ভাইরাসের উৎস সন্ধান নাকি আমেরিকার ভাগ্য ফেরাবেন ট্রাম্প!
রীতিমতো একটি বাকযুদ্ধ চলছে আমেরিকায়। ফেডারেল আর স্টেট গভর্নরদের মাঝে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাহী। আর স্টেটগুলো গভর্নরদের হাতে। বাকযুদ্ধ চলছে প্রতিদিন। নিউইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু ক্যুমো বলেছেন, নিউইয়র্ক স্টেট আমার কথাতেই চলবে। প্রেসিডেন্ট কিছুই করতে পারবেন না। এখানে আমি হুকুম দেয়ার মালিক।
গভর্নর ক্যুমো ঝানু পলিটিশিয়ান। তার বাবা মারিও ক্যুমো দীর্ঘদিন নিউইয়র্কের গভর্নর ছিলেন। তাই অ্যান্ড্রু পলিটিকস ভালোই বোঝেন। তিনি চমৎকার করেই বলেছেন, জীবন বাঁচানো আর রাজনীতির মারপ্যাঁচ এক নয়। মানুষের জীবন আগে।
গভর্নর ক্যুমো সিএনএনকে একটি এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সম্প্রতি। এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তারই ছোট ভাই, সিএনএনের বিশিষ্ট সাংবাদিক ক্রিস ক্যুমো। ক্রিস করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এখন সেরে উঠছেন ক্রমশ। তার স্ত্রী ক্রিস্টিনাও আক্রান্ত হয়েছিলেন।
ক্রিস ক্যুমো নিজের বাড়ির বেসমেন্টেই অস্থায়ী অফিস করে নিয়েছেন। সেখান থেকেই চলছে তার সিএনএন ব্রডকাস্ট। ক্রিসের প্রশ্নের জবাবে গভর্নর ক্যুমো স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিউইয়র্ক খুলে দেয়ার ব্যাপারে জবরদস্তি চালাতে পারবেন না। এটা ফেডারেল সংবিধান পরিপন্থী। ট্রাম্প এটা করতে চাইলে তার বিরুদ্ধে মার্কিন ফেডারেল কোর্টে মামলা হবে। ট্রাম্প নিশ্চয়ই এই সময়ে মামলা লড়তে চাইবেন না! গভর্নর ক্যুমো ট্রাম্পের অনুরোধ উপেক্ষা করেই ঘোষণা দিয়েছেন, নিউইয়র্ক স্টেট আগামী ১৫ মে পর্যন্ত লকডাউন থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্রে এখন ধাক্কাধাক্কি চলছে, আমেরিকা খুলে দেয়া নিয়ে। ট্রাম্প চাইছেন আমেরিকা খুলে দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা করতে মনোযোগ দিতে। বাধ সাধছেন বিভিন্ন স্টেটের গভর্নর। তারা বলছেন, আমরা মানুষের প্রাণহানির ঝুঁকি নিয়ে আমাদের অঙ্গরাজ্য খুলে দিতে পারি না।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিদিন বিকেলে হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন তার টিম নিয়ে।কদিন আগে সংবাদ সম্মেলনে আমেরিকা খুলে দেয়ার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।’ ওই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে তার উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ও হয়েছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে বলা আছে আইনশৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব অঙ্গরাজ্যগুলোর।
ট্রাম্পের এই বক্তব্যের পর পেনসিলভেনিয়া রাজ্যের গভর্নর টম উলফ বলেছেন, ‘আমার রাজ্যে সবকিছু বন্ধ করা হয়েছে যেভাবে আমাদের প্রশাসনিক দায়িত্বে, সেভাবে সবকিছু খোলার প্রাথমিক দায়িত্ব আমাদেরই।’
নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, রোড আইল্যান্ড, কানেকটিকাট, ডেলাওয়্যার, ম্যাসাচুসেটস এবং পেনসিলভেনিয়ার গভর্নররা এ ব্যাপারে সবদিক বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে বিধিনিষেধ তোলার দিনক্ষণ তারা দেননি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প নানাদিক একাই সামলাতে চাইছেন। আমেরিকায় সংক্রামক ব্যাধিবিষয়ক প্রধান ড. অ্যান্টনি ফউচিকেও তিনি আক্রমণ করেছিলেন এক টুইটবার্তায়। আমেরিকার এই শীর্ষ বিশেষজ্ঞ সিএনএন টেলিভিশন অনুষ্ঠানের সরাসরি এক সম্প্রচারে বলেছিলেন, আমেরিকা করোনাভাইরাসে প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর আরও আগে লকডাউন জারি করলে আরও প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হতো। এমন উষ্মা প্রকাশ করেছেন আমেরিকার অনেক বিশেষজ্ঞই।
এদিকে লকডাউেনর প্রতিবাদ করে কিছু মানুষ মিছিল শুরু করেছে আমেরিকার রাস্তায়৷ একটাই বক্তব্য তাদের, ‘লিভ ফ্রি অর ডাই’, অর্থাৎ স্বাধীনতা দাও না হলে মৃত্যু৷ তাদের দাবি যে সমস্ত এলাকায় করোনার প্রকোপ কম, সেই সব এলাকা খুলে দিতে হবে৷ ঘটনাটি ঘটছে নিউ হ্যাম্পশায়রের কনকর্ড৷ সেখানে লকডাউন মানতে চাইছেন না কেউ৷ ঠান্ডার মধ্যে রাস্তায় নামলেন অনেকে৷ অনেকে আবার গাড়িতে বসেই অংশ নিলেন এই প্রতিবাদ মিছিলে৷ তাদের বক্তব্য ছিল যে তাদের এলাকায় কম করোনার সংক্রমণ সেভাবে ছড়াতে পারেনি৷ তাই তারা কেন বাড়িতে বসে থাকবেন, তা নিয়েই ছিল প্রতিবাদ৷
শুধু নিউ হ্যাম্পশায়রে নয়, মেরিল্যান্ডেও একইভাবে প্রায় ২০০ মানুষ নামলেন রাস্তায়৷ তাদেরও একই বক্তব্য৷ অন্যদিকে এইভাবে লকডাউন না মানার প্রতিবাদে টেক্সাসের মানুষও সামিল হলেন৷ তারা সকলে চাইছেন আবার কাজে ফিরতে৷ সাধারণ জীবনযাপন করতে৷ লকডাউনে বাড়িতে বসে থাকলে দেশের অর্থনীতিও মুখ থুবড়ে পড়বে৷ এই আশঙ্কা করছেন তারা৷ যার জেরে অনেকে চাকরি হারাতে পারেন৷ এই যে হঠাৎ মিছিল, তাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ইন্ধন রয়েছে বলেও বলছেন কিছু দুর্মুখ! মিছিল যতই হোক, এই মৃত্যুমিছিল ডিঙিয়ে আমেরিকা যে সহজেই খোলা যাবে না- তা ভেতর থেকে ভালো করেই অনুমান করা যাচ্ছে।
ট্রাম্প করোনাভাইরাস নিয়ে দোষারোপ করছেন নানাভাবেই। তিনি ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনকে (ডব্লিউএইচও) সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছেন। করোনা মোকাবিলায় হু-র বিরুদ্ধে চীনকে বাঁচানোর অভিযোগ তুলে আগেই অর্থ সাহায্য বন্ধের হুমকি দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। চিকিৎসা ও গবেষণার জন্য গত বছরে হু-কে দেয়া মার্কিন অর্থ সাহায্যের পরিমাণ ছিল ৪০ কোটি মার্কিন ডলার। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর ডব্লিউএইচওর তরফ থেকেও এসেছে তীব্র প্রতিক্রিয়া৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পাল্টা জানিয়ে দিয়েছে, ওই সব ফালতু বিষয়ে সময় নষ্ট করার মতো পরিস্থিতি এখন নয়৷ আপাতত একটাই উদ্দেশ্য, করোনাভাইরাসের মহামারি থেকে বিশ্ববাসীকে উদ্ধার করা৷
ডব্লিউএইচও প্রধান তেদ্রোস আধানম গেব্রেসুস টুইটারে লেখেন, ‘নষ্ট করার মতো সময় নেই৷ হু-এর এখন একটাই ফোকাস, মানুষের জীবন বাঁচানো ও কোভিড-১৯ মহামারি থামানো৷’
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আরও ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন করোনাভাইরাসের উৎস সন্ধানে। চীনের উহান থেকে করোনা এসেছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কয়েকবার সংবাদ সম্মেলনে এটিকে ‘চাইনিজ ভাইরাস’ বলেও উল্লেখ করেন। যা খুবই বিতর্কিত হয়। উহানের ল্যাব থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে কিনা; হোয়াইট হাউসের সংবাদ সম্মেলনে জানতে চাইলে ট্রাম্প বলেন, এ ব্যাপারে তিনি সতর্ক রয়েছেন। করোনাভাইরাসের কারণে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি ঘটেছে, তার পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণে যাচ্ছি আমরা।
তবে ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের এক অধ্যাপকের দাবি যুক্তরাষ্ট্রেই তৈরি হয়েছে করোনাভাইরাস এবং এর উন্নয়নের কাজ করেছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের জুম প্যানেলের এক আলোচনা সভায় এ তথ্য জানান, ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইনোরিটি অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ডাইভার্সিটির সহ-সভাপতি রিকি হল। তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো সঠিক জানি না ভাইরাস কোথায় তৈরি হয়েছে। তবে এটি যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।’
অন্যদিকে মার্কিন গণমাধ্যম ফক্স নিউজ বারবার বলছে, ‘উহানের ল্যাব থেকে করোনা ছড়িয়েছে।’ এ বিষয়ে এর আগে একাধিকবার দাবি করেছে মার্কিন সরকার। তবে বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে চীন সরকার। যথেষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বারবার দায় অস্বীকার করছে চীন।
আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন এক ফরাসি বিজ্ঞানী। খ্যাতিমান এই বিজ্ঞানী লিচ মোতানিয়ার কোভিড-১৯ এর উৎপত্তি নিয়ে এক বিস্ময়কর যুক্তি দাবি করেছেন। নোবেল পুরস্কারবিজয়ী এ বিজ্ঞানী একটি সংবাদ চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জানান, সার্স কোভ-২ বা কোভিড–১৯ ভাইরাসটি এইডসের প্রতিষেধক তৈরি করতে গিয়ে উৎপন্ন হয়েছে। ২০০৮ সালে আরেক বিজ্ঞানী ফসয়েস বারে সিনুসির সঙ্গে এইডস ভাইরাসটি (এইচআইভি) আবিষ্কার করার জন্য লিচ মোতানিয়ার নোবেল পুরস্কার পান।
ফরাসি চ্যানেল সিনিউজকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মোতানিয়ার বলেন, করোনাভাইরাস জেনোমের মধ্যে এইডসের ভাইরাস রয়েছে এমনকি তার মধ্যে ম্যালেরিয়ার জীবাণু থাকাটা অতি মাত্রায় সম্ভব। তিনি আরও বলেন, এই শতকের প্রথম দশক থেকে উহানের ল্যাবরেটরি করোনাভাইরাস নিয়ে কাজ করছে এবং এই বিষয়ে তারা যথেষ্ট দক্ষতাও অর্জন করেছে। যদিও অধ্যাপক মোতানিয়ারের এই বক্তব্যের জন্য অন্যান্য বিজ্ঞানীসহ তার সহকর্মীদের একাংশ ওনাকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেছেন।
বিতর্ক যেন থামতেই চাইছে না। করোনাভাইরাসের উৎস ও মোকাবিলা নিয়ে চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। এ জটিলতা অবসানে যুক্তরাষ্ট্রকে উহানের ল্যাব পরিদর্শনের অনুমতি দিতে চীনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও।
তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কাছে আহ্বান জানাচ্ছি, ওই ভাইরোলজি ল্যাবে আমাদের বিশেষজ্ঞদের প্রবেশের অনুমতি দিতে, তাহলে আমরা জানতে পারব ভাইরাসটির উৎপত্তি কোথায়।’
চীন কি সেই অনুমতি দেবে? চীন কি রাজি হবে আমেরিকার সাথে এ নিয়ে যৌথ কাজ করতে? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর এখন অজানা। যেমন অজানা মার্কিন মুলুক কবে ফিরে পারে তার পুরোনো জৌলুস। কবে এই জনপদ ফিরবে সেই পূর্বেকার গতিতে। আসছে নভেম্বরেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ট্রাম্প আবারও অন্যতম প্রার্থী।
তিনি পাস করে আসবেন- সেটাই মনে হচ্ছে এই সময়ে। কিন্তু তার আগে চাই সাধারণ মানুষের কাজকর্ম, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্যের নিরাপত্তা, নিশ্চয়তা। যারা চলে গেছেন চিরতরে- তারা এখন শুধু স্মৃতি। কিন্তু আগামী তো বেঁচে থাকাদের জন্যেই। সংগ্রাম করে যেতে হবে সেই মুক্তিকামী প্রজন্মকেই, তাদের নিশ্চিত আগামীর জন্য।
নিউইয়র্ক, ২০ এপ্রিল ২০২০
email- [email protected]
এইচআর/বিএ/জেআইএম