যুদ্ধের ময়দানে সৈনিক কি ছুটি নেয়?
সারা পৃথিবীতে নেমেছে বিপর্যয়। আতঙ্ক বিস্তৃত দেশে দেশে। টিভি, নিউজ পেপার, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সয়লাব হয়ে গেছে, শুধুই দুঃসংবাদ। যেন এক অদৃশ্য দাবানল পুড়িয়ে দিচ্ছে মানবসভ্যতা। প্রায় ৭০ হাজারের মতো মানুষ ইতোমধ্যে মারা গেছেন। সুসংবাদের জন্য মানুষ প্রতীক্ষায়- ভ্যাকসিন কিংবা কোনো ওষুধের জন্য দিশাহীন পৃথিবী। কিন্তু কোথাও যেন নেই কোনো কিছুই।
তবুও অদৃশ্য দাবানলকে জয় করতে মানুষ যুদ্ধে নেমেছে। এ যুদ্ধ জয়ে নেই কোনো অস্ত্র। বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন পাউন্ড-ডলারের পারমাণবিক সরঞ্জাম এ যুদ্ধে ব্যবহারের কোনো সুযোগই নেই বরং সারা পৃথিবীর মানুষকেই নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে লুকিয়ে থাকার, স্বেচ্ছাবন্দি অথবা স্বেচ্ছা নির্বাসন কিংবা সেলফ আইসোলেশন যা-ই বলি না কেন মানুষকে লুকাতে হচ্ছে, হতে হচ্ছে ঘরকুনো। জৌলুস, বৈভব আভিজাত্য সবকিছু ঠুনকো হয়ে গেছে। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছে কোভিড-১৯। এখন পর্যন্ত এ চ্যালেঞ্জের কাছে পরাজিতই থেকেছে মানবসভ্যতা।
পরাজয়ের মাঝেই আছে মানুষের বেঁচে থাকার অদম্য চেষ্টা। আছে মানবিক আকুতি আর আহ্বান। সভ্যতায় চিড় ধরানো পারমাণবিক শক্তির উল্লাসে যারা নৃত্য করে অহর্নিশ, তারাও আজ উদভ্রান্ত আকুল। চীন থেকে আমেরিকা, ইসরায়েল থেকে মক্কা অদৃশ্য দাবানল চিনিয়ে দিয়েছে নতুন মানবিকতা। মৃত্যু নিয়ে হলি খেলতেন যে বিশ্বনেতারা, সেই নেতাদের মুখেও এখন মানবিক আকুতি। নিজস্ব দেশ জাতি আর রাষ্ট্রকে বাঁচানোর প্রাণপন চেষ্টায় বিশ্ববিজয়ের পরিকল্পনা অপসৃত হয়েছে। কৃত্রিম নয়, তাদেরও হৃদয় নিংড়ানো উচ্চারণ, মানবিক চেতনায় এখন বিশ্বকে বাঁচাতেই উদগ্রীব তারা। যে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো ছিল আমেরকিা কিংবা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর চক্ষুশূল, সেই রাষ্ট্রগুলোও আসছে ইতালিতে কিংবা পশ্চিমা অন্যান্য দেশে। চীন-কিউবার দূরত্ব কমে গেছে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে। রাশিয়ার চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে ছুটছে বিশাল উড়োজাহাজ আমেরিকায়।
আসলেই বিশ্বটা এখন একটা গ্রাম। এই গ্রামেই লেগেছে দাবানল। অদৃশ্য এ দাবানলে ছাই হচ্ছে না কোনো কিছুই।পুড়ছে শুধু সভ্যতা। মরছে মানুষ, ছটফট করছে পাখির মতো। নিয়তির কাছে মানুষও হয়ে উঠেছে নির্মম। 'ইয়া নফসি' শব্দ দুটি বড় বেশি উচ্চারিত হয় মুসলিম সমাজে। শেষ বিচারের দিনে মানুষ না-কি নিজের কথাটাই শুধু ভাববে। কিন্তু আজ এই সভ্যতায় মানুষ নিজেকে নিয়েই ভাবতে হচ্ছে। স্বামী আক্রান্ত হলে মানবিকবোধ উড়ে যাচ্ছে। পালিয়ে বেড়াচ্ছে স্ত্রী, সন্তানদের ছেড়ে থাকতে হচ্ছে পিতার। শব সৎকারেও উপস্থিতি নেই মানুষের।
কী আশ্চর্য, বাংলাদেশের কোনো এক শহরের একটা জায়গায় এলাকাবাসী পোস্টারে লিখে রেখেছে, করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া চলবে না কিংবা এ রোগে কোনো মানুষকে কবর দেয়া যাবে না। শুধু তাই না, দেশটার অসংখ্য ক্লিনিক বন্ধ হয়ে গেছে। এই ডাক্তাররা না-কি গা ঢাকা দিয়েছে। মানবতাবাদী ডাক্তার ছাড়া ওই সকল ব্যবসায়ী ডাক্তাররা লুকিয়ে গেছে। অথচ এরাই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব আবেগ আর অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে কােটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতি বছর।
গ্রিসের চিকিৎসক হিপোক্রেটস শত শত বছর আগে চিকিৎসাসেবায় যে অসাধারণ অবদান রেখে গিয়েছিলেন, সেই 'ফাদার অব মেডিসিন'র নামে এখনও ডাক্তাররা শপথ নেয়, যেখানে নাগরিকদের সেবাটাই প্রধান ধর্ম হিসেবে উচ্চারণ করা হয়। এর অর্থ হলো নীতিগতভাবে তো বটেই, এমনকি কোনোভাবেই নাগরিকদের সেবা অস্বীকার করা যাবে না। আর তাই সেবাদান অস্বীকার করা এক ধরনের অপরাধ হিসেবেই পরিগণিত সারা পৃথিবীতে।
কিন্তু বাংলাদেশের অসংখ্য নির্দয় চিকিৎসকের কারণে গোটা চিকিৎসাব্যবস্থাকে প্রশ্নবোধক করে তুলছে তারা। আর তাই এ জায়গাটায় সরকারকে হাত দিতেই হবে। দেশের সংকটকালে সেবা না দেয়া ক্লিনিকগুলো বন্ধ করে দিতেই পারে সরকার। যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়া এই ব্রিটেনে কেউ সেবা দেয়া অস্বীকার করতে পারে না। রোগীর সাথে অশালীন ব্যবহার কিংবা অপরাধ করলে ব্রিটেনে চিকিৎসকের লাইসন্স কেড়ে নেয়ার উদাহরণ আছে একাধিক। এ রকম আইন বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করার সময় এসেছে এখন।
বিস্ময় নয়, এটাই বাস্তবতা যে, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের চিত্র ভিন্ন। মানবিকতায় জেগে উঠেছে বিশ্ব। উন্নত দেশগুলো তাদের জনগণের জন্য নিয়ে এসেছে নতুন নতুন প্যাকেজ। আক্রান্ত রোগীদের বাঁচাতে যেমন চিকিৎসা বিজ্ঞান নেমেছে যুদ্ধে। পৃথিবীর চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা থেমে নেই। মৃত্যুমুখে থেকেও কাজ করে যাচ্ছেন পৃথিবীর লাখ লাখ স্বাস্থ্যকর্মী। এ এক বিস্ময়কর মানবিকতা পৃথিবীজুড়ে।
ব্রিটেনের চিকিৎসাসেবা হলো এদেশের রাজনীতি আর সমাজে সবচেয়ে উচ্চারিত কথা। সরকারের সমালোচনায় এমনকি গত নির্বাচনেও ছিল ব্রিটেনের স্বাস্থ্যসেবা প্রসঙ্গ। চিকিৎসক কিংবা নার্স নিয়ে নাগরিকদের বড় কোনো সমালোচনা এমনিতেই ছিল না। ছিল সরকারের পদ্ধতিগত সমালোচনা। ব্রিটেনের স্বাস্থ্যখাতে পর্যাপ্ত ফান্ডিং ছিল না বলে এর ভবিষ্যৎ নিয়েই ছিল মানুষ শঙ্কিত। প্রাইভেটাইজেশনে চলে যাওয়ার শঙ্কা ছিল মানুষের মাঝে। কিন্তু কিছুই হয়নি। বরিস জনসনের সরকার ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) নিয়ে নাগরিকদের মতামতের বাইরে যাননি।
মাত্র দুমাস আগে ব্রিটেন ইউরোপ থেকে বেরিয়ে আসার বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। এরই মাঝে এসেছে করোনা, রাষ্ট্রীয় অগ্রগতিতে এসেছে বড় ধরনের ধস। কিন্তু এ ধস থামাতে সরকারের চেষ্টা নাগরিকদের শুধু স্বস্তিই দিচ্ছে না, নাগরিকরা সরকারকে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। সমালোচনা নেই বললেই চলে। বিরোধী দল মাঝে মাঝে কিছু কথা বললেও সমালোচনা নাগরিকদের মনোবল ভেঙে যাচ্ছে না। সচেতনভাবেই বিরোধী দলের সমালোচনাগুলো নিচুস্বরেই উচ্চারিত হচ্ছে। সহযোগতিা করে যাচ্ছে সব কিছুতেই।
বিভীষিকাময় পরিস্থিতি যুক্তরাজ্যে। মৃত্যু বাড়ছে প্রতিদিন। দীর্ঘশ্বাস প্রলম্বিত হচ্ছে। স্বজন-সজ্জনদের হাহাকারে বাতাস ভারী। কিন্তু দেশটার স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে নেই যেন কোনো অভিযোগ। নার্স-ডাক্তাররা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, কিন্তু তবুও সেবা দিয়ে যাচ্ছে নিরন্তর। ইতালি-স্পেন-আমেরিকা সবখানেই মানুষ ডাক্তার-নার্সদের নিয়ে গর্ব করছে।উন্নত দেশগুলোও তাদের সাধ্যের মাঝে রাখতে পারছে না অনেক কিছুই। সে জন্য ইতালি বাইরের দেশের সহযোগিতা নিচ্ছে। সরকার হিমশিম খাচ্ছে। পদ্ধতি নিয়ে সে দেশগুলোতে সমালোচনা আছে হয়তো, কিন্তু সেবা নিয়ে নাগরিকদের কোনোই অভিযোগ নেই বরং এদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা চিকিৎসক-নার্সদের কাছে কৃতজ্ঞ।
সরকারের এই টানাপোড়নের মাঝে ব্রিটেনের সরকার নিয়েছে আরেক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস নিয়ে ব্রিটেনের জনগণ প্রতিবাদী ছিল দির্ঘদিন থেকেই। সরকার থেকে প্রয়োজনীয় অনুদান ছিল না বলে সার্ভিস নিয়ে সমালোচনা ছিল প্রতিনিয়ত। বিভিন্নভাবে ঋণে জর্জরিত এই প্রতিষ্ঠানে ঋণের বোঝা নিয়েই সার্ভিস অব্যাহত রেখেছিল। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবে এনইচএস যাতে দুর্বল হয়ে না পড়ে, তার জন্য নতুন ফান্ডিংই শুধু দেচ্ছে না সরকার বরং ১৩.৪ বিলিয়ন পাউন্ড ঋণ মওকুফ করে দিয়েছে। এনএইচএস এখন আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। কাটিয়ে উঠছে সকল শঙ্কা।
শুধু তাই না, ব্রিটেনে স্বেচ্ছাসেবকরা দলে দলে কাজ করছে। সরকার চেয়েছিল আড়াই লক্ষ স্বেচ্ছাসেবক, নাম লিখিয়েছে ছয় লক্ষাধিক মানুষ। এ এক অদ্ভূত শিহরণ জাগানিয়া বন্ধন মানুষের প্রতি মানুষের। অবসরে যাওয়া এনএইচএস কর্মীরা সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইতোমধ্যে প্রায় দুই হাজার কর্মী যোগ দিয়েছেন কাজে, শুধু এই সংকটকালে।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অনেক ব্রিটিশ ডাক্তার কাজ করছেন এই সময়ে। তাহসিন চৌধুরী, তাদের মাঝেই একজন তরুণ ডাক্তার। এ ডাক্তারকে আমিও খুব ভালোভাবেই জানি, আমার এক বন্ধুর ছেলে। তিনি তাকে বড় করিয়েছেন বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি জানিয়ে। ছেলেটা কাজ করছে রাতদিন। এমনকি নির্ধারিত ছুটির দিনেও সে কাজে যাচ্ছে। বাপতো বলেছিলেন, ছুটি নেয়া যায় না? ছেলেটা উত্তর দিয়েছিল, দেশপ্রেমের কথা তুমিই তো বলো! যুদ্ধের ময়দানে সৈনিক কি ছুটি নেয়? টেলিফোনে যখন এ কথাটি বললেন, তখন তার বাপের সাথে আমিও হয়েছি আবেগপ্রবণ।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৮টায় সারা ব্রিটেনের মানুষ একসাথে বের হয়। দেশটির চিকিৎসক-নার্স তথা এনএইচএস ওয়ার্কারের জন্য রাষ্ট্রীয় কৃতজ্ঞতার উৎসব হচ্ছে প্রতি বৃহস্পতিবার কিছু সময়। গত বৃহস্পতিবার যখন আমাদের পাঁচ সদস্যের পরিবারের সবাই বেরিয়েছি সংহতি জানাতে, দেখি প্রতিবেশী যুবক-প্রবীণরা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে করতালিতে মুখর করে তুলেছে আমাদের স্ট্রিট।
এশিয়ান আরও দু-একটি পরিবার বাইরে, ১০ বছরের কিশোর ছেলেটি যখন তার হাতের খেলনা নিয়ে বাজাতে থাকল, টুং টাং শব্দে তৈরি হলো সঙ্গীতের আবহ। সন্ধ্যার আবছা আলোয় মনে হলো, এ যেন বিষাদের মাঝেও বাজছে আনন্দের সঙ্গীত। সবাই হাত নাড়ছে একে অপরের প্রতি। ব্রিটেনের প্রতিটি কোনায় কোনায় এভাবেই বেজে উঠছে কৃতজ্ঞতার বাদ্য।
এইচআর/বিএ/পিআর