করোনায় উপেক্ষিত প্রবাসী ও নিম্নবিত্তের মানুষগুলো
গত ক'দিন আগে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসককে নিয়ে তুমুল আলোচনা উঠেছিল। তিনি তার দলবল দিয়ে একজন সাংবাদিকের বিচার করেছিলেন মধ্যরাতে। বেচারা সাংবাদিক ডিসি ম্যাডামকে খুব জ্বালিয়েছিলেন, তাই তিনিও জ্বলে উঠেছিলেন, তার সাথে একই তীর্থে বাস করেন যারা, তারা সবাই মিলিত হয়ে রাতের আঁধারেই তাকে শিক্ষা দিয়েছিলেন, ম্যাডামের সাথে 'বেয়াদবির'। ম্যাডাম বিপাকে পড়েছিলেন এতে। যা হওয়ার হয়েছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তাৎক্ষণিক উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে, বিভাগীয় শাস্তির নির্দেশনা অসংখ্য অরাজকতার মাঝে একটা ভালো উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এই জেলা প্রশাসকের পথ ধরে আরেক ম্যাডাম আরেক লঙ্কাকাণ্ড ঘটালেন সম্প্রতি। তিনি পেটাননি, তবে 'জনস্বার্থে' তিনি তার পিতা কিংবা দাদার বয়সী তিনজন মানুষকে কান ধরিয়ে ওঠবস করিয়েছেন। তার চেহারা দেখে মনে হয়েছে তিনি তরুণী। তারুণ্যে মানুষ উদ্যমী হয়, উদ্যোগী হয়, সৃজনশীল হয়। এই উদ্যম-উদ্যোগ-সৃজনশীলতা নিয়েই সৃষ্টিশীল ক্যাডার সাইয়েমা হাসান যা করলেন, তা সাংবাদিক পেটানোর চেয়ে উত্তম। কারণ এ জায়গায় তিনি শারীরিক আঘাত থেকে দূরে থেকেছেন, দিয়েছেন লঘুদণ্ড। সে হিসেবে এখানে তিনি সফট একজন মানুষ।
করোনা নিয়ে সারা পৃথিবীই কাটাচ্ছে এক রুদ্ধশ্বাস সময়। করোনা আক্রান্ত পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই কোনো না কোনোভাবেই বন্ধ হয়ে আছে। পৃথিবীর শত শত কোটি মানুষ এখন ঘরকুনো। মানুষকে ঘরে বন্দি করে রাখতে রাষ্ট্র নিয়েছে কঠোর পদক্ষেপ। ইতালি-স্পেনে করোনায় বিপর্যস্ত। সুনির্দিষ্ট প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বেরুলে বড় অংকের জরিমানাসহ জেল পর্যন্ত হচ্ছে সে দেশগুলোতে। ব্রিটেনেও সেই একই অবস্থা। লকডাউন হয়ে আছে সারা ব্রিটেন। বাড়ছে মৃত্যু প্রতিদিন। শনিবার সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড উঠেছে ব্রিটেনে। একই দিনে মারা গেছেন ২৬০ জন। শুধু লন্ডনেই মারা গেছেন প্রায় ৮০ জন। দেশগুলোর মানুষ উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠায় সময় যাচ্ছে সবার।
কিন্তু এরপরও প্রয়োজনীয় (ইমার্জেন্সি) প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ নেই। রাতদিন কাজ করছে স্বাস্থ্যবিভাগের কর্মীরা। সেবা দিয়েই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন পাকিস্থানি বংশোদ্ভূত ৩৬ বছরের নারী, মারা গেছেন চিকিৎসক। এই মৃত্যু আর শঙ্কার মাঝে ব্রিটেনে সুপার মার্কেটের পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ছোট-মাঝারি দোকানগুলোও খোলা। এক ধরনের সেবা-ই দিয়ে যাচ্ছে নাগরিকদের এসব দোকানপাট। দেশটির নির্দেশনা আছে ঘর থেকে না বেরুনোর। পাশাপাশি টহল দিচ্ছে পুলিশ।
এ হিসেবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির সাধ্য অনেক কম। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সচেতনতা আছে। মন্ত্রীরা কেউ কেউ অতিশয় উক্তি করলেও নিরাপত্তার প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তগুলো অনেক বিশালই হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া, এমনকি সারাদেশ লকডাউন করা আমাদের দেশটার জন্য অনেক বড় সিদ্ধান্ত। কিন্তু লকডাউন করে একটা দেশকে উন্নত দেশের মতো সেবা দেয়া বাস্তবতার সাথে যাবে না। ষোল কোটি মানুষের খাওয়ার নিশ্চয়তা সরকার দিতে না পারলেও দেশটাতে হাহাকার নেই। জ্বরায় চিকিৎসার পুরোপুরি সরকারি সুযোগ-সুবিধা স্বাভাবিকভাবেই এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ অবস্থায় বাংলাদেশ আক্ষরিক অর্থে রাষ্ট্রীয় নির্দেশনায় বন্ধ।
লকডাউন করে জনগণের ওপর যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, তা জনগণের অনেকেই মানছে না। মধ্যবিত্ত কিংবা অভিজাত শ্রেণিদের জন্য লকডাউন মনে হয়েছে এক ধরনের অবকাশ। উদ্বেগ তাদের খুব একটা কাবু করতে পারেনি প্রথম। সে জন্যই সমুদ্রসৈকতগুলোর হোটেলে বিছানা খালি ছিল না প্রথমাবস্থায়। সরকার বাধ্য হয়ে এসব এলাকার হোটেল-মোটেল বন্ধ করিয়েছে। অর্থাৎ এই শ্রেণি লকডাউনকে পাত্তাই দিতে চায়নি। তাই সরকার কৌশল করে মধ্যবত্তি-উচ্চবিত্তদের ঘরমুখী করেছে। হাজার হাজার মানুষ গ্রামমুখী হয়েছে একই সাথে লঞ্চ, স্টিমার, বাস কিংবা ট্রেনে। শ্রেণিগত অবস্থানে এরা 'ভদ্রলোক', তাই এদের ওপর বলপ্রয়োগ করা যায়নি।
কিন্তু এখন নিম্নআয়ের মানুষগুলো হন্যে হয়ে ছুটছে খাবার জোটাতে। তাদের ঘরে বন্দি করতে চলছে জোর প্রয়োগ। পুলিশ কাদের পেটাচ্ছে? সাইয়েমা হাসান কাদের সাথে গুন্ডামি করলেন? এরা সেই শ্রেণিই, যারা দুমুঠো ভাতের জন্য রাস্তায় বেরিয়েছে। এদের পেটানোর আগে অন্তত শাক-ভাতের নিশ্চয়তা দিতে হবে, তারপর না হয় আসতে পারে বলপ্রয়োগ কিংবা এনফোর্সমেন্টের কথা।
যেভাবে আতঙ্কে উদ্বিগ্ন মানুষ সময় কাটাচ্ছে ব্রিটেন কিংবা আমেরিকায়, সে অর্থে বাংলাদেশে করোনার বিস্তার নেই বললেই চলে। কিন্তু সেখানে আতঙ্ক আছে, আর এই আতঙ্কে দেশটাতে কিছুটা অরাজকতা সৃষ্টিও করা হয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকা কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের অভিবাসী কিংবা প্রবাসী মানুষগুলোকে নিয়ে তামাশা করছে বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ। অপদস্ত হয়েছে ইতোমধ্যে কিছু প্রবাসী। শুধু ব্রিটেন এবং কানাডার নাগরিক হিসেবে দুজন নারী মারা গেছেন ডাক্তার-নার্সদের অবহেলায় অথচ এরা করোনা আক্রান্ত ছিলেনই না। শুধু তাদের 'অপরাধ'টা ছিল ব্রিটেন এবং কানাডা থেকে দেশে গিয়ে সুস্থ হওয়ার জন্য ডাক্তার দেখাতে চেয়েছিলেন।
সিলেটে করোনা সন্দেহে মৃত্যুবরণকারী নারীর করোনা সন্দেহটা ছিল অমূলক... তাকে দাফন করার পর রিপোর্ট এসেছে নেগেটিভ। স্বামী বেদনার পাহাড় সাথে নিয়ে ফিরে এসেছেন ম্যানচেস্টারে। লকডাউনে থাকা ব্রিটেনের নাগরিকদের একজন আমি আলাপ করেছি আমার শহরেই থাকা এ মানুষটার সাথে। তার দীর্ঘশ্বাসে বুকটা কেঁপে ওঠে। শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে তার স্ত্রীর ধুকে ধুকে মৃত্যুর চিত্র তুলে ধরেছিলেন তিনি। উপযুক্ত পরিচর্যাহীন ছিলেন তার স্ত্রী, শুধু একটা সন্দেহের কারণে ডাক্তার-নার্স কেউ ঘেষতে চায়নি তার কাছে।
তার স্ত্রীর কক্ষে বিদ্যুৎ ছিল না, ৬০ মিটার ক্যাবল কিনে এনে অন্য রুম থেকে কানেকশন দিয়েছেন, জানালার হাতল রশি দিয়ে বাঁধা ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক অনেক অভিযোগ। একটা ইনজেকশনের পর কীভাবে ছটফট করে তিনি বিদায় নিয়েছেন তার কাছ থেকে, তার সন্তানদের কাছ থেকে, তা শুনলে সম্প্রতি উচ্চারিত মন্ত্রীদের কথাগুলো মনে হয় আমি স্বপ্নে দেখেছি। অথচ এই মানুষটা সরকার দলের সিলেটের মূল নেতাদের পরিচিত ব্যক্তিত্ব এবং তিনিও এ দলটির ব্রিটেনের তার শহরের সর্বোচ্চ পদ নিয়ে আছেন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন দোকানপাটে এমনকি বড় শহরগুলোর কোনো কোনো জায়গায় 'বিদেশিদের প্রবেশ নিষেধ' বলে সাইন লাগানো হয়েছে। একটা জায়গায় দেখা গেছে, বিদেশি হলে চিকিৎসালয়ে পর্যন্ত প্রবেশ করার অনুমতি নেই। সেখানে পোস্টার টানানো হয়েছে, শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এগুলো কি স্থানীয় প্রশাসন দেখছে? অথচ কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করছে না। তাহলে এগুলোতে কি নির্দেশনা আছে স্থানীয় প্রশাসনের?
পৃথিবীর দেশে দেশে আছে ভিনদেশি মানুষের আবাস। চীনের মানুষের গড়া নিজস্ব টাউন আছে (চায়না টাউন) লন্ডন-ম্যানচেস্টারসহ বিভিন্ন শহরে। আছে বাঙালিদের বাংলা টাউন। কিন্তু এই আতঙ্ক সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো বিধি-নিষেধে পড়তে হয়নি কোনো ভিন্ন বর্ণের মানুষকে এই ব্রিটেনে। কারণ এসব অভিবাসী কিংবা ভিন্ন জাতি নিয়ে এ রকম বিতর্কিত কথা বিদ্বেষ ছড়ায়। দোকানে-চিকিৎসালয়ে এ রকম কথা লিখে রাখা রীতিমতো অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। কোনো সভ্যতায়ই এ রকম কথা রাষ্ট্রীয় চোখ এড়ানোর কথা নয়।
থাকা-খাওয়া-স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার নিশ্চয়তা দেয়ার পরও জনগণ মাঝে মাঝে ঘর থেকে বেরুচ্ছে ব্রিটেন-আমেরিকা কিংবা ইউরোপের কোনো কোনো দেশে। প্রতিনিয়ত নির্দেশনা আসছে ঘরে থাকার, পুলিশ-আর্মি যে নামে নাই, তা নয়। আর আমার দেশের মানুষগুলোর কেনো কিছুর নিশ্চয়তা নেই... না খাবার, না চিকিৎসা; সুন্দর শব্দ দিয়ে 'লকডাউন' করা হয়েছে। তারা ঘরে 'লক' হলো না। চাকরিজীবীরা লঞ্চ-ট্রেনে করে হৈ হুল্লড় করে বাড়ি ফিরল, সরকারি খরচে একটা হলিডে। কেউ গেল সমুদ্রবিলাসে।
অথচ রাতে একমুঠো ভাতের আশা নিয়ে যারা শ্রম দিতে বেরুলো তাদের কারও কারও গায়ে পড়ল হুশ-হাশ লাঠির আঘাত, কান ধরে ওঠবস... না, হয়তো এটাই সমগ্র বাংলাদেশ নয়।
মহামারিতেও কি বিলাসী হয় একটা শ্রেণি? বেদনার মাঝেও জল্লাদ হয়ে ওঠে কেন কতিপয় অমানুষ?
এইচআর/বিএ/পিআর