আগে চিকিৎসকদের বাঁচান
করোনাভাইরাসে সারাদেশে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে প্রায় দুই শতাধিক চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। দেশে চিকিৎসক মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। দিন দিন বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত চিকিৎসকের সংখ্যা। অরক্ষিত অবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এভাবে চিকিৎসকরা আক্রান্ত হলে রোগীদের কী হবে?
মানসম্মত এবং সময় মতো ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক (পিপিই) পাননি আমাদের চিকিৎসকরা। শুরুতেই এ বিষয় নিয়ে ঝামেলা তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসকদের যে পিপিই দেয়া হচ্ছে তা মানসম্মত নয়। চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে; চিকিৎসক, নার্স অসুস্থ হয়ে পড়লে করোনাভাইরাস চিকিৎসাসহ সাধারণ চিকিৎসায় সংকট তৈরি হবে। চিকিৎসক বাঁচলেই তো রোগীদের বাঁচানো যাবে। আগে চিকিৎসকদের পূর্ণ সুরক্ষা দরকার। তারা সুস্থ থাকলে, তাদের মনোবল ঠিকঠাক থাকলে রোগীদের পূর্ণ চিকিৎসা মিলবে, তা না হলে নয়।
করোনাভাইরাসের রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে দিন দিন এভাবে যদি চিকিৎসকরাই আক্রান্ত হয়ে পড়েন তাতে চিকিৎসক সমাজে আতঙ্ক তৈরি হয় বৈকি! ইতোমধ্যে হয়েছেও তা। সে কারণে চিকিৎসকদের সাথে জনগণ এবং সরকারের ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসরণ না করায় এবং মন্ত্রণালয়ের নানা গাফিলতির কারণে চিকিৎসাসেবায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। তারা মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেক বক্তব্যে দ্বিমত পোষণ করেন। এ নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে এখন হতাশা বিরাজ করছে। শুধু তাই নয়, ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক না দিয়ে উল্টো হুমকি দেয়ার কারণে অনেকের মনোবল ভেঙে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে এখন গতি বাড়িয়েও তা চাঙ্গা হচ্ছে না। বিষয়টি যথেষ্ট ভাবনার। এই দুঃসময়ে সৃষ্টিকর্তার পরে চিকিৎসকরাই কিন্তু আমাদের ভরসা। তাদের চটিয়ে দিলে, জোর করে কিছু চাপিয়ে দিলে, সর্বোপরি তাদেরই সুরক্ষা না দিলে চলবে কীভাবে?
ভুল বোঝাবুঝি প্রশাসন, সরকার এমনকি জনগণের মধ্যেও রয়েছে। আমরাও সুযোগ পেয়ে কম লিখছি না। তুলোধুনো করে ছাড়ছি চিকিৎসকদের। আসলে চিকিৎসকদের মনোকষ্ট আমরা কেউই বুঝতে চাই না। না সরকার না জনগণ। ঢাল-তলোয়ার থাকলে যুদ্ধ করা যায়। চিকিৎসা সরঞ্জাম পুরোপুরি না দিয়ে তাদের দোষারোপ করি কীভাবে? এই চিকিৎসকরা গত বছর ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে কী যুদ্ধটাই না করলেন। এমন জীবনাবাজি করে যারা লড়েন, তাদের বাহবা দিতে হয়। কাজের গতি বাড়াতে পুরস্কৃত করতে হয়। সেটা না করে তাদের হাতে যুদ্ধের সরঞ্জাম না দিয়ে উল্টো তাদের ওপরই চড়াও হয়েছি আমরা। মনে রাখতে হবে, চপেটাঘাত করে ভালো কিছু মেলে না কখনো।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসকদের ব্যাপারে সরাসরি নজর দিয়েছেন। ফলে চিকিৎসকদের কাজে বেশ গতি ফিরে এসেছে। আসলে দেশের সব জায়গায় কাজে সমন্বয়ের বড্ড অভাব রয়েছে। করোনা সংকটে তা কেবল প্রকাশ হয়ে পড়লো সবার সামনে।
পত্রিকায় প্রকাশ, চিকিৎসকদের সংক্রমণের কারণ সম্পর্কে বিএমএ’র শীর্ষ নেতারা বলেছেন, ডাক্তার ও নার্সদের সুরক্ষার জন্য পিপিই সরবরাহ থাকলেও যারা করোনা আইসোলেশন ইউনিট, করোনা ল্যাবরেটরিতে কাজ করেন এবং যারা নমুনা কালেকশন করেন তাদের আন্তর্জাতিক মানের পিপিই দেয়া হচ্ছে না। করোনা রোগীর চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত সবাইকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী পোশাক দেয়ার কথা থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানহীন পোশাক সরবরাহের অভিযোগ উঠেছে। সব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য সরবরাহকৃত মাস্কের বিষয়েও গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। করোনা আক্রান্ত রোগীদের এবং ল্যাবে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীদের এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও সেখানে এগুলো সরবরাহ করা হচ্ছে না। এতে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা বেশি মাত্রায় করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে। পিপিই সম্পর্কে তারা বলছেন, কিছু কিছু পিপিই ওয়াশ করে ব্যবহার করার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এটা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত বা গ্রহণযোগ্য?
চিকিৎসকদের আক্রান্ত হওয়ার পেছনে সমস্যা আরেকটা আছে। রোগীদের অসত্য তথ্য বা করোনা সংক্রমণের তথ্য গোপন রাখার কারণেও চিকিৎসক ও নার্সরা আক্রান্ত হচ্ছেন। মিথ্যা তথ্য দিয়ে রোগীরা চিকিৎসা নেয়ার চেষ্টা করছেন। এ কারণে বিভিন্ন হাসপাতালের সার্জারি ও গাইনির কোনো কোনো ইউনিটের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের সার্জারি, গাইনি বিভাগে ও সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। সলিমুল্লাহ মেডিকেলের ঘটনায় ১৩ জন চিকিৎসক ও নার্স আক্রান্ত হয়েছেন। ওই চিকিৎসক ও নার্সরা যেখানে কাজ করতেন, সেসব ইউনিট বন্ধ রয়েছে। মুন্সিগঞ্জের একজন মাওলানা মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভর্তি হওয়ায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের একটি ইউনিট বন্ধ হয়ে যায়। এতে এক ডাক্তার ও নার্সসহ পুরো ইউনিটের সবাইকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। এভাবে সিলেট, গাজীপুর ও কিশোরগঞ্জেও একই ঘটনা ঘটছে।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ডাক্তারদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার অভাব। করোনা আতংকে সরঞ্জামের অভাবে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কথা ভেবে চিকিৎসকরা রোগী দেখা কমিয়ে দিয়েছেন। অনেকে নানা অজুহাতে বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। তাতে অনেক হাসপাতালের আউটডোরে ডাক্তার নেই বললেই চলে। রাজধানী ঢাকার নামিদামি হাসপাতালেও চিকিৎসক সংকট চলছে। তাতে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এমন সংকটে চিকিৎসা অনিশ্চিত হয়ে পড়ার কথা কি ভাবা যায়? এভাবে কি চলে?
রোগ সারাতে চাই চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী। তারা না থাকলে রোগীরা বড় অসহায়। কারা চিকিৎসা দেবেন রোগীদের? এ পর্যায়ে এসে প্রশ্ন ওঠে, কেন চিকিৎসা অনিশ্চিত হয়ে পড়লো? কেন চিকিৎসকের সংকট তৈরি হলো? করোনা আতংকের মধ্যে শুরুতেই চিকিৎসকদের সুরক্ষা সরঞ্জাম দেয়া হয়নি। এটা কিন্তু বড় সত্য। রোগীর অনুপাতে চিকিৎসকদের মধ্যে সংক্রমণের হার বেশি হওয়ায় স্বভাবতই আতংক তৈরি হয়েছে। এই আতংকের পেছনে সেই পিপিই না থাকাটাই প্রধানতম কারণ। চিকিৎসকরা বলে আসছেন, তাদের কাছে না পৌঁছালেও প্রশাসনের হাতে পিপিই চলে গেছে বহু আগে। আমরা দেখেছিও সেটা। প্রশাসনের লোকজন এমন কি দলীয় নেতাকর্মীরাও পিপিই পরে ফটোসেশন করেছেন। ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরাও পিছিয়ে ছিলেন না। অথচ যে চিকিৎসকরা সেবা দেবেন, তারাই পাননি পিপিই। কষ্টেরই কথা।
কথা আরও আছে। চিকিৎসকরা কর্তব্য পালন করতে যাওয়ার পথে রাস্তায় পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে দু’একটি। চিকিৎসকদের সাথে বাড়ির মালিক বা প্রতিবেশিরাও খারাপ আচরণ করছেন, চড়াও হচ্ছেন। কেউ একবারও ভাবেন না তারা কিংবা তাদের স্বজনরা আক্রান্ত হলে কোথায় যাবেন? চিকিৎসকরা কর্মস্থলে যেতে-আসতে বাধার সম্মুখীন হলে অসম্মানিত হলে তারা কি তাদের সেবা কাজে মনোযোগ দিতে পারবেন? তাতে কার ক্ষতি হবে আদতে? নিজেদেরই তো। সুতরাং চিকিৎসকদের সম্মান দেখাতে হবে। পেশার মর্যাদা দিতে হবে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। রাস্তায় পুলিশ বাহিনী কর্তৃক কোনো চিকিৎসক লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
যে কোনোভাবে চিকিৎসকদের সন্তুষ্ট রেখে হাসপাতালমুখী করতে হবে। তাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, অসুস্থ হলে চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়া, যাতায়াত সুরক্ষা থাকা বাঞ্চনীয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন হাসপাতালে অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে সুসম্পর্ক আছে আমার। বন্ধুও আছেন বেশ কয়েকজন। একটি বেসরকারি হাসপাতালের চেয়ারম্যান হওয়ায় তাদের সাথে সম্পর্কটা একটু নিবিড়ও। প্রায় প্রতিদিনই কারও না কারও সাথে কথা হয় আমার। প্রত্যেকেরই একই কথা, রোগীই তাদের প্রাণ। রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে তারা সবসময়, সর্বাবস্থায় প্রস্তুত। তবে ন্যূনতম স্বাস্থ্য সুরক্ষা চাই তাদের।
এ ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেল কলেজের জনৈক প্রফেসর সেদিন বলছিলেন, ‘গত বছর ডেঙ্গুতে আমাদের অনেক চিকিৎসক সেবা দিতে গিয়ে মারা গেছেন। জীবনের অনেক ঝুঁকি থাকলেও চিকিৎসকরা তখন পিছপা হননি। রোগীর জীবনের প্রশ্নে চিকিৎসকরা পিছপা হন না কখনো।’ সত্য এটা যে, আমাদের দেশে চিকিৎসকদের ভালো কাজের জন্য বাহবা কম মেলে। উল্টো মেলে তিরস্কার। আরেকজন বন্ধু চিকিৎসক তো আক্ষেপ করে বললেন, ‘পেছনের বেঞ্চের ছাত্র পুলিশ-প্রশাসনে এসে আমাদের ধমকায়। রাস্তায় অসম্মান করে’। এসব দূর করতে হবে। চিকিৎসকরা জীবনের ঝুঁকি নেবেন, আর তাদের উল্টো প্রয়োজনীয় মর্যাদাটা পর্যন্ত দেয়া হবে না, তা কী করে হয়? তাদের স্বাস্থ্যের কথাও ভাবতে হবে আগে।
শুরুতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে রাজধানীর মিরপুরে একটি বেসরকারি হাসপাতালের এক তরুণ চিকিৎসক নিজেই আক্রান্ত হয়েছেন। তাকে হাসপাতালে বিশেষ ব্যবস্থায় চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এর আগে আরও কয়েকজন চিকিৎসক করোনাভাইরাস রোগীর সংস্পর্শে গিয়ে নিজেরা এখন কোয়ারেন্টাইনে আছেন। একাধিক নার্সও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এ নিয়ে দেশব্যাপী ডাক্তারদের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্টা দেখা দিয়েছে। এ উৎকণ্ঠার কারণ সহসাই সরকারকে দূর করতে হবে। তা না হলে দেশে চিকিৎসক সংকট এবং চিকিৎসাখাতে বিপর্যয় দেখা দেবে।
রাতদিন একজন চিকিৎসককে পরিশ্রম করতে হয়। রোগীর ডাক পড়লেই তার ঘুম হারাম। আর তাকে যদি কথায় কথায় অসম্মান আর অপবাদ কাঁধে নিয়ে চলতে হয় তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়ায়? ভালো কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন চিকিৎসক। প্লিজ অভিযোগ করতে হলে ভেবে তবেই করবেন। সঠিকটা করবেন। এ কথাও মাথায় রাখবেন যে, আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ছাড়া আমাদের চিকিৎসকরা যে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন তা-ও কম নয়। চিকিৎসকদের সকল সমস্যা সমাধানপূর্বক, চিকিৎসক-নার্সদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করে করোনা সংকট দূর করতে সংশ্লিষ্টদের আরও বেশি যত্নবান হতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক
এইচএ/এমএস