ঘুরে দাঁড়াতে হবে, তবে...
সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর খোকন মারা গেছেন। করোনায় দেশের প্রথম কোনো সাংবাদিকের মৃত্যু হলো। এই লেখা পর্যন্ত চারজন পুলিশ সদস্য মারা গেছেন। আক্রান্ত আছেন অনেক। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরাতো হচ্ছেনই। আমরা শুনছি মাঠপর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তারও করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন। অর্থাৎ করোনাযুদ্ধের সম্মুখে যারা আছেন, তাদের বড় মূল্য দিতে হচ্ছে এই যুদ্ধে।
ঠিক এই যখন অবস্থা তখন আমরা দেখলাম সাধারণ ছুটির এক মাসের বেশি কিছু সময় না যেতেই তৈরি পোশাকসহ নানা কারখানা খোলা শুরু হয়েছে। ঢাকা শহরে প্রতিষ্ঠিত রেস্তোরাঁগুলো সরকারি অনুমোদন নিয়ে ইফতারি বিক্রি করতে শুরু করেছে। বাজারগুলোতে শুধু মানুষ আর মানুষ।
সত্যি বলতে কী শুরু থেকেই আমাদের সামাজিক বিচ্ছিন্নকরণ কর্মসূচি ছিল অনেক ঢিলেঢালা। একটা কারণ আমরা আসলে লকডাউন কথাটিই উচ্চারণ করিনি। সরকারি আদেশে সাধারণ ছুটির কথা বলা হয়েছে এবং মানুষ এই আদেশকে ছুটির আমেজ হিসেবেই নিয়েছে এবং করোনা স্বাস্থ্যবিধিকে উপেক্ষা করে বাইরে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে। তারপরও বলতে হবে এই ছুটি আমাদের সংক্রমণকে অনেকখানি ঠেকিয়ে রাখতে সহায়তা করেছে।
করোনাভাইরাসের থাবায় অর্থনীতি আজ স্তব্ধ। থমকে আছে বাজার, উৎপাদন, বিপণন। এমন বাস্তবতায় ব্যবসার তালা খুলে দেয়ার তাগিদ সবদিক থেকেই। তবে বড় চাপ এসেছে সবচেয়ে বড় রফতানি সামগ্রী উৎপাদনকারী তৈরি পোশাক খাত থেকেই। এবং আমরা দেখলাম এই খাতের মালিকরা তাদের শ্রমিকদের নিয়ে নিষ্ঠুর টানাহেঁচড়া করেছেন বেশ কিছুটা সময়।
এই ভাইরাস অসংখ্য মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে বিশ্বব্যাপী। সম্পদশালী দেশগুলোও পেরে উঠছে না তার সাথে। সেই দেশগুলো একটা নির্দিষ্ট সময় লকডাউন নামের কড়াকড়ি বজায় রেখে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছে। এই ঘুরে দাঁড়াবার প্রক্রিয়াটা কী সেটাই এখন আলোচ্য বিষয়। পুরো মে-জুন মাস আমাদের একটা বড় পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। একদিকে আমরা আধা-আধি লকডাউনে ছিলাম, এখন আবার আধা-আধি পরিকল্পনা করে ঘরের তালা খুলে দেয়ার প্রচেষ্টা কাম্য হতে পারে না।
ঘুরে আমাদের দাঁড়াতেই হবে। জীবনকে রক্ষা করে মানুষের জীবিকাকে সচল রাখা জরুরি কাজ। জীবিকা স্তব্ধ হয়ে গেলে জীবন চলতে পারে না। দীর্ঘ ছুটি, বন্ধ বা লকডাউন, যে নামেই ডাকি না কেন, এক মাসেরও বেশি সময় ধরে মুখ থুবড়ে পড়েছে আমাদের জীবন, জীবিকা ও অর্থনীতি। এই বিপুল ক্ষতি কতদিনে পূরণ হবে, সেটা নিয়ে ভাবনার চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা।
প্রশ্ন হলো কাজটা হবে কীভাবে? শুক্রবার এ লেখার সময় জানা গেল, এই প্রথম একজন সংসদ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি উত্তরবঙ্গের নিজের নির্বাচনী এলাকা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। একইদিনে প্রকাশিত আরেক তথ্যে জানা গেল, সাভারে ৫১ জনের নমুনা পরীক্ষা করে আটজনের পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়া গেছে। এরমধ্যে সাতজনই পোশাকশ্রমিক। এই অবস্থায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে শিল্পাঞ্চল সাভার-আশুলিয়ার তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হবে কিনা সেটা নিশ্চিত নয়, তবে সংশ্লিষ্ট সবাই একটি বিষয নিশ্চিত করেছেন যে, সম্প্রতি পোশাক কারখানা খুলে দেয়ার পর থেকে এই অঞ্চলে করোনা সংক্রমণের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে।
জীবিকার দরজা খুলে দেয়ার আগে এই তথ্যগুলোসহ সারাদেশের চিত্রটা আরেকবার ভালোভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। খুলে দেয়া মানে লক্ষ লক্ষ মানুষের আয়ের পথ খুলে যাওয়া। কিন্তু সেটা কি লাগামছাড়া হবে? প্রধানমন্ত্রী সেটা অবশ্যই চাইবেন না। কিন্তু তিনিতো একা নন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রশাসনের যার যেখানে ভূমিকা রাখার আছে তাদের প্রত্যেকের প্রতিটি পদক্ষেপেই চিন্তাভাবনার ছাপ অত্যন্ত সুস্পষ্ট হতে হবে। বিজিএমইএ বা ফেডারেশন চেম্বারসহ প্রাইভেট সেক্টরের নেতৃত্বের কাছেও সেটাই প্রত্যাশা।
প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গকে তিনটি জোনে ভাগ করেছে সেখানকার সরকার- রেড, অরেঞ্জ এবং গ্রিন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে বিশেষ সতর্কতা। রেড জোন মানে সেখানকার অবস্থা ভয়াবহ আর গ্রিন জোন মানে হলো ভাইরাসমুক্ত অঞ্চল। আমরা কি এমন পরিকল্পনা করেছি বা করছি? স্বচ্ছতার সাথে মানুষের সামনে বিষয়গুলো উঠে আসা দরকার। গ্রিন জোনে সমস্ত দোকানপাট খোলার পাশাপাশি কারখানাও চালু করা যাবে। এমনকী, চালানো যাবে গণপরিবহনও। তবে নানা শর্ত আছে এখানেও।
আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে গেলেও করোনা তার থাবা গুটিয়ে নেয়নি। বিজিএমইএ যদি মনে করে কারখানার গেটে জ্বর মাপা আর কর্মীদের মুখে মাস্ক পরাই সুরক্ষার প্যাকেজ তাহলে সেই ভাবনা সম্পূর্ণ নয়। এই কর্মীরা বাসায় ফেরত গিয়ে কী ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মনে চলাচল করছে সেটাও ভাবা দরকার। সাভারের ঘটনা সেই ইঙ্গিত দেয়। মনে রাখা দরকার ফ্রন্টলাইন যোদ্ধাদের মধ্যে চিকিৎসকরাই করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি। তাই আমাদের মতো সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হলে প্রয়োজনমতো চিকিৎসকও আমরা হয়তো পাব না।
জীবন, জীবিকা ও অর্থনীতি চালু করতেই হবে। স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করতেই হবে, ঘুরে আমাদের দাঁড়াতেই হবে। কিন্তু এসব করতে হবে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনার মাধ্যমে। জীবিকার জন্য লাগামছাড়া হলে জীবনটাই যে চলে যেতে পারে। তাই নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী সমাজ, চিকিৎসক সমাজ সেটা ভাববেন। এবং আমরা নাগরিকরাও যেন একটু নিজেদের নিয়ে পরিকল্পনা করি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি।
এইচআর/বিএ/এমএস