ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ইসলামে স্বাধীনতার গুরুত্ব

মাহমুদ আহমদ | প্রকাশিত: ১২:৫৭ পিএম, ২৬ মার্চ ২০২০

আজ ২৬ মার্চ। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। বাংলাদেশের ইতিহাসে মার্চ এক অনন্য মাস। ১৯৭১ সালের এ মাসেই তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্য, বঞ্চনা, শোষণ ও আক্রমণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ-সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। আর এদেশের মুক্তিকামী মানুষ পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধিকার অর্জনের শপথ নিয়েছিলেন। ফলে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে।

ইসলামে স্বাধীনতার গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা আল্লাহপাক সকলকে স্বাধীন করেই সৃষ্টি করেছেন। পরাধীনতাকে আল্লাহ-তাআলা পছন্দ করেন না। সবাই সবার নিজ নিজ ধর্ম-কর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে এটাই আল্লাহপাকের ইচ্ছা। প্রত্যেক মানুষ মাতৃগর্ভ থেকে স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে। আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য এটাই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। আল্লাহ-তাআলা সবাইকে বিবেক ও বিশ্বাসেরও স্বাধীনতা দিয়েছেন। কাউকে পরাধীন করেননি।

যেভাবে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ-তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘তোমার প্রভু-প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে তারা সবাই অবশ্যই এক সাথে ঈমান নিয়ে আসত। তবে কি তুমি মুমিন হওয়ার জন্য মানুষের ওপর বল প্রয়োগ করবে?’ (সুরা ইউনুস:আয়াত ৯৯)। এই আয়াত স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছে, আল্লাহ-তাআলা সবার স্বাধীনতা চান। তিনি চাইলে সবাইকে একসাথে মুমিন বানাতে পারতেন কিন্তু তা তিনি করেননি। তিনি চেয়েছেন মানুষ যেন স্বাধীনভাবে বুঝে শুনে ঈমান আনে। স্বাধীনতাকে ইসলাম যেমন গুরুত্ব দিয়েছে তেমনি দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধকেও অতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যার ফলে দেশপ্রেমকে ঈমানের অংশ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

মহানবীর স্বদেশ প্রেম
মহানবীর (সা.) হৃদয়ে স্বদেশ প্রেম যেমন ছিল তেমনি তার সাহাবায়ে কেরামদের (রা.) মাঝেও বিদ্যমান ছিল। তিনি (সা.) মক্কা থেকে মদিনার পথে হিজরতের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পূর্বে তার মুখ ফেরালেন জন্মভূমি মক্কার দিকে, যেখানে তিনি নবুয়ত লাভ করেছেন এবং তার পূর্বপুরুষরা বসবাস করে আসছেন। তিনি বার বার ফিরে তাকাচ্ছেন মক্কার দিকে, চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে। মক্কার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন ‘হে মক্কা! তুমি আমার কাছে সমস্ত স্থান থেকে অধিক প্রিয়, আমি মক্কাকেই ভালোবাসি। আমার মন মানছে না। কিন্তু তোমার লোকেরা আমাকে এখানে থাকতে দিল না, সব কিছুর মালিক তুমি। মক্কার মানুষদের ঈমানের আলোয় উজ্জল করো। ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করো’ (মুসনাদআহমদ ও তিরমিযি)।

একটু ভেবে দেখুন! স্বদেশের প্রতি কতই না গভীর প্রেম ছিল তার। যে দেশের লোক তার ওপর এত জুলুম- অত্যাচার করেছে তার পরও মাতৃভূমির প্রতি কত অগাধ ভালোবাসা। একেই না বলে স্বদেশপ্রেম। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌম রক্ষায় মহানবী (সা.) যখনই আহ্বান করেছেন তখনই সাহাবায়ে কেরাম (রা.) সর্বোতভাবে এ ডাকে সাড়া দিয়েছেন।তারা জানতেন, নিজেদের বিশ্বাস, আদর্শ ও দ্বীন-ধর্মমত প্রতিষ্ঠার জন্য একটি স্বাধীন ভূখণ্ডে প্রয়োজন। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য তারা যেমন আন্তরিক ছিলেন, তেমনি নিবেদিত প্রাণ ছিলেন দেশপ্রেম ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষায়।

মাতৃভূমির প্রতি মহানবীর (সা.) ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখুন, হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আমি খায়বর অভিযানে খাদেম হিসেবে মহানবীর (সা.) সাথে ছিলাম। অভিযান শেষে রসুল (সা.) যখন ফিরে এলেন, উহুদ পাহাড় তার চোখে পড়লে নবীজীর চেহারায় আনন্দের আভা ফুটে উঠল আর তখন মহানবী (সা.) বললেন, এই উহুদ পাহাড় আমাদের ভালোবাসে, আমরাও একে ভালোবাসি’ (বুখারি ও মুসলিম)।

আমাদের করণীয়
একজন নাগরিকের দায়িত্ব হলো, তার ভূখণ্ড, মাতৃভূমি এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে ভালোবাসা। এটাই আমারে প্রিয় নবীর (সা.) উত্তম আদর্শ। আমরা দেখি, যে মক্কা নগরী থেকে আল্লাহর নবী বিতাড়িত হলেন, ১০ বছর পর শত-সহস্র সাহাবায়ে কেরামের বিশাল বহর নিয়ে যখন পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করলেন, তখন তিনি বিজয় মিছিল-শোভাযাত্রা কিছুই করেননি। গর্ব-অহংকার করেননি, বাদ্য-বাজনা বাজাননি।

নবীজীর অবস্থা কী ছিল? আল্লামা ইবনুল কাইয়িম জাওযী (রহ.) তার গ্রন্থ ‘যাদুল মাআদে’ উল্লেখ করেন, আল্লাহর নবী একটি উষ্ট্রীর ওপর আরোহণাবস্থায় ছিলেন, তার চেহারা ছিল নিম্নগামী। (অর্থাৎ, আল্লাহর বরবারে বিনয়ের সাথে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন) সর্বপ্রথম তিনি উম্মে হানির ঘরে প্রবেশ করেন।সেখানে আট রাকাত নফল নামাজ আায় করেন। (এই নামাজকে বলা হয় বিজয়ের নামাজ।) এরপর নবীজী (সা.) হারাম শরিফে এসে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি বলেন, হে মক্কার কাফের সম্প্রদায়! তের বছর ধরে আমার ওপর, আমার পরিবারের ওপর, আমার সাহাবাদের ওপর নির্যাতনের যে স্টিম রোলার চালিয়েছ, এর বিপরীতে আজকে তোমাদের কী মনে হয়, তোমাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করব? তারা বলল, হ্যাঁ, আমরা কঠিন অপরাধী। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, আপনি আমাদের উদার ভাই, উদারসন্তান, আমাদের সাথে উদারতা, মহানুভবতা প্রদর্শন করবেন। এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। আল্লাহর নবী (সা.) বললেন- হ্যাঁ, আমি আজ তোমাদের সকলের জন্য হজরত ইউসুফ (আ.) এর মতো সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলাম। যাও তোমাদের থেকে কোনো প্রতিশোধ নেয়া হবে না। (সুনানে বাইহাকী: ৯/১১৮)।

এখানেই ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব, অনবদ্যতা, অনন্যতা। শান্তিপূর্ণভাবে মক্কা বিজয় করে মহানবী (সা.) পুরো বিশ্বকে এই শিক্ষাই দিলেন যে, আমরা শান্তির পক্ষে, বোমাবাজি, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, খুনাখুনি, ত্রাস এবং লুণ্ঠনের বিপক্ষে। আর মহানবীর (সা.) এই মহান আদর্শের ফলেই তো সাধারণ মানুষকে তিনি ফেরেশতায় রূপান্তর করেছিলেন।

পরিশেষে
কতই না চমৎকার মহানবীর (সা.) আদর্শ, বিশ্বস্ততা, একনিষ্ঠতা, সত্য, ন্যায় এবং ইসলামের শান্তির কথা বলে, কোটি কোটি হৃদয়কে আকর্ষিত করেছিলেন। সবাইকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে এনে দিয়েছিলেন প্রকৃত স্বাধীনতা। সমাজে তার (সা.) লড়াই ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠার লড়াই আর এ লড়াই তিনি করেছিলেন ভালোবাসার মাধ্যমে। মহান স্বাধীনতার এই দিনে আমরা স্মরণ করছি তাদের, যারা আত্মদান করে আমাদের দিয়েছেন স্বাধীন দেশ। এখন এদেশকে বিশ্বের মানচিত্রে উন্নত এক দেশ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখতে আমাদের প্রত্যেককে স্ব-স্ব ভূমিকা পালনে সদা তৎপর থাকতে হবে। মহান আল্লাহ-তাআলা আমাদের সকলকে স্বাধীনতার প্রকৃত মর্ম বোঝার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

এইচআর/বিএ/জেআইএম