ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

গাইয়া’র প্রতিশোধ

নাসরীন মুস্তাফা | প্রকাশিত: ১০:০৮ এএম, ০৫ এপ্রিল ২০২০

গাইয়া প্রতিশোধ নিচ্ছে। জেমস লাভলক লিখেছিলেন ‘দ্য রিভেঞ্জ অব গাইয়া: হোয়াই দ্য আর্থ ইজ ফাইটিং ব্যাক - অ্যান্ড হাউ উই ক্যান স্টিল হ্যাভ হিউম্যানিটি’ নামের একটি বই। ২০০৬ সালে প্রকাশিত বইটি পৃথিবীর জলবায়ুজনিত সমস্যা এবং মানবতার ভাগ্যে কী আছে, তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী পাঠকদের ভাবতে বাধ্য করছিল। এই যে দিনকে দিন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হচ্ছে, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে, গভীর সমুদ্র থেকে এতকাল পেয়ে আসা পুষ্টির জোগানে টান পড়ছে। মানুষের তৈরি করা কারণে জলবায়ুর এই বিপর্যয়ের ফলে পৃথিবীর কি কিছুই করার নেই?

পৃথিবী প্রতিশোধ নিতে পারে। এই চিন্তা থেকেই জন্ম নেয় ‘গাইয়া তত্ত্ব’। পৃথিবীতে জৈবসত্তা এর পারিপার্শ্বিক অজৈব উপাদানের সাথে সম্পৃক্ত থেকে এই গ্রহটিতে জীবনকে টিকিয়ে রাখতে সাম্যাবস্থা বজায় রাখতে সাহায্য করে। গ্রিক পৌরানিকে গাইয়া হচ্ছে পৃথিবীর দেবী। জীবনকে টিকিয়ে রাখার জন্য সাম্যাবস্থা বজায় রাখাই গাইয়ার কাজ। এই কাজে বাগড়া দেয়াতেই তো পৃথিবীর অবস্থা বেহাল হচ্ছে। গাইয়া দেবী রেগে গিয়ে প্রতিশোধ নিতে চাইতেই পারেন। আরেকভাবে ভাবা যায়। মাটি-পাহাড়-সমুদ্র-নদী-বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর এক একটি অঙ্গ। গাইয়া আসলে পৃথিবীই, যেকোনো জীবন্তসত্তার মতো জীবন্ত। প্রতিশোধ নেয়া জীবন্তসত্তার জন্য স্বাভাবিক, তাই না?

রসায়নবিদ জেমস লাভলক মাইক্রোবায়োলজিস্ট লিন মারগুলিসকে সাথে নিয়ে ১৯৭০ সালে এই তত্ত্ব দাঁড় করান। পৃথিবী, অর্থাৎ গাইয়া সত্যিই প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে, তার উপযুক্ত প্রমাণ দেখাতে পারেননি, কেবল ধারণা দিয়েই যা বলার বলছেন, এমন প্রশ্ন তুলে বিজ্ঞানীমহল থেকে এর জন্য প্রচুর সমালোচনা জুটেছে। এরপরও, ১৯৮৫ সালে প্রথমবারের মতো ‘পৃথিবী কি একটি জীবন্তসত্তা?’ এই প্রশ্ন তুলে ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা হয়। এরপর এরকম ‘গাইয়া সমাবেশ’ আরও হয়েছে।

২০০৯ সালে জেমস লাভলক লিখলেন ‘দ্য ভ্যানিশিং ফেস অব গাইয়া: আ ফাইনাল ওয়ার্নিং’। মানবসভ্যতা হচ্ছে ‘পৃথিবীর অসুখ’। কথা পরিষ্কার। মানুষ, অর্থাৎ আমরা, আমি ভাইরাস মাত্র, পৃথিবীর অসুখ বাঁধিয়েছি। পলিসাইথেমিয়া নামে মানুষের এক অসুখ হয়। লাল রক্তকণিকার পরিমাণ বেড়ে যায় তখন। লাভলক বলছেন, গাইয়ার নাকি এই রকমের অসুখ হয়েছে। মানুষ এত বেশি বেড়ে গেছে, যা পৃথিবীর ভালো করতে পারছে না। গ্রিনহাউজ গ্যাস তৈরি করে পৃথিবী মানুষকেই বিপদে ফেলতে চাইছে। মানুষকে দ্রুত বদলে যাওয়া পৃথিবীতে বাস করা শিখতে হবে (অভ্যাস বদলাতে হবে), নয়তো ছেড়ে দিতে হবে জায়গা।

কোভিড-১৯ ভাইরাসে গোটাবিশ্ব মৃত্যুর প্রহর গুনছে যখন, তখন এই প্রশ্নটা সামনে এসেছে আবার। গাইয়া কি সত্যিই প্রতিশোধ নিচ্ছে? মানুষকে ঘরবন্দি করে ফেলে গাইয়া তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে আবারও সজীব করে তুলছে। নির্মল আকাশ হাসছে। সমুদ্রসৈকতে নেমে এসেছে ডলফিনের দল। করোনা-তাণ্ডবের পর নিয়ন্ত্রিত সংখ্যক মানুষ বাঁচবে, যারা নিজস্ব শারীরিক সক্ষমতায় বাঁচতে পেরেছে। বেঁচে যাওয়া মানুষরা নিশ্চয় চরম শিক্ষা নিয়ে বাঁচতে শিখবে। গাইয়ার সাম্যাবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে চলার শিক্ষা রেখে যাবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। বহুকাল পর এই শিক্ষাই হয়তো রূপ নেবে ধর্মের। সেই ধর্মের অনুশাসনে স্পষ্ট করে বলা থাকবে, পরিবেশের যেকোনো ক্ষতির শান্তি ভয়াবহ। এই শাস্তি মৃত্যুর পর দেয়া হয় না। এই শাস্তি নেমে আসে যেকোনো সময়।

কী আশ্চর্য! পোপ ফ্রান্সিসের সহযোগী লিওনার্দো বফ একই রকমভাবে দাবি করছেন, করোনা মহামারি ঘটাচ্ছে স্রেফ পৃথিবীকে দূষিত করার পাপের শাস্তি হিসেবে। ব্রাজিলের ম্যাগাজিন ‘আ টেরা এ রেডোন্ডা’ (দ্য আর্থ ইজ রাউন্ড) লিওনার্দো বফের একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে, যেখানে তিনি জেমস লাভলকের ‘গাইয়া তত্ত্ব’ কেন এতকাল গুরুত্বের সাথে নেয়া হয়নি, তা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা ভাইরাস, সার্স, ইবোলা, হাম, করোনাভাইরাস এবং বিশ্বব্যাপী অধঃপতিত মানুষের সম্পর্ক চিহ্নিত হচ্ছে সামাজিক ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি আর বৈষম্যের মাধ্যমে এবং ন্যূনতম ঐক্যের অভাবে, যা গাইয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছে বলেই সে প্রতিশোধ নিচ্ছে।’ লিওনার্দো বফ মনে করেন, দূষণ পৃথিবীর যেসব জায়গায় বেশি, সেখানেই করোনাভাইরাস বেশি আঘাত হানবে। প্রকৃতি-মায়ের যত্ন নিতেই হবে। তার দরকার নেই আমাদের। কিন্তু আমাদের দরকার তাকে।

করোনাভাইরাসের কারণে বায়ুদূষণ কমে গেছে দারুণহারে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন কমে গেছে। না কমে উপায় নেই, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শিল্পসমৃদ্ধ বলে বায়ুদূষণকারী দেশগুলোই তো চরমভাবে আক্রান্ত। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের হিসাব মতে, তিন সপ্তাহ অবরুদ্ধ থাকাতে বায়ুমণ্ডলে যে পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কমেছে, তা গোটা নিউইয়র্ক শহরের পুরো বছরের বায়ুদূষণের সমান। প্রকৃতিকে টিকতে হলে তিনটি মূল কারণকে দূর করতে হবে- সম্পদের অতিরিক্ত ব্যবহার, দূষণ এবং সামরিকীকরণ। খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রকৃতি মানুষের স্বভাব বদলে দিয়ে এই তিনটি কারণকে বাগে এনে ফেলেছে। বিমানভ্রমণ, শপিংমলে কেনাকাটা, শেয়ারের দাম বাড়াবাড়ি নিয়ে বাড়াবাড়ি উদ্বেগ, জীবিকার পেছনে অহেতুক ছোটাছুটি, পরকীয়া ইত্যাকার সব ‘ভোগবাদী’ অভ্যাস ফেলে মানুষকে ঘরে ফিরতে হলো, ফিরতে হলো আপনজনের কাছে, থাকতে হলো ঘরে। বিশ্বের শক্তিধর যুদ্ধবাজ পক্ষ পর্যন্ত হাতে গ্লাভস আর মুখে মাস্ক লাগিয়ে চুপ করে বসে আছে, কেননা মধ্যপ্রাচ্যের তেল নিয়ে কাড়াকাড়ি, যুদ্ধ, মানুষকে অভিবাসী বানানোর খেলায় টান পড়ে গেল হঠাৎ।

গাইয়া প্রতিশোধ নিচ্ছে, এ থেকে মানুষ শিখবে কিছু? গাইয়া এর আগেও প্রতিশোধ নিয়েছে মানুষের ওপর। মানুষ শেখেনি। পাথরযুগ পেরিয়ে আসার পর হোমো সেপিয়েন্সে বদলে যাওয়া মানবজাতি এর আগেও বহুবার গাইয়ার প্রতিশোধের মুখে পড়েছিল। তবে জনসংখ্যা ২৫ কোটি পর্যন্ত স্থির থাকা পর্যন্ত পৃথিবী সম্পদের টানাটানি নিয়ে ভাবেনি। শিকারী সভ্যতার পর মানুষ কৃষিসভ্যতা গড়ে তুললে ১০০০ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ- এই ৩০০ বছরের মধ্যে ইউরোপের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেল। চতুর্দশ শতকে এসে ইউরোপ মুখোমুখি হয়েছিল ‘ব্ল্যাক ডেথ’-এর। সেবারও চীন থেকে যাত্রা শুরু করা মহামারি ইতালি, স্পেন, বৃটেন এবং রাশিয়া ঘুরেছিল। তিন বছর তাণ্ডব চালিয়ে পশ্চিম ইউরোপের জনসংখ্যার শতকরা ষাট ভাগ নিকেশ করেছিল মৃত্যুর ঝড়। ১৩৪৭ সালে বেঁচে থাকা আট কোটি মানুষের মাঝ থেকে মাত্র তিন কোটি মানুষ ১৩৫০ সালকে চোখে দেখতে পেয়েছিল।

এরপর এলো ১৬৬৫ সালে শুরু হওয়া ‘গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন’, যা জনসংখ্যার শতকরা ১৫ ভাগকে কমিয়ে দিয়েছিল। শিল্পবিপ্লব শুরু হওয়ায় ১৬০০ সাল থেকে বিশ্বের জনসংখ্যা বাড়ছিল। ১৯২০ সাল নাগাদ পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল ২০০ কোটি, যা ১৯৬০ সালে তার তিনগুণ হয়ে ৬০০ কোটি এবং ১৯৮০ সালে এসে ৮০০ কোটির ঘরে পৌঁছায়। বুঝতেই পারছেন, পৃথিবীর ভার বহনের যে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত ক্ষমতা, তা থেকে ষোলগুণ বেশি হয়ে যায়।

২০১৩ সালে হলিউডের বিখ্যাত চিত্রপরিচালক স্যার ডেভিড অ্যাটানবরো এক লেখায় ২০৭০ সাল নাগাদ পৃথিবীর জনসংখ্যা ৯০০ কোটিতে পৌঁছানোর ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ‘মানুষ পৃথিবীর প্লেগ রোগ’- এভাবেই লিখেছিলেন তিনি। তিনি ভয়ে ভয়ে তার ধারণাকে প্রকাশ করে লিখেছিলেন, ‘হয় আমরা জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে নিজেরাই সীমিত করব নয়তো প্রকৃতি আমাদের হয়ে তা করে দেবে।’ না করে উপায় কী? পৃথিবীর সম্পদ তো সীমিত। এ কথা আমরা ভুলে গেলেও পৃথিবী মানে গাইয়া ভোলে না।

এবারের করোনাভাইরাস আক্রমণের ভয়াবহতায় প্রশ্ন উঠেছে, মানুষ ছাড়াই কি পৃথিবী বেশি ভালো থাকবে? সত্যি বলতে কি, স্বেচ্ছায় মানবজাতিকে ধ্বংস হতে দেয়ার পক্ষে স্বেচ্ছাসেবীদের ভিড়ও বাড়ছে। এদের স্লোগান কী, জানেন? আসুন আমরাই হই পৃথিবীর শেষ মানুষ প্রজন্ম, চলুন বেরিয়ে পড়ি করোনা-রাজ্যে আর আনন্দ-উৎসব করি।

কঠোর নির্দেশ দেয়া সত্ত্বেও যারা ঘরের বাইরে যাচ্ছেন, তাদের কথা মাথায় আনতে চাচ্ছি না। তবে এদের যুক্তি কিন্তু দারুণ। মানুষ না থাকলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল আবার ঠিক হয়ে যাবে। পৃথিবী নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারবে, শুরু করতে পারবে নতুন যাত্রা। সেই যাত্রার সাক্ষী হবে হয়তো অন্যরা। ডাইনোসর চলে যাওয়ার পর মানুষ ছিল, মানুষের পর অন্যরা আসবে।

এসব নিয়ে আরও বেশি ভাবতে চাইলে অ্যালান উয়েজমানের লেখা ‘দ্য ওয়ার্ল্ড উইদাউট আস’ পড়তে পারেন। করোনাভাইরাসের ভয়ে গৃহবন্দি থাকা অবস্থায় বই পড়া হতে পারে চমৎকার বিনোদন।

এইচআর/বিএ/পিআর