করোনা, আইইডিসিআর ও টিপিক্যাল বাঙালি
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মানুষ আইইডিসিআরের সংবাদ সম্মেলনে প্রতিদিনই হতাশ হচ্ছে। সংস্থাটি পরপর দুদিন যখন জানালো যে, দেশে নতুন করে কোনো করোনভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়নি- তাতে অনেকেরই হয়তো মন খারাপ হয়েছে। মানুষ হয়তো প্রত্যাশা করে, ইতালি, স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশেও প্রতিদিন হাজার হাজার রোগী শনাক্ত হবে এবং শত শত লোকের মৃত্যু হবে!
এ রকম পরিস্থিতি তৈরির পেছনে প্রধানত দুটি কারণ দায়ী; ১. বাঙালির টিপিক্যাল চরিত্র এবং ২. রাষ্ট্রীয় বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা। এই আস্থাহীনতা অবশ্য একদিন তৈরি হয়নি। অতীতের নানা কর্মকাণ্ড ও ঘটনায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিতর্কিত হয়েছে। তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ফলে এখন এসব প্রতিষ্ঠান সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য দিলেও অনেকেই তা সন্দেহের চোখে দেখে। অবিশ্বাস করে।
প্রশ্ন হলো, আইইডিডিসআর প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলনে যেসব তথ্য দিচ্ছে, সেগুলো যদি কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ধরা যাক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এদেশীয় প্রতিনিধিরা দিতেন, তাহলে কি সেগুলো মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতো বা মানুষ কি তখন ওইসব তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন তুলতো?
২. একজন সাংবাদিক ফেসবুকে লিখেছেন, তার ক্যান্সার আক্রান্ত মায়ের সপ্তম কেমোর দিন নির্ধারিত ছিল ৩১ মার্চ। কিন্তু ২৯ তারিখ তাকে ক্যান্সার হাসপাতাল থেকে ফোন করে না যেতে বলা হয়েছে। বাস্তবতা হলো, করোনা আতঙ্ক শুরুর পর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলো প্রায় ডাক্তারশূন্য হয়ে যায়। কোনো রোগী জ্বর বা সর্দি কাশি থাকলে তাকে দেখেই ডাক্তারদের পালিয়ে যাওয়ার খবরও এসেছে। অবশ্য এর যৌক্তিক কারণও আছে। ডাক্তার ও নার্সদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা নেই। সরকারের তরফে যে ধরনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল না, তা করা হয়নি। অথচ স্বাস্থ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন, চিকিৎসকদের জন্য পর্যাপ্ত পিপিইর ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদি তাই হয়, তাহলে হাসপাতালে ডাক্তার থাকবেন না কেন এবং কেন একজন রোগীর স্বজনকে ফোন করে হাসপাতালে যেতে বারণ করা হবে? শুভঙ্করের ফাঁকিটা কোথায়? এখানে সরকারের প্রস্তুতির সমস্যা নাকি সুযোগ পেলেই কাজ ফাঁকি দেয়ার যে বাঙালির চিরাচরিত অভ্যাস- করোনার দোহাই দিয়ে একটি শ্রেণি তার সুযোগ নিচ্ছে?
জাগো নিউজের একটি খবরে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস আতঙ্কে রাতে তো দূরের কথা দিনের বেলায়ও অনেক চিকিৎসক পারতপক্ষে চেম্বারে আসছেন না। হাসপাতালে কোনো রোগী এলে তাকেও নানা প্রশ্ন ও জেরার মুখে পড়তে হচ্ছে। প্রবেশপথে রোগী ও তার সঙ্গে আসা অভিভাবককে বিদেশ থেকে এসেছেন কি-না, জ্বর, হাঁচি-কাশি ও শ্বাসকষ্ট আছে কি-না, ইত্যাদি প্রশ্ন করে সন্তোষজনক জবাব পেলে তবেই প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে।
প্রশ্ন উঠেছে, জ্বর-সর্দি কাশির বাইরে অন্যান্য যেসব রোগীকে নিয়মিত হাসপাতালে যেতে হয়, চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হয়, তারা কী করবেন? তারা কোথায় যাবেন? যে বয়স্ক মানুষের আগে থেকেই হাঁপানি, কিডনি বা হার্টের অসুখ রয়েছে, তিনি জরুরি প্রয়োজনে কোথায় যাবেন? যদি কেউ এখন কোনো দুর্ঘটনায় আহত হন, তিনি কোনো হাসপাতালে গিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাবেন? সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই বলে চিকিৎসকরা হাসপাতালে থাকবেন না এটা যেমন বাস্তবতা, তেমনি দুর্যোগে মানুষের পাশে ধাকা, অসুস্থ রোগীকে সারিয়ে তুলতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করাও চিকিৎসকের দায়িত্ব। কিন্তু করোনা আতঙ্ক কি চিকিৎসকদের সেই ন্যূনতম দায়িত্ববোধটুকুও ভুলিয়ে দিয়েছে?
৩. করোনার উপসর্গ থাকায় চিকিৎসা না পেয়ে এরইমধ্যে একাধিক লোকের মৃত্যুর খবর এসেছে। অথচ তারা আদৌ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন কি না তা পরীক্ষিত নয়। নওগাঁর একজন যুবক জ্বর-সর্দি নিয়ে একাধিক হাসপাতালে ছুটেছেন। কিন্তু চিকিৎসা পাননি। অবশেষে মৃত্যুর কাছেই হার মেনেছেন। বিনা চিকিৎসায় যদি একজন নাগরিকেরও মৃত্যু হয়, রাষ্ট্র কি তার দায় এড়াতে পারে? করোনার দোহাই দিয়ে কি মানবিকতা আর দায়িত্ব এড়ানো যায়? যে লোকগুলো আসলেই বিনা চিকিৎসায় মারা গেল, তাদের পরিবারকে রাষ্ট্র কী দেবে? রাষ্ট্র কি আদৌ নাগরিকের কাছে জবাবদিহি করে?
৪. এই দুর্যোগেও বাঙালির টিপিক্যাল চরিত্র গোপন থাকছে না। গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে দুবাই থেকে আসা এক প্রবাসীর তথ্য পুলিশকে দেয়ার অভিযোগে গৃহবধূর ওপর হামলা হয়েছে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর স্বামী থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন।
৫. করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের বিনামূল্যে চিকিৎসার জন্য রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকায় একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল আকিজ গ্রুপ। কিন্তু সেখানে বাধা দিয়েছেন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর। স্থানীয় কিছু লোক সেখানে গিয়ে ভাঙচুরও করেছে। গণমাধ্যমে সেই ভাঙচুরের ছবি এসেছে। যদিও শেষমেষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের হস্তক্ষেপে হাসপাতালটি নির্মাণের কাজ শুরু হয়। খবরে বলা হচ্ছে, স্থানীয় লোকজন এই হাসপাতাল থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় এটি নির্মাণে বাধা দিয়েছে। আবার এমন অভিযোগও উঠেছে যে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি আকিজ গ্রুপের কাছে চাঁদা চেয়েছিলেন। যখন মানুষ মরে যাচ্ছে, যখন কেউ করোনায় আক্রান্তদের পাশে দাঁড়াতেও ভয় পাচ্ছে, সে রকম একটি ভয়াবহ সময়ে একটি ভালো উদ্যোগ থামাতেও আমাদের কত আয়োজন!
৬. বলা যায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার অব্যাহত চাপের মুখে সরকার সারাদেশে লকডাউন ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু সেখানেও ছিল শব্দের মারপ্যাঁচ। ঘোষণা করা হলো সাধারণ ছুটি। সেই সুযোগে মানুষও ছুটির আমেজে ঢাকা ছাড়তে উদগ্রীব। হাজার হাজার মানুষ গিয়ে ভিড় করলো কমলাপুর রেলস্টেশনে। অথচ এই ছুটির মূল উদ্দেশ্য ছিল লকডাউন করা অর্থাৎ সবকিছু বিচ্ছিন্ন করা যাতে মানুষ ঘরের বাইরে বের না হয়। অথচ হলো উল্টো। কমলাপুর রেলস্টেশনে ঈদের আগ মুহূর্তের দৃশ্য নেমে এলো।
ওই হাজারো মানুষের মধ্যে একজনও যদি করোনায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে এরইমধ্যে কত লোকের মধ্যে তা ছড়িয়েছে এবং এই যে দলে দলে মানুষজন ঢাকা ছাড়তে উদ্যত হলো, তারা যে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লো তাতে কত হাজার মানুষ নিজেদের এবং সারাদেশের জন্য ঝুঁকি তৈরি করলেন? পরিস্থিতি আরও করুণ হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে, সেই বোধটুকু বাঙালির হলো না। এটা যে ছুটির বিষয় নয়, বরং নিরাপত্তার খাতিরে ঘরে থাকার নির্দেশনা- মানুষ সেটি বুঝলো না।
সরকারও বিষয়টি পরিষ্কার করলো না। এখানে প্রশ্ন উঠেছে, ঢাকায় যে নিম্নবিত্ত মানুষেরা থাকেন, তাদের যদি কাজ না থাকে, তাহলে এই লকডাউনের সময়ে এই শহরে তারা থেকে কী করবেন, কী খাবেন? সুতরাং তারা আপাতত গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়াটাকেই নিরাপদ বোধ করলেন। কিন্তু সরকারের তরফে এক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার প্রয়োজন ছিল যে, সবাই যে যার জায়গায় থাকবেন এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ন্যূনতম খাদ্যপণ্য সরবরাহ করা হবে; সকল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিকদের এই ঘোষণা দেয়া উচিত ছিল যে, সবাই ঘরে থাকুন, কিন্তু সময়মতো বেতন পাবেন। সেটি হলে বোধ হয় কমলাপুরে মানুষের স্রোত বাঁধ ভেঙে পড়তো না। আবারও এও ঠিক, অসংখ্য মানুষ এখনও করোনাভাইরাসকে সেভাবে আমলে নিচ্ছে না। তারা ধরেই নিয়েছে এতে কিছু হবে না। ফলে যে যার মতো ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা করছে। যে কারণে দেখা গেল, শিশুদের নিরাপত্তা বিবেচনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হলেও অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নিয়ে সমুদ্রসৈকতে গেছেন অবসর কাটাতে। কী ভয়াবহ কাণ্ডজ্ঞান!
৭. কাণ্ডজ্ঞানের ভয়াবহতা দেখিয়েছেন বিদেশফেরত লোকজনও। যে ইতালি সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত, সেখান থেকে দলে দলে প্রবাসীরা এসে কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম না মেনে সোজা চলে গেছেন প্রিয়জনের কাছে। মিশেছেন অসংখ্য মানুষের সাথে। শুধু তাই নয়, এই ভয়াবহ দুর্যোগকালেও ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’র (গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের বিখ্যাত উপন্যাস) মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েকে বিয়ে করতে গিয়ে ধরাও খেয়েছেন। কী ভয়াবহ কাণ্ডজ্ঞান! প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠান; দেশের অর্থনীতিতে তাদের অবদানের কথা সবাই স্বীকার করেন। কিন্তু বিমানবন্দরে নামার পর তাদের কোয়ারেন্টাইনে নেয়ার সময় তাদের মধ্যে কোনো কোনো প্রবাসীর আচরণ এবং রেমিটেন্স পাঠানোর যে গরম দেখা গেল, তা শুধু দুর্ভাগ্যজনকই নয়, বরং হাস্যকরও।
৮. বাঙালির আরেক টিপিক্যাল ক্যারেক্টারের নাম ভানু। এই কৌতুক অভিনেতার একটি গল্প আছে: দেখি না কী করে...। অর্থাৎ চোর বাড়িতে ঢোকার পর তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে চোর কী করে তা দেখার নাম হচ্ছে ‘দেখি না কী করে’। এবার করোনাভাইরাসে বিশ্ব অচল হওয়ার পর প্রস্তুতি নেয়ার জন্য একমাসেরও বেশি সময় পেয়েছে আমাদের সরকার। কিন্তু তাদের ভাবখানা ছিল ভানুর সেই কৌতুকের মতো- দেখি না কী করে। অর্থাৎ দেখি না কতজন আক্রান্ত হয়, দেখি না কতজন মরে। যে কারণে তথাকথিত মানবিকতা দেখানোর জন্য লাখ লাখ প্রবাসীর জন্য বিমানবন্দর উন্মুক্ত রাখা হলো। যে ইতালি সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত, সেই দেশ থেকে দলে দলে মানুষ এলো বাংলাদেশে। বিমানবন্দরে যে ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। উপরন্তু বিমানবন্দরে দায়িত্বে তাকা অনেক সরকারি কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য কোয়ারেন্টাইনের ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়েছে, এমন কথাও গোপন থাকেনি। একটা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দুর্যোগের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এমন উদাসীনতা বোধ হয় বাঙালির দ্বারাই সম্ভব।
৯. প্রথম যেদিন তিনজন করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংবাদ বলা হলো, সেই খবর গণমাধ্যমে চাউর হওয়ার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে কোনো ফার্মেসিতে গিয়ে স্যানিটাইজার পাওয়া যায়নি। ২০ টাকার মাস্ক বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকায়। এরপর আতঙ্ক যখন আরও বাড়লো, দেড় হাজার টাকার চালের বস্তা আড়াই হাজার টাকা, ২০ টাকার আলু ৪০ টাকা, ৪০ টাকার পেঁয়াজ ৮০ টাকা-এ রকম দেড়গুণ-দ্বিগুণ দামে বিক্রি হয়েছে। বিষয়টা এ রকম যে, যখন তিনজন করোনায় আক্রান্ত হওযার খবর পাওয়া গেল, তখন স্যানিটাইজার ও মাস্ক বিক্রেতার পোয়াবারো; যখন আরও তিনজন আক্রান্ত হলেন তখন খাদ্যপণ্য ব্যবসায়ীর পোয়াবারো। অথচ এই একই সময়ে আমরা সভ্য দেশের মানুষের এমন আচরণের কথাও সংবাদমাধ্যমে পড়েছি যে, মাস্ক ও স্যানিটাইজারের সংকট তৈরির ফলে অনেক ব্যবসায়ী বিনামূল্যে স্যানিটাইজার বিতরণ করেছেন। দোকানের সামনে রেখে দিয়েছেন যার লাগে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
১০. লন্ডনপ্রবাসী বিবিসির সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ব্রিটিশ সুপারমার্কেটগুলোয় দোকান খোলার নির্ধারিত সময়ের আধা ঘণ্টা আগে ডাক্তার ও নার্সের মতো কর্মীরা গিয়ে জিনিসপত্র কিনতে পারবেন। এই দোকানগুলো চেষ্টা করে যাচ্ছে সাধারণ মানুষকেও চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের জোগান দিয়ে যেতে। চাহিদা এত প্রচণ্ড তারপরও তারা কোনো পণ্যের দাম একটি পয়সাও বাড়ায়নি। কিন্তু সেই লন্ডনেই মুসলিম দোকানদারার করোনাভাইরাস আতঙ্ক পুঁজি করে মুনাফা লাভের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। বোকা বাঙালির কাছে তিন পাউন্ডের মুরগি বিক্রি করেছে ২০ পাউন্ড। সাত পাউন্ডের আটা ১২ পাউন্ড। প্রায় প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য তারা দুই এক পাউন্ড করে বাড়িয়ে দিয়েছে।
অমুসলিম বিক্রেতারা ক্রিসমাসের সময় পণ্যের দাম কমায়। কিন্তু মুসলমান দোকানদাররা রোজার সময় দাম বাড়ায়। অমুসলিমরা বিপদের সময় সাহায্যের হাত বাড়ায়। কিন্তু মুসলমানরা সুযোগ নেয়। এবার করোনা পরিস্থিতির কালে ইংল্যান্ডে ম্যাকলারেন নামের একটি গাড়ির কোম্পানি গাড়ি বানানো বন্ধ করে এখন ভেন্টিলেটর তৈরি করছে হাসপাতালের জন্য। আর কয়েকটি অ্যালকোহল কোম্পানি মদ তৈরি বন্ধ করে উৎপাদন করছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। অথচ এই আচরণগুলো হওয়ার কথা ছিল মুসলমানের। কিন্তু আমরা মহানবীর আদর্শের ধারেকাছেও নেই। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের আচার আচরণ দেখলে মনে হয় তারা রমজান মাসের অপেক্ষায় থাকেন। যেকোনো সংকটের অপেক্ষায় থাকেন।
১১. শুধু ব্যবসায়ীদের দোষ দিয়েও লাভ নেই। সাধারণ মানুষও বাজার অস্থিতিশীল করে তোলে। দুই সপ্তাহ লকডাউন হলেও চার সদস্যের একটি পরিবারের জন্য কত কেজি চাল, ডাল, তেল, নুন লাগবে? ফেসবুকে মানুষের কেনাকাটার যে ভয়াবহ চিত্র এসেছে, তা রীতিমতো গা শিউরে ওঠার মতো। কেউ কেউ একশো লিটার তেলও নাকি কিনেছেন। যত বড় পরিবারই হোক, একশো লিটার তেল তিনি কতদিন বসে খাবেন? দশ বস্তা চাল কিনতে হবে কেন? আমি নিজে দেখেছি, রাজধানীর গুলশান এক নম্বরের একটি সুপারশপ থেকে একজন ভদ্রমহিলা নানাবিধ জিনিসের সাথে তিরিশটার মতো টয়লেট টিস্যু কিনলেন। তাকে রসিকতা করে জিজ্ঞেস করলাম, এত টিস্যু দিয়ে আপনি কী করবেন? তিনি আমার দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে বললেন, ‘ইটস নট ইওর বিজনেস’। চেহারা সুরত দেখে মনে হয়নি যে তিনি দোকানে নিয়ে এসব বিক্রি করবেন। তাছাড়া দোকানদার কোনো সুপারশপ থেকে জিনিসি কেনে না। প্রশ্ন হলো, যত বড় পরিবারই হোক, এক মাসে বা ১৫ দিনে তাদের কয়টা টয়লেট পেপার লাগে? এগুলো হচ্ছে হাহুতাশ।
বাঙালির হা-হুতাশের একটা বড় উদাহরণ দিয়েছিল আমাদের উকিলবন্ধু সাইদুল ইসলাম। সে একবার প্রশ্ন করলো, বলতো ইফতারিতে বাঙালি হাভাতের মতো কেন খায়? কেন? কারণ সে মনে করে আহারে সারাদিন কিছু খাই নাই। এবার বল সেহেরি কেন দুনিয়াদারি খায়? কেন? কারণ সে ভাবে, আহারে সারাদিন তো না খেয়ে থাকতে হবে।…অথচ রোজার নাম হলো সংযম। যে সংযম বাঙালির সেহরিতে থাকে না, ইফতারেও থাকে না। বরং রোজার মাসে অন্য মাসের তুলনায় সে বেশি খায়। যে কারণে পণ্যের দাম বাড়ে। অথচ এই মাসে খাদ্যপণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ার কথা এবং অর্থনীতির সহজ সূত্র অনুযায়ী দাম কমার কথা। উপরন্তু ধর্মীয় বোধ বিবেচনা তথা পূণ্য লাভের আশায় ব্যবসায়ীরা কম লাভ করবেন, বেশি বেশি ডিসকাউন্ট দেবেন- এটিই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাঙালি ব্যবসায়ীরা করেন উল্টো। যার দায় ভোক্তা নিজেও এড়াতে পারে না।
১২. বাঙালির ধর্মীয় অনুভূতি এতই ঠুনকো যে, কেউ কিছু বললেই তার অনুভূতিতে আঘাত লাগে। তাদের আচার আচরণ দেখে মনে হয়, তাদের ঈমান মহানবীর চেয়েও শক্তিশালী। এই হুজুগে তা দেয় মূলত ফেসবুক। একসময় মসজিদের ইমাম বা কোনো ইসলামিক স্কলারের কথাকে মানুষ যেভাবে গুরুত্ব দিতো, এমনকি ওয়াজ মাহফিলের বক্তাদের কথাও যেভাবে মানুষ বিশ্বাস করতো, এখন তার ঠিক উল্টো। ইসলামিক জ্ঞানের নামে কিছু লোক ওয়াজ মাহফিলে মানুষকে প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত করছে। নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে তারা নিজের মতো করে ধর্মের ব্যাখ্যা করছে।
করোনাভাইরাসের প্রকোপ ঠেকাতে যেখানে খোদ মক্কা মদীনায় জামাতে নামাজ পড়া বন্ধ করা হয়েছে, মক্কায় তাওয়াফ সীমাবদ্ধ করা হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের একশ্রেণির কাঠমোল্লা সোশ্যাল মিডিয়ায় হুংকার দিয়ে বলছে, মক্কা মদিনায় নামাজ বন্ধ হলেও বাংলাদেশে মসজিদে জামাত হবে। ভাবখানা এমন যে, এরা মহানবীর চেয়েও বড় মুসলমান! এর বাইরে আরও নানা বিষয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ‘অশিক্ষিত পণ্ডিতরা’ মানুষেকে বিভ্রান্ত করে। কিন্তু সরকার এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না বা নিতে ভয় পায়।
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, রংধনু টেলিভিশন।
এইচআর/বিএ/জেআইএম