করোনা সংকটে প্রকৃতির ভিন্ন বার্তা
বিগত দশকগুলোতে ভাইরাসবাহিত যত মহামারিতে এই বিশ্ব আক্রান্ত হয়েছে তার সবগুলোই বিভিন্ন পশু-পাখির দেহ, দেহের অংশ বা লালা থেকেই উৎসারিত হয়েছে। যেমন, হংকংয়ে উদ্ভূত সার্স ও মধ্যপ্রাচ্যের মার্স এসেছিল উট, পেঙলিন, ও সিভেট বিড়াল থেকে; গোটা আফ্রিকাকে নাজেহাল করা জিম্বাবুয়ের ই-বোলার উৎপত্তি হয়েছিল বাঁদুড়, শিম্পাঞ্জি বা বানর থেকে, বাংলাদেশের নিপাহ ভাইরাস ও সম্প্রতি যে ভাইরাসটি সারা দুনিয়ার মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে এসেছে, সেই করোনার উৎস হিসেবেও এখনো বাঁদুড়ের লালাকেই ভাবা হচ্ছে। এমনকি গত দুদিনে 'হানটা' নামে চীনের যে ভাইরাসটি একজনের মৃত্যুর কারণ হয়েছে এবং প্রাণঘাতী প্লেগও ইঁদুরের শরীর, লালা বা প্রস্রাব থেকে উৎসারিত।
উপরের তথ্য-উপাত্ত শুধু আলোচনার বিষয় নয় বরং ভাববার বিষয়। মানুষের অদ্ভুত খাদ্যাভ্যাস, লোভী আচরণ ও অন্য জীববৈশিষ্ট্যের জন্য প্রতিহিংসা ও অবহেলাই এইসব মহামারির কারণ। সব প্রাণীই কি আমাদের খেতে হয়? শরীরের বৃদ্ধি, কর্মক্ষমতা ও পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য আমাদের খাদ্য প্রয়োজন। আমরা বিভিন্ন ধরনের ফার্মিংয়ের মাধ্যমে ভোক্তা চাহিদা পূরণের জন্য কৃত্রিমভাবে পশু বা পাখি পালন করে সেই চাহিদা পূরণ করছি। সেখানেও ভাইরাস সংক্রমণের ঘটনা ঘটে। কিন্তু শুধুমাত্র বিশেষ খাবারের লোভ ও স্বাদ পাওয়ার জন্য বিশ্বজুড়ে অসংখ্য পশু ও পাখি যেভাবে হত্যা করা হয়, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়; যদিও অভিযানপ্রিয় মানুষ নিজেদের বাহাদুরি জাহির করেন নিরীহ পশু-পাখি হত্যা করে!
ঐতিহ্যগতভাবেও উপজাতীয় যেসব খাদ্যাভ্যাস আমরা অনেকেই বিভিন্ন দেশে পালন করি, তা সত্যিই ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ; অন্তত এই ফার্মিংয়ের যুগে। কেননা খামারে একটি আক্রান্ত প্রাণী থেকে মুহূর্তেই হাজার হাজার প্রাণী একটি মরণ ভাইরাসে আক্রান্ত হয় যা মানবশরীরেও আমাদের অজান্তেই বাহিত হয়।
এশিয়া ও আফ্রিকাজুড়ে বিভিন্ন উপজাতি ও গোষ্ঠীর সরাসরি বন্যপ্রাণী খাওয়ার যে ঐতিহ্য সেটিও এই মুহূর্তে দুবার ভাবার বিষয়। কেননা এতসব প্রাণীবাহিত রোগ একইসাথে অপ্রতিরোধ্য ও ভয়ঙ্কর সংক্রামক। শুধুমাত্র বন্যবৈচিত্র্য বা প্রাণী-বৈশিষ্ট্য রক্ষা নয়, প্রকৃতিকে তার নিজের মতো করে গড়ে ওঠার, বেড়ে ওঠার ও জীবনচক্র সমাপ্ত করতে দেয়ার দায়িত্বও আমাদের। সভ্যতার পূর্বে মানুষ জীবন-ধারণের জন্য সব ধরনের বন্যপ্রাণী বা ফলমূল কাঁচা বা অর্ধসেদ্ধ করে খেত প্রয়োজনের তাগিদেই। কিন্তু এখনও কি সেই একই খাদ্যাভ্যাস প্রয়োজন আমাদের? এত এত বিজ্ঞান-গবেষণা কি বলেনি, কোনটি এখন আর আমাদের দরকার নেই?
যেসব দেশে প্রযুক্তির সেরা কম্পিউটার ও সেলুলার ফোন তৈরি হয়, সেসব দেশেই আবার অবাধে বন্যপ্রাণী খাওয়া হয়। সভ্যতা বা প্রযুক্তি অর্থ কি তাহলে কেবল পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা ও প্রকৃতির মৃত্যু? বিশ্বায়নের যুগে অবাধ যোগাযোগ যেমন বাণিজ্য ও সংস্কৃতির আদান-প্রদানের মাধ্যমে দূর-দূরান্তের মানুষকে কাছে আনে, তেমনি সংক্রামক রোগ-বালাইয়ের রাস্তাও প্রশমিত হয়। তাই শুধু রাসায়নিক নয়, জৈব মারণাস্ত্রের প্রবাহ যেন বিশ্বকে আরও একবার স্তব্ধ করে না দেয় সে জন্য প্রতিটি দেশ, জাতি ও উপজাতিকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।
পৃথিবীজুড়ে সারি সারি লাশ; লাশবাহী গাড়ি। এরই মধ্যে কোটি কোটি মানুষ করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে ঘরবন্দি। সারাবিশ্বের শিক্ষা, অর্থনীতি, বাণিজ্য, সংস্কৃতি সবকিছুই স্থবির। কোথাও মানুষ মৃত্যুর প্রহর গুনছে, কোথাও তীব্র আতঙ্কে অসহনীয় দিন যাপন করেছে। ভালো নেই কেউই! এমন একটি সময়ে সুন্দর যে দিকটি পৃথিবীজুড়ে আলোচিত হচ্ছে তা হলো, স্বাভাবিক আবাসস্থলে মানুষের অনুপস্থিতিতে প্রকৃতির সরব উপস্থিতি।
ছুটিতে থাকা মানুষের আনন্দের উৎস হলেও, অন্য স্বাভাবিক সময়ে মানুষের আনন্দের খোরাক হতে গিয়ে প্রাণভয়ে গভীর জঙ্গলে বা সমুদ্রে লুকিয়ে থাকা প্রাণীরা নির্ভয়ে বাইরে আসছে। যে সমুদ্রসৈকতে হাঁটু-জলে দাঁড়িয়ে বা বসে শুধুই একটু ছবি তোলা জন্য মানুষ ভিড় করে, সেই সৈকতজুড়ে এখন ডলফিনের খেলা! ঢাকার মতো নিরেট শহরেও এখন মানুষের ঘুম-ভাঙে চেনা-অচেনা অনেক পাখির কলতানে! শহরের একটু বাইরেই দেখা মিলছে অসংখ্য কাঠবিড়ালীর। বাতাসে গ্যাস ও তাপ কমছে, দূষণের মাত্রা কমছে, আকাশের রং পাল্টেছে, পাখিরাও ফিরে আসছে।
কী বার্তা দিচ্ছে তারা আমাদের? মানবসভ্যতা শুধু প্রকৃতি ধ্বংসই করছে না; নিজেদের সুরক্ষার তাগিদেও আনন্দের প্রয়োজনে প্রকৃতির অন্য প্রজাতিদের কোণঠাসা করে অনধিকার চর্চাও করছে। হ্যাঁ, তাদের স্থান তাদের ছেড়ে দিতে হবে। সরাতে হবে জঞ্জাল; বন্ধ করতে হবে অনধিকার প্রবেশ। আমাদের স্থূল আনন্দের জন্য বন্য ও সামুদ্রিক প্রাণীকে ছোট্ট খাঁচায় বন্দি না করে এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনের ছন্দপতন না করে তাদের আমাদের আনন্দের অংশীদার করতে হবে।
প্রাণীদের ভয়ের কারণ নয়, দর্শনার্থীরা তাদের বন্ধু হবে। সমুদ্রে দর্শনার্থীদের সীমানা বেঁধে দেয়া হোক যেন সামুদ্রিক প্ৰাণীরা নির্ভয়ে তীরে আসে এবং সেটি হতে পারে পর্যটকদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ। পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে ব্যবসার খাতিরে করা অনুমোদিত ও অনুনোমোদিত হোটেল-মোটেলের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে দর্শনার্থীর সংখ্যাও সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে।
চিড়িয়াখানাগুলোকে খাঁচা-সর্বস্ব না করে প্রতিটি প্রাণীর স্বাভাবিক আবাসের মতো করে বড় আকারে তৈরি করতে হবে, যেন কৃত্রিম পরিবেশে ক্ষীণকায় বা রুগ্ন না হয়ে পড়ে। প্রাণী দেখতে আসা শিশু-কিশোররা যেন তাদের সুস্থ ও স্বাভাবিক সৌন্দর্য অবলোকন করার পাশাপাশি তাদের জীবন ও খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে জানতে পারে। প্রাণিহত্যা আইন জোরদার করার পাশাপাশি বনাঞ্চলের ক্ষতির শাস্তি প্রয়োগ করতে হবে।
সবচেয়ে জরুরি হলো, সুন্দরবনসহ সকল বন, নদী ও সমুদ্রে জন-সমাগম নিয়ন্ত্রণ ও দূরত্বে অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। আমরা কুঠার সরালেই প্রকৃতি তার অকৃপণ হাত সম্প্রসারণ করবে!
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/বিএ/জেআইএম