল, কে দেখাশোনা করবে এসব দুশ্চিন্তা নেই। বাচ্চার খাবারটা নিজের হাতে করে দেয়া গেল। টিভি বা স্ক্রিনে সময় কাটাচ্ছে নাকি পড়ালেখা করছে সবকিছুই খেয়াল করা গেল।

কিন্তু শুনতে যতটা সহজ মনে হচ্ছে ব্যাপারটা আসলে ততটা সহজ না। আমার প্রবাসের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জানি এরা পুরোপুরি খাটিয়ে বেতন উসুল করে নেয় কড়ায়গণ্ডায়। তাই অসুস্থ বাচ্চাকে সেবা করতে গিয়ে বা বাচ্চার নাস্তা, খাওয়া, পড়ালেখা দেখতে গিয়ে কাজের ক্ষতি হয় প্রচুর। বাসা থেকে কাজ করতে হলে হয় কাজের নির্দিষ্ট সময় থাকতে হয় অথবা বেশিরভাগ মা-ই গভীর রাত অবধি কাজ করে সেটা পুষিয়ে দেয়।

করোনার শুরুতে যখন এই বাসা থেকে কাজের নতুন প্রচলন শুরু হলো আমি তখন মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখেছি কর্মজীবী নারীদের মাঝে। প্রথমে ব্যাপারটা সুখকর মনে হলেও, কিছুদিনের মধ্যেই বেশিরভাগ নারীই বুঝতে পারেন যে এই নতুন ব্যবস্থায় তাদের ওপর চাপ অনেক বেড়ে গেছে। প্রথমত বাসা থেকে অফিস করার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। অনেক কাজের ক্ষেত্রেই বাসা থেকে সমান পরিমাণ উৎপাদনশীলতা বজায় রাখতে হলে অনেক নতুন নতুন পদ্ধতি খাটাতে হচ্ছে, ক্ষেত্র বিশেষে সময় বেশি দিতে হচ্ছে।

অনেকেরই মিটিং আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়ে গেছে। মিটিং বেড়ে যাওয়ার কারণে নিজের কাজ করার সময় কম পাওয়া যাচ্ছে। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু তার চেয়েও বড় যে চ্যালেঞ্জ সেটা হলো- একজন কর্মজীবী নারীকে বাসায় একজন স্ত্রী বা মা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে কেউ রাজি না। তাদের বাসায় দেখলেই স্বামী, সন্তান সবার মনে হয় তাদের ব্যক্তিগত সব চাহিদা মেটানো এবং সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করাই তাদের প্রধান এবং একমাত্র কাজ। একই সাথে একই সময়ে যখন একটা জরুরি মিটিং বা ডেডলাইন থাকে আর সন্তানের দুপুরের খাওয়ার চিন্তাও করতে হয় বা আয়োজনও করতে হয় তখন সেটা কঠিন হয়ে যায়।

চাকরির কারণে যেসব মা বাইরে যান তারা হয়তো আগেই রাতে বা সকালে বাচ্চাদের জন্য কোনো ঝটপট খাওয়া তৈরি করে রাখেন। কিন্তু মা বাসা থেকে কাজ করার কারণে বাচ্চাদের আবদার বাড়ে, তারা নিত্যনতুন গরম গরম খাওয়া চায়, সেই সাথে অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের অন্য সদস্যরাও। আমি একজন উচ্চপদস্থ গবেষকের কাছে শুনেছি, তিনি প্রথমে কাজের জায়গা ঠিক করেছিলেন রান্নাঘরের খাওয়ার টেবিলে। সপ্তাহ যেতেই টের পেলেন যে দুই মিনিট পরপর বাচ্চারা এসে তার কাছে স্ন্যাক চাইছে। দুপুরে খাওয়ার আয়োজন করতে তার দেড় দুই ঘণ্টা চলে যাচ্ছে। এভাবে কাজ করা অত্যন্ত কঠিন। তাই তিনি বাধ্য হয়ে কাজের জায়গা পরিবর্তন করেন।

সেদিন আরেকজন ম্যনেজারের কাছে শুনলাম সেও ভেবেছিল রান্নাঘরে কাজ করলে সুবিধা হবে, বাচ্চারা কিছু চাইলে সাথে সাথে দেয়া যাবে। তার জরুরি মিটিং চলাকালে যখন তাকে কিছুটা কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে, তখন পাশে এসে বাচ্চারা আবদার, শোরগোল করে সমস্যা তৈরি করে। এটা কিন্তু শুধু বাচ্চারা না। পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যই। বাচ্চাদেরও কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত রাখতে হবে। অনেকের পড়ালেখায়ও সাহায্য লাগছে। এই সবকিছুর চিন্তা থাকে একা মায়ের মাথায়। আর কারোরই নয়।

সবাই যে বাসা থেকে কাজ করতে পারছেন তাও না। ডাক্তার, নার্স বা কিছু কিছু অবশ্যম্ভাবী পেশার মায়েদের কাজে যেতে হচ্ছে। বাচ্চার স্কুল বন্ধ। অর্থাৎ দিনের পর দিন বাচ্চাকে বাবার কাছে রেখে কাজে যেতে হচ্ছে। খুব কম বাবাই আছেন যারা এ ব্যাপারে মায়েদের মতো সহনশীল এবং সক্রিয়। বাচ্চা হয়তো সারাদিন টিভি দেখে, গেম খেলেই কাটিয়ে দিল, বাবার খবর নাই।

অফিসের নতুন ব্যবস্থায় কাজ এবং সংসারের বাড়তি চাপ, সন্তানদের এবং পরিবারের বাকি সদস্যদের সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী জীবন ব্যবস্থায় সচল রাখতে গিয়ে নারীরা হিমশিম খাচ্ছেন অনেকেই। নিজেদের দিকে তাকানোর কোনো সময় নাই। আগে অন্তত অফিসে যাওয়ার কারণে একটা ভালো কাপড় পরা হতো, চুলটা আঁচড়ানো হতো, একটু ফ্রেশ হওয়ার সুযোগ ছিল। দুইটা বাইরের মানুষের সাথে কথা হতো। সংসারের বাইরেও কিছু ভাবার অবকাশ ছিল। আমি যে একজন মানুষ, আমার একটা জীবন আছে সেটা অনুভব করার সুযোগ ছিল।

এখন দায়িত্বের বোঝায় পিষ্ট হতে হতে দিনরাত আমি কে সেটা ভুলতে বসেছে অনেক চাকরিজীবী নারীই। তারপরও কিছু কিছু মাকে বলতে শুনি বাচ্চাকে অনেক বেশি সময় দিতে পারছে বলে তারা আনন্দিত। আশা করি এই আনন্দটা যেন বাবারাও পেতে চায়। যেন কর্মজীবী মা বা স্ত্রীর প্রতি পরিবারের সকল সদস্য সহানুভূতিশীল হন। এই দুর্যোগকালে তারা আসলেই একসাথে দ্বিগুণ চাকরি করছে।

লেখক : ক্যালিফোর্নিয়া প্রবাসী।

এইচআর/বিএ/এমএস