করোনা, ত্রাণ ও উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন
বিশ্বব্যাপী চলছে ভয়াবহ করোনা মহামারি। এক অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্যোগ নেমে এসেছে বিশ্বময়। এ দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য চেষ্টাও চলছে নিরন্তর। বিশ্বব্যাপী সে প্রচেষ্টার সাফল্য এখনও চোখে পড়ছে না। উন্নত ও মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো এই দুর্যোগ মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। অনুন্নত রাষ্ট্রগুলোর তো কথাই নেই। সমগ্র পৃথিবী এক দিশেহারা গন্তব্যের পথে যেন ভাসমান-দোদুল্যমান। কোনো সঠিক দিকনির্দেশনা কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। চারদিকের কোথাও সংকট থেকে উত্তরণের আশার কোনো ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যুক্ত হচ্ছে মৃত্যুর মিছিলে। এ মিছিল ইউরোপ থেকে আমেরিকা, আমেরিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রেলিয়া আফ্রিকা, আফ্রিকা থেকে এশিয়ার মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছে। ভয় ও আতঙ্ক বুকের মধ্যে নিয়েই পৃথিবীর মানুষের নিত্য বসবাস এখন। বাংলাদেশও ভয়ংকর করোনাভাইরাস ঘটিত রোগে মৃত্যুও সেই অমোঘ মিছিলে ধীরে ধীরে যুক্ত হয়েছে।
প্রতিদিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। অসহায়ত্ব আমাদের ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশের প্রায় সবগুলো জেলাতেই কম বেশি কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে। ফলে সমগ্র দেশই স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে আছে বলে ঘোষিত হয়েছে। এ রূপ অবস্থায় একদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তরের মধ্যে আমরা যেমন সমন্বয়ের অভাব দেখছি তেমনি দেখছি ব্যবস্থাপনার দক্ষতার অভাবও। ফলে করোনা প্রতিরোধে সম্মুখ সারির যোদ্ধা তথা ডাক্তার, নার্স বা অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর সুরক্ষার বিষয়টি বিগত মাসাধিককালের মধ্যেও তেমন সমাধান হয়নি। পরীক্ষার পরিধি কিছুটা বাড়লেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। কোথাও কোথাও আবার গুণগত মানসম্পন্ন পিপিই নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সেসবকে ‘ভুলবশত’ সরবরাহ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। যা পত্রপত্রিকার খবর হয়েছে। এমন দুর্যোগের মুহূর্তে এ রূপ ‘ভুল’ হওয়া অদক্ষতাকেই স্পষ্ট করে তোলে। শুধু তাই নয় এমন স্পর্শকাতর সময়ে এমন ভুলের কী পরিণাম হতে পারে তাও ভাবতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে মানসম্মত পিপিই সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো রকমের আপস বা অবহেলা কাম্য নয়। সাধারণের মধ্যে কোয়ারেন্টাইন নিয়ে যেমন এক প্রকার উদাসীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে তেমনি উদাসীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং তার অধীনস্ত সংস্থাসমূহের মধ্যেও। দুই পক্ষের এ রূপ উদাসীনতার মূল্য আমাদের বহু জীবনের বিনিময়ে যে শোধ করতে হবে তা যেন দিনদিনই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
আমরা নিদারুণ স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্য দিয়ে কোয়ারেন্টাইন তথা অন্যের সংস্পর্শ এড়িয়ে গৃহবাসী জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছি। বসবাস করছি ঘরের মধ্যে- সামাজিক দূরত্ব অনুশীলনের মাধ্যমে। কিন্তু সকলের মধ্যে এই দূরত্ব অনুশীলনের আগ্রহ নেই। একদিকে আইন যতই কঠোর করা হচ্ছে বলে মৌখিকভাবে ঘোষিত হচ্ছে অপরদিকে মানুষের বিচিত্র ছলচাতুরীও তার সাথে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের করোনা আক্রান্ত রোগীর পরিসংখ্যান বিবেচনায় লক্ষ করা যাচ্ছে যে, এখন পর্যন্ত ২১ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের মধ্যে কোভিড-১৯ এর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, এ বয়সীদের মধ্যে করোনা সম্পর্কে এক ধরনের তাচ্ছিল্যভাব আছে। তাই ঘরে থাকার সরকারি সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডকে এরা তোয়াক্কা করছে না। বাইরে বহুজনের সংস্পর্শে আসার ফলে এই বয়সীদের করোনা আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি।
আবার ‘লকডাউন’ কেমন চলছে তা দেখার জন্য কৌতূহল মেটাতেও তারুণ্যের দাপটে বাইরে এসে এরা বহুজনের সংস্পর্শে আসছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সাথেও এরা নানা ধরনের বচসায় লিপ্ত হচ্ছে। এছাড়া আরও একটি কারণ হয়তো অনুসন্ধানে পাওয়া যাবে। গাজীপুর, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ বা দেশের অন্যান্য জেলায় যেসব করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে তার বেশির ভাগই নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা বিভিন্ন কারখানায় কর্মরত প্রায় সমবয়সীদের সংস্পর্শ থেকেই সৃষ্ট। সুতরাং বলা যায় যে, এই বয়সীদের মেলামেশার নৈকট্য এদেশে করোনা আক্রান্তের হারকে নীরবে বৃদ্ধি করে চলেছে যা সংশ্লিষ্টদের পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদেরও স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফলে আগামী তিন-চারটি সপ্তাহ বাংলাদেশের জন্য আরও সংবেদশীল ও স্পর্শকাতর হয়ে ওঠার সম্ভাব্য আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। আমরা জানি না আমাদের নিকট ভবিষ্যতের সামনের দিনগুলো কী পরিণাম বয়ে আনবে। আবার বিগত শনিবার (১৮ এপ্রিল) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে মাওলানা জুবায়ের আনসারীর জানাজা নামাজে উপস্থিত প্রায় লক্ষ মানুষের সমাবেশের পর করোনা পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় তাও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই উপলব্ধি করা যাবে। জানি না এই বিশাল নামাজে জানাজা আমাদের জীবনকে বিশেষত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাধারণ মানুষের জীবনকে কোন বিপর্যয়ে ফেলল! সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষের কী বিধিলিপিই বা লেখা হলো শনিবারের ঘটনায় জানি না।
বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যুর যে মিছিল শুরু হয়েছে তার সাথে বাংলাদেশ সামিল হয়েছে, আগেই বলেছি। তবু এক শ্রেণির মানুষ এই মৃত্যুকে তোয়াক্কা করছেন না। বরং মৃত্যুর মিছিল সামনে রেখে নিজেরা সম্পদশালী হওয়ার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছেন! এই ভয়াবহ দুর্যোগের মধ্যেই বর্ণিত শ্রেণিপেশার মানুষ যার যার মতো করে এক ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল সমগ্র বিশ্বে করোনা ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা দেখবার পর থেকেই। তারা যেন ঠিক এ রূপ একটি মহামারিরই প্রত্যাশায় দিন গুনতে ছিল! এদের কর্মকাণ্ড ও সার্বিক অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে করোনা মহামারির ফলে তাদের আন্তরিক প্রত্যাশাই ঈশ্বর পূরণ করেছেন! তাই তারা সরকারি ত্রাণ ও খাদ্য সহায়তার চাল, ডাল, তেল, নুন আত্মসাতে হয়ে উঠেছেন প্রাগলপ্রায়!
সবল বা দুর্বল যেকোনো রাষ্ট্রই তার মতো করে লকডাউন ঘোষণা করে জনসমাগম এড়িয়ে চলার চেষ্টায় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছে। বাংলাদেশও এর বাইরে ছিল না। যথাসময়ই সরকারি ঘোষণায় যথাযথ উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়েছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রীর মতো হয়তো জননেত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে ঘোষণা করা সম্ভব হয় নি যে, ‘আপনারা ঘরে থাকুন, যতদিন সমস্যার সমাধান না হবে ততদিন আপনাদের খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যব্যবহার্য পণ্যসামগ্রী আপনাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া হবে।’ কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার নিম্ন-আয় ও খেটে-খাওয়া দিনমজুরদের মধ্যে খাদ্য সরবরাহের নিশ্চয়তা দিয়েছিল। সরকার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু আমাদের সমাজে মহামারি, নানা প্রকার দৈবদুর্বিপাক ও দুর্যোগের জন্য অপেক্ষাপূর্বক হা করে বসেও থাকেন এক শ্রেণির মানুষ! এবারও তার প্রমাণ হলো।
আমরা দেখলাম যখন করোনার ভয়াবহতার বিরুদ্ধে তার মৃত্যুরূপ আগ্রাসী ছোবল থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষার জন্য দেশের বিরাট এক অংশের মানুষ নানাভাবে অসহায়ের সেবায় যুক্ত হচ্ছেন তখন এই শ্রেণির নিকৃষ্টমনারা মেতে উঠলেন নিঃস্ব, দিনমজুরদের মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়ায়! এরা সরকারি ত্রাণের চাল, ডাল, তেল, লবণসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী লুট ও আত্মসাতে মেতে উঠেছেন! তথাকথিত জনপ্রতিনিধিরূপ এই শ্রেণির মানুষ করোনা শুরুর আগে থেকেই চুরির মালামাল লুকিয়ে রাখার জায়গাও প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। এখন পুলিশি অভিযানে সেসব গোপন আস্তানার সন্ধান মিলছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারবার এই শ্রেণির লুটেরাদের কঠোর শাস্তির কথা বলছেন কিন্তু কোথাও কোথাও তারই মন্ত্রী-এমপিরা সেসব রিলিফ-চোরদের বাঁচানোর জন্য থানায় গিয়ে তদবির ও দেন-দরবার করছেন!
সরিষার মধ্যে ভূত থাকলে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের অগ্রযাত্রা কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য পর্যন্ত পৌঁছাবে কী করে তা আমাদের সম্মুখে প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুও সরিষার ভেতর থেকে ভূত তাড়ানোর জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭৪ সালের এক ভাষণে তাই তিনি বলেছিলেন, ‘এখনো ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি, মুনাফাখোর, বাংলার দুঃখী মনুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। দীর্ঘ তিন বৎসর পর্যন্ত এদের আমি অনুরোধ করেছি, আবেদন করেছি, হুমকি দিয়েছি। চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনি। [...] এই বাংলার মাটি থেকে দুর্নীতিবাজ, এই ঘুষখোর, এই মুনাফাখোর এই চোরাকারবারিদের নির্মূল করতে হবে। [...] যে, কয়েকটা চোরাকারবারি, মুনাফাখোর, ঘুষখোর দেশের সম্পদ বাইরে বার করে দিয়ে আসে, জিনিসের দাম, গুদাম করে মানুষকে না খাওয়াইয়া মারে! উৎখাত করতে হবে বাংলার বুকে থেকে এদের।’
এর অল্পদিন পরই ঘাতকেরা সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে- তিনি সময় পাননি। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমাদের অনুরোধ যখন আপনার দার্শনিক অভিপ্রায়ের মধ্য দিয়ে আমরাও একটি উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখি তখন জোরের সঙ্গেই বলি চোরদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করুন আর যেসব ভূতের চারদিকে চোরের আবেষ্টন তাদেরও দল থেকে চিরতরে বহিষ্কার করুন। একজন চোর থাকলেও উন্নত রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। যারা দরিদ্র মানুষের মুখের গ্রাস চুরি করে উন্নত রাষ্ট্রের বড় বড় প্রকল্প হাতে পেলে তারা যে কী করবেন তা তো আপনার ভালোই জানা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার হাত ধরেই আমরা একটি উন্নত রাষ্ট্রে পদার্পণ করতে চাই।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/বিএ/পিআর