সরকার সদয় হোক : মানবিক হোক চিকিৎসক
সেবার শপথ নিয়েই চিকিৎসকদের চিকিৎসা পেশায় প্রবেশ করতে হয়। এ পেশাটি রাষ্ট্রের অন্যান্য পেশার তুলনায় অনেক বেশি সম্মানের। এটা পেশা হলেও, চিকিৎসকরা মানুষের জীবন রক্ষায় কাজ করেন বলে এটি মানবসেবার একটি অংশও বটে। কিন্তু আজকাল এ পেশার মানুষ কেমন যেন আচরণ করতে শুরু করেছেন। কখনো রাজনৈতিক, কখনওবা অমানবিক আচরণও পরিলক্ষিত হয়। আমরা দেখেছি, রোগীকে জিম্মি করে হরহামেশাই কাজে যান না; ধর্মঘটেও যান চিকিৎসকরা। এজন্য অনেক রোগী চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে এ দেশে। বোধকরি বাংলাদেশ ছাড়া এমন নজির আর কোথাও নেই।
করোনাভাইরাস এমন সঙ্কটের মধ্যেও হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকরা যাচ্ছেন না, চেম্বার করছেন না এমন অভিযোগ ডাক্তাদের বিরুদ্ধে, যা অমানবিক বটে! জীবনের নিরাপত্তাসহ পিপিই না পাওয়ার কারণ দেখিয়ে চিকিৎসকরা সাধারণ রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। এটা কোনো চিকিৎসকের আচরণ হতে পারে না। হাসপাতালগুলোতে অসংখ্য রোগী আসছেন, ডাক্তার না পেয়ে চিকিৎসাবঞ্চিত হয়ে তারা বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। বড় অসহায় রোগী এবং রোগীর পরিবার।
রোগীদের অসহায় করে চিকিৎসকরা কিছুতেই ঘরে বসে থাকতে পারেন না। এর আগে বহুবার চিকিৎসকরা রোগীদের জিম্মি করে দাবিও আদায় করেছেন। স্বাস্থ্যসেবার স্বার্থে ডাক্তারদের যে কোনো পরিস্থিতিতে যে কোনো জায়গায় কাজ করার মানসিকতা থাকতে হবে। এটাও সত্য ডাক্তারদের কর্তব্য পালনকালীন সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এটা সরকারের দায়িত্ব বটে! করোনা পরিস্থিতিতে চিকিৎসা দিতে গিয়ে চিকিৎসকরা কিছুটা বিব্রত হয়েছেন। তাদের কাছে যথাসময় পর্যাপ্ত পারসোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) পৌঁছেনি। ঝুঁকি নিয়ে তাদের চিকিৎসা দিতে হয়েছে এমনকি এখনও হচ্ছে, যা কিনা নিজেদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আতঙ্ক তৈরি করেছে।
এ কারণে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক সঙ্কট চলছে। সাধারণ রোগেরও চিকিৎসা পাচ্ছে না মানুষ। এটা ভয়ঙ্কর কথা। প্রটেকশন তৈরি হচ্ছে এখনও কেন ডাক্তাররা বসে থাকবেন তা বোধগম্য নয়। জ্বর, কাশি, ঠান্ডার রোগীদের সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে পাঠানো যায় কিন্তু বাকিদের চিকিৎসা তো তারা করবেন তাই না? তাও করছেন না অনেক চিকিৎসক। হাত-পা গুটিয়ে বাড়িতে অলস সময় কাটাচ্ছেন অনেকে। হাসপাতালে এলেও অনেকে আবার গাছাড়া ভাব দেখাচ্ছেন। চিকিৎসকরা কি এটা করতে পারেন? অন্তঃসত্ত্বা, গাইনি, শিশুসহ সাধারণ রোগের চিকিৎসা করতে তাদের দোষ কোথায়!
প্রটেকশন নিয়ে সব দেশের চিকিৎসকরাই রোগীদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশই তার ব্যতিক্রম। গত বছর ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে ডাক্তাররা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগীর সেবায় নিবেদিত হন। এজন্য অনেকের প্রাণও গেছে। তাতেও ডাক্তাররা সেবাদিতে পিছপা হননি। তাদের আন্তরিকতা এবং সেবায় অনেকে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছেন। এ বিষয়টিতে আমাদের দেশের চিকিৎসকরা তখন যথেষ্ট বাহবা পেয়েছিলেন। সত্যিই আমাদের ডাক্তাররা যে মানবিক মানুষ তা তারা সে সময় প্রমাণ দিয়েছেন। এবারের করোনা ক্রাইসিসে ডাক্তারদের অমানবিক আচরণ তাদের সব সুনাম ধুলায় ভুলুণ্ঠিত করছে বৈকি।
চিকিৎসকদের একটু দরদী স্পর্শ, একটু সহানুভূতি, একটু হাসিমাখা মুখের কথায় জটিল ও কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিকেও আশাবাদী করে তোলে, রোগ যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেয়। তার উল্টোটা হয় চিকিৎসাবঞ্চিত হলে। রোগীরা চিকিৎসা নিতে এসে চিকিৎসক আর কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা না পেলে রোগী এবং তার পরিবারের জন্য যে তা কতটা যন্ত্রণার তা কি আমাদের চিকিৎসকরা ভাবেন?
চিকিৎসকদের বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো রোগীর পাশে দাঁড়াতে হবে। শুধু চিকিৎসা প্রদান নয়, মুখের একটু কথায়ও অনেক সময় রোগী সুস্থবোধ করেন। রোগীরা তো এখন করোনা ক্রাইসিসের সময় ডাক্তারের দেখাই পাচ্ছেন না। তা রোগী, রোগীর পরিবার তথা দেশবাসীকে কতটা অসহায় করছে তা বলা বাহুল্য। আমাদের ডাক্তাররা দেশের মানুষের অসহায়ত্বের কথা উপলব্ধি করছেন কি?
করোনাভাইরাস মহামারি রূপ নিয়েছে। এ রোগ দুনিয়াজুড়ে। রোগের জন্য; রোগীর জন্য চাই ডাক্তার। ডাক্তার না থাকলে রোগীরা তো বড় অসহায়। ডাক্তার না থাকলে কারা চিকিৎসা দেবেন রোগীদের? ডাক্তার সংকট কেন হলো? করোনা আতঙ্কের মধ্যে শুরুতেই ডাক্তারদের সুরক্ষা সরঞ্জাম দেয়া হয়নি। এটা কিন্তু বড় সত্য। রোগীর অনুপাতে ডাক্তারদের মধ্যে আক্রান্তের পরিমাণ বেশি হওয়ায় চিকিৎসকদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে এটাও সত্য। হওয়ারই কথা। রোগ সারাতে গিয়ে ডাক্তার যদি রোগী হয়ে যান তাহলে কি চলবে? ডাক্তাররা দলে দলে অসুস্থ, রোগীরা সেবা কার কাছ থেকে নেবেন? এ জন্য ডাক্তারদের ঝুঁকি কমিয়ে এনে তাদের কাজে নামানো দরকার ছিল।
এটাও সত্য যে, ডাক্তারদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকবে। পরিমাণে তা বেশি হলে আতঙ্কেরই কথা। প্রশাসনের হাতে পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুয়িপমেন্ট (পিপিই) চলে এসেছে আগে। এমন অভিযোগ শুরু থেকে চিকিৎসকরা করে আসছেন। এটা নিয়ে যথেষ্ট ভুল বোঝাবুঝিও হয়েছে। অবশ্য প্রশাসন ক্যাডার আর ডাক্তারদের মধ্যে অঘোষিত দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে সইতে না পারার বিষয়টি আমরা বহু দিন ধরেই দেখছি। ডাক্তাররা যখন পিপিই পাননি তখন প্রশাসন, ব্যাংকার, ব্যবসায়ীরা পিপিই পরে ফটো সেশন করেছেন! ফেসবুকে তা সবাই দেখেছে। এটা নিয়েই সমস্যা তৈরি হয়েছে। এক কথা সত্য যে চলতি করোনা সঙ্কটে দেশে প্রশাসনের লোকদের ভূমিকা অত্যন্ত খুশি হওয়ার মতো। প্রশাসনের লোকজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনরাত মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের পিপিইও দরকার ছিল। তবে যে ডাক্তাররা রোগীদের চিকিৎসা দেবেন তারা তখন পিপি পাননি এটা হতে পারে না। যারা রোগীদের চিকিৎসা দেবেন তারা অনিরাপদ থাকবেন, স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকবেন তা কি করে হয়? ভুল বোঝাবুঝি তো হবেই। যে ডাক্তাররা রোগীর চিকিৎসা দেবেন তাদেরই পিপিইর অভাব। কষ্টেরই কথা। এ অবস্থায় ক’জন ডাক্তার করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় আতঙ্ক তৈরি হয়েছে ডাক্তার সমাজে। এটা অনেক বড় ক্ষতির কারণ হলো আমাদের জন্য। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে ডাক্তাররা কাজ করবেন তারা সরঞ্জামের অভাবে আক্রান্ত হলে প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক। কথা আরও আছে। ডাক্তাররা কর্তব্য পালন করতে যাওয়ার পথে রাস্তায় পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
ডাক্তাররা কর্মস্থলে যেতে আসতে বাধার সম্মুখীন হলে, অসম্মানিত হলে তারা সাচ্ছন্দ্যে কাজ করবেন কী করে?
কথা কিন্তু আরও আছে। এসব বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা। ডাক্তাররাও কিন্তু এ সমাজেরই মানুষ। অন্যের ভুলের কারণে তারা হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকবেন আর রোগীরা চিকিৎসা না পেয়ে কাতড়াবে এটা হয় না। এটা ডাক্তারি পেশার সাথে যায় না। এটা অমানবিক। গড় হিসাবে একজন ডাক্তারের রোজগার কম নয়। এ রোজগার কিন্তু রোগী থেকেই আসে। তারা জীবনটা বদলে যে সুন্দর জীবন পেলেন তা রোগীদের বদৌলতেই। কি করে তারা রোগীদের সমস্যার কথা ভুলে গেলেন?
রাজনীতিক, ছাত্র-শিক্ষক, শিল্পপতি, সাংবাদিক সবাই কাজ করছেন যে যার জায়গা থেকে। অসহায় মানুষের জন্য সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ক্ষুধার্তদের মুখে খাবার দিতে অনেক মানবিক মানুষ মাঠে রয়েছেন। ডাক্তারি পেশাকে মানবিক পেশা হিসেবেই তো আমরা জানি। কিছু প্রটেকশন ডাক্তাররা নিজে থেকেই নিতে পারতেন। সে সঙ্গতি বোধকরি অনেক ডাক্তারেরই আছে। কিন্তু উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে ঘরে বসে আছেন যারা তারা কতটা মানবিক সেটা এখন প্রশ্ন!
বুঝি আমরা, অনেকে জীবনের ভয় অনেক বেশি করছেন। অনেক পেশা আছে জীবনে ভয় কম করতে হয়। এর মধ্যে আছে মহান পেশা চিকিৎসা আর সাংবাদিকতা। দুঃসময়ে চিকিৎসকরা ঘরে বসে থাকলে কি করে চলবে। মহামারি তো তাদেরই যুদ্ধ। যুদ্ধে নেমে মহামারিকে জয় করতে হবে তাদেরই। মানুষকে আতঙ্কিত করা, মানুষের জীবন বিপন্ন করা কতটা সঠিক হচ্ছে? আমাদের প্রিয় ডাক্তাররা জবাব দেবেন। আমার ছেলে এবং মেয়েও ডাক্তার। আমার পরিবারে অনেক ডাক্তার আছেন। তবুও লিখতে বাধ্য হচ্ছি এসব। এটা লেখার দায় তৈরি হয়েছে। এই মাত্র যখন লিখছি ডাক্তার ছেলে এবং মেয়ে বিদায় নিতে আসলো। তারা করোনা বিষয়ে ট্রেনিংয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে তারা সরকারের ৩৩৩ তে রোগীদের দিনরাত চিকিৎসা দিচ্ছেন। এমনকি তাদের পরিচালনাধীন হাসপাতালটি খোলা রেখে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি মনে করি এমন দুঃসময়ে ডাক্তারদের আরও মানবিক হওয়া উচিত।
অসহায় রোগীদের জিম্মি করা মানবসেবার ধর্ম হতে পারে? কসাই আর ডাক্তার দু’টোই যেন এক জাতীয় প্রফেশন না হয়। নচিকেতার গানের চিকিৎসক যেন কেউ না হন। বিখ্যাত এ গায়ক তার গানে কেন কসাইয়ের সঙ্গে ডাক্তারদের গুলিয়ে ফেললেন? কেন এক কাতারে তাদের দাঁড় করালেন এখন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। প্লিজ চিকিৎসক সমাজ আপনারা আরও মানবিক হোন। রোগীদের জন্য সদয় হোন। চিকিৎসকরা (সবাই নন) কসাইয়ের (নিষ্ঠুর) ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। জীবনের ভয়ে রোগী দেখা ছেড়ে দিয়েছেন। এটা আপনাদের প্রফেশনের ধর্ম নয়। প্রশ্ন আসে স্বাভাবিকভাবেই, মানুষের জীবন নিয়ে এমন আচরণ হয়কি করে? এটি কিছুতেই আইনসিদ্ধও নয়। এটা মোটেও মানবিক নয়।
চিকিৎসকের সেবার সঙ্গে মানুষের জীবন রক্ষার বিষয়টি জড়িত। জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার কোনোই অধিকার নেই কারও। চিকিৎসকদের মাঝে নীতিনিষ্ঠা, মানবিকতা, সদাচার, কর্তব্যপারায়ণতা- এসব গুণের বেশি পূজারি হওয়ার কথা। অনেক চিকিৎসক এমনটাই। এই আপনারাই তো ডেঙ্গু সমস্যায় গত বছর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাত দিন কাজ করে শত শত মানুষের জীবনবাজি রেখে বাহবা পেয়েছিলেন। এ জন্য অবশ্য আপনাদের ক’জন ডাক্তারকে জীবনও দিতে হয়েছে। চিকিৎসা পেশাটা তো এমনই। এমন হওয়াই উচিত। প্লিজ আপনারা স্বরূপে ফিরে যান; মানবিক আচরণ করুন। চেম্বারে ফিরে যান। রোগীদের চিকিৎসা দিন।
মনে রাখবেন চিকিৎসকদের প্রতি মানুষ অনেক দুর্বল। অসহায় মুহূর্তে আপনাদের কাছে মানুষ ছুটে যায়। আপনাদের কাছ থেকে কোনো অশোভন বা সেবাবহির্ভূত আচরণ জনগণ প্রত্যাশা করে না। সমাজে চিকিৎসকরা একটি শিক্ষিত ও সম্মানিত পেশাজীবী মহল। তাদের অমানবিকতা অথবা উদাসীনতার কারণে হারিয়ে যেতে পারে অনেক প্রাণ।
চিকিৎসা পেশা একটি মহৎ পেশা, চিকিৎসকদের এটা বিবেচনায় রাখতে হবে। তাদের প্রথম কাজই হচ্ছে রোগীর সেবা দেয়া। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসকদের এক মিনিটের কর্মবিরতিতে কারো জীবনহানি ঘটতে পারে। এ ধরনের আচরণ আমরা আপনাদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করি না।
বর্তমানে করোনা সঙ্কটে ডাক্তার এবং রোগীদের সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ডাক্তার এবং রোগীর মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বিদ্যমান রাখা দরকার। চিকিৎসকরাই তা করবেন। রোগী-ডাক্তার সম্পর্ক অটুট থাকবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক।
এসএইচএস/এমএস