ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

টেস্ট, টেস্ট, টেস্ট - টেস্টের বেস্ট!

সম্পাদকীয় ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৪:৫৬ পিএম, ১৯ এপ্রিল ২০২০

ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর ও ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত ১৬ এপ্রিল একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানিয়েছে যে, সারাদেশ এখন করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিতে। এটি অবশ্য প্রত্যাশিতই ছিল। এর ফলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মুল) আইন, ২০১৮-এর বিধান অনুযায়ী আরও কঠোরভাবে চলমান লকডাউন বাস্তবায়নের ক্ষমতা পেল। পাশাপাশি বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে এর ফলে আরও নতুন নতুন প্রেক্ষাপট যুক্ত হতে যাচ্ছে যার অন্যতম হচ্ছে কোভিড-১৯ এর এই যে ‘টেস্ট, টেস্ট, টেস্ট’ পলিসি, এটি বাস্তবায়নে র্যাপিড টেস্ট কিট ব্যবহার করা উচিত কিনা।

এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশে SARS CoV-2-এর IgM ও IgG অ্যান্টিবডি শনাক্ত করার জন্য বেশ কিছু কিট তৈরি করা হয়েছে যার কোনো কোনোটি সেসব দেশের কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেয়েছে আর কিছু কিছু আছে অনুমোদনের অপেক্ষায়। কাজেই প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে SARS CoV-2 শনাক্তকরণ, নিয়ন্ত্রণ, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ আর রোগতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এই কিটগুলো কি ভূমিকা রাখবে। এই বিষয়গুলো বুঝতে হলে আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে SARS CoV-2 পজিটিভের ব্যাখ্যা কী? এই প্রশ্নের কোনো সোজা উত্তর নেই। এর মানে হতে পারে যে, যিনি পজিটিভ তিনি এই সেদিন বা বেশ কিছুদিন আগে ভাইরাসটি দ্বারা সংক্রমিত হয়েছেন। আবার এর মানে এও দাঁড়াতে পারে যে, ওই ব্যক্তি এই ভাইরাসটি দ্বারা এই মুহূর্তেও সংক্রমিত। লাখ টাকা দামের প্রশ্নটি হচ্ছে SARS CoV-2 পজিটিভ মানে ভাইরাসটির বিরুদ্ধে শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়া কিনা? মনে রাখতে হবে এর স্বপক্ষে এখন বিজ্ঞানীদের কাছে কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। কাজেই এই ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে যদি SARS CoV-2 র্যাপিড টেস্ট কিটগুলো বাজারে ছেড়ে দেয়া হয় তবে তার ফলাফলটা ভয়াবহ হতে পারে।

SARS CoV-2 ভাইরাসটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করার পর এটি এক ধরনের ‘বিপদ সংকেত’ দেয়, যার ফলে ইমিউনোসাইটগুলো আক্রান্ত ব্যক্তির ইনফেকশনের জায়গায় এবং পাশাপাশি লিমফেটিক সিসটেমে জড়ো হয় এবং সংখ্যায় বাড়তে থাকে। এই ইমিউনোসাইটগুলোর মূল কাজ হচ্ছে মানুষের শরীরকে রোগ সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা। এ সময় ভাইরাস, ভাইরাসের অ্যান্টিজেন আর মানুষের শরীরের ইমিউনোসাইট ও সাইটোকাইন-কেমোকাইনসহ বিভিন্ন ধরনের ইনফ্ল্যামেটরি মিডিয়েটরগুলোর মধ্যে কিছু রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটতে থাকে। এর ফলশ্রুতিতে শরীরে প্রথম ভাইরাসটির বিরুদ্ধে IgM ও পরে IgG অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে সাধারণত তিন থেকে ছয় সপ্তাহ সময় লাগে। তবে SARS CoV-2 ক্ষেত্রে ঠিক কতদিন সময় লাগে তা আমরা এখনও জানি না। তবে আমরা এখন ধরে নিতেই পারি যে বাংলাদেশে অনেক মানুষই এখন সম্ভবত SARS CoV-2 পজিটিভ, বিশেষ করে এই রোগে আক্রান্ত ৮০ ভাগেরও বেশি মানুষের যেহেতু রোগটির কোনো লক্ষণ থাকে না। আমরা কিন্তু এখনও জানি না SARS CoV-2 অ্যান্টিবডিটি এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ দেয় কিনা। বরং যদি এমনটি ধরে নেয়া হয় যে এটি তা দেয় না, সেক্ষেত্রে কিন্তু কোভিডের ‘পজিটিভ, নেগেটিভ এবং আবার পজিটিভের’ যে রহস্য তা সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়।

পাশাপাশি আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে আমাদের ভাইরোলজির জ্ঞান। যেমন মানুষের শরীরে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস ইনফেকশনের পর যে বেশকটি IgG অ্যান্টিবডি তৈরি হয় তার মধ্যে Anti-HBs IgG অ্যান্টিবডিটি শুধু ভাইরাসটির বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা দেয়। আর Anti-HBc IgG ও Anti-HBe IgG অ্যান্টিবডি দুটি ভাইরাসটির ইনফেকটিভিটি নির্দেশ করে। একই কথা প্রযোজ্য হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের Anti-HCV অ্যান্টিবডিটির ক্ষেত্রেও যা দিয়ে আমরা হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের ইনফেকশন আছে কিনা তা নির্ণয় করি, ভাইরাসটি প্রতিরোধের সক্ষমতা নয়।

এবার আসা যাক SARS CoV-2 IgM অ্যান্টিবডির বিষয়ে। শরীরে কোনো ভাইরাস প্রবেশ করার পর কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রথমে IgM এবং পরে IgG অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এ বিষয়ে জাপানের নোবেলবিজয়ী অধ্যাপক হনজোর যেমন প্রকাশনা আছে তেমনি প্রকাশনা আছে এই প্রবন্ধটির অন্যতম লেখক ডা. ফজলে আকবরেরও। কাজেই যদি আমরা কোনো র্যাপিড কিটের মাধ্যমে কোনো ভাইরাসের বিরুদ্ধে IgM অ্যান্টিবডি শনাক্ত করতে পারি, সেক্ষেত্রে আমরা অনায়াসেই পিসিআর ছাড়াই রোগটি নির্ণয় করতে পারব। তবে এর জন্য একটি পূর্বশর্ত আছে আর তা হলো ওই IgM অ্যান্টিবডিটির পরিমাণের সাথে ওই ভাইরাসটির RNA অথবা DNA-এর পরিমাণের কো-রিলেশন বা সহজ বাংলায় ‘পরিমাণগত সামঞ্জস্য’ থাকতে হবে। SARS CoV-2 একটি RNA ভাইরাস। সমস্যাটা হচ্ছে যে এখনও এই ভাইরাসটির IgM অ্যান্টিবডি এবং RNA-এর মধ্যে এ ধরনের সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। প্রথমে আমাদের ভাইরাসটির অ্যান্টিজেন এবং ওপেন রিডিং ফ্রেমগুলোকে ভালোভাবে জানতে-বুঝতে হবে এবং শুধুমাত্র তারপরই আমরা এই ভাইরাসটি শনাক্ত করার জন্য একটি কার্যকর র্যাপিড টেস্ট কিট তৈরি করতে পারব এবং এটাও মাথায় রাখতে হবে কোনো কোনো ভাইরাসের ক্ষেত্রে তেমনটি কখনোই সম্ভব নাও হতে পারে। যেমন হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের ক্ষেত্রে এখনও আমরা এটি করতে সমর্থ হইনি।

তাহলে প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে কেন এমনকি উন্নত বিশ্বের কোনো কোনো দেশেও SARS CoV-2-এর র্যাপিড টেস্ট কিট ব্যবহার করা হচ্ছে। উত্তরটা ছোট্ট এবং সহজ। সামাজিক বিস্তারের পর দেশে রোগ সংক্রমণের মাত্রা বুঝার জন্যই মূলত এটি ব্যবহার করা হচ্ছে। আর যদি এসব কিট SARS CoV-2 সংক্রমণ শনাক্ত করতে ব্যবহার করতেই হয় সেক্ষেত্রে দুটি ‘কিন্তু’ আছে। যাদের SARS CoV-2 IgG পজিটিভ আসবে, তাদের ইনফেকশনটি আছে কিনা তা আবার পিসিআর করে নিশ্চিত করতে হবে। একইভাবে রোগের লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও যাদের SARS CoV-2 IgM নেগেটিভ আসবে তাদের যে আসলেই রোগটি নেই সেটিও পিসিআরের মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে। কাজেই এই ধরনের টেস্ট কিট প্রচলনে আদৌ কোনো লাভ হবে কিনা না, সেটি লাখ টাকা দামের প্রশ্ন। বরং এতে যা হবে তা হলো এর ফলে এমনিতেই এ রোগ নিয়ে চারদিকে যত বিভ্রান্তি তাতে নতুন করে আরেকটি মাত্রা যোগ হবে মাত্র।

কাজেই সব কথার শেষ কথা এই যে, কোভিড-১৯ এর বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশে কোভিড নিয়ন্ত্রণে আমাদের আস্থার একমাত্র জায়গাটি হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এই রোগ নির্ণয়ের একমাত্র পদ্ধতিটি হলো পিসিআর আর রোগটি নির্মূলের একমাত্র কার্যকর অস্ত্র হলো শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা।

লেখকদ্বয়
ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর
রিসার্চার, এহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান।

ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল
চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/বিএ/এমএস