সাপ্তাহিক ও ভাসমান হাট সাময়িক বন্ধ করা উচিত
সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী প্যানডেমিক বা মহামারি আকারে বিশ্বের প্রায় ১৯০টিরও বেশি দেশে আঘাত হানা করোনাভাইরাস সারাবিশ্বে প্রাণ নিয়েছে প্রায় ১৫ হাজারেরও বেশি। পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে বাদ যায়নি আমাদের প্রাণের স্বদেশ বাংলাদেশেও। অবশেষে সংক্রমণ যখন ঢুকেই পড়ল তখন হুশ হলো আমাদের। সরকার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে করোনা প্রতিরোধে প্রিভেনটিভ অ্যাক্টিভিটিস গ্রহণ করতে। রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় কোয়ারেন্টাইনসহ রয়েছে আইসোলেশন সেন্টারও। এ কথা অনস্বীকার্য যে, তৃতীয় বিশ্বের একটি দুর্বল অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ যেখানে লোকসংখ্যা ১৬৪.৭ মিলিয়ন বা ১৬.১৭ কোটি (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, সর্বশেষ হালনাগাদ ২ ডিসেম্বর, ২০১৮)। বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জনবহুল দেশ। প্রতি বর্গমাইলে ২৮৮৯ জন এবং প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১১১৫ জন বসবাস করে এ দেশটিতে। অথচ দেশটির মোট আয়তন ১৪৭৫৭০ বর্গকিলোমিটার। এত জনবহুল একটি ভূ-খণ্ডে করোনা আঘাত হানলে দেশটিতে সংক্রমণ কোন মাত্রায় গিয়ে ঠেকবে? প্রতিরোধ ছাড়া কোনো উপায় সেই।
সরকারি তত্ত্বাবধানে এদেশের সব সাপ্তাহিক হাট ও বিলাসবহুল বিপণিবিতানগুলো দেশ ও জাতির স্বার্থে বন্ধ করে দেয়া উচিত। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে দেশের সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞাপন জারি করে ৩১ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে সরকারের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ, যা প্রতিরোধ করতে পারে করোনার আক্রমণ বহুলাংশেই। কারণ পুরো জাতির একটা বিরাট অংশ প্রতিদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, কোচিং সেন্টার ও বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকে যেখানে প্রচুর জনসমাগম হয় এবং যেখান থেকে করোনা ব্যাপকভাবে ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। এ ছেলেমেয়েরাই আবার দিনশেষে ঘরে ফেরে। তারাই যদি করোনার ভাইরাসবাহী হয়, তবে তো দেশে একটা ভয়ংকর তাণ্ডবলীলা দেখা দেবে। তাই সরকার বন্ধ করে দিয়েছে সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
সরকার ইতোমধ্যে গণপরিবহন সীমিত করেছে। জনসমাগম এড়িয়ে চলার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু সবার আগে বাংলাদেশের চিরাচরিত ও দীর্ঘ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যের প্রথাধারণকারী গ্রাম-গ্রামাঞ্চলের সাপ্তাহিক হাটগুলো বন্ধ করা উচিত। কারণ এ হাটগুলোর কারণে অবিশ্বাস্যরকম মানুষের ভিড় হয়, উপচেপড়া ও শ্বাসরুদ্ধকর ভিড়ে মানুষে মানুষে সৃষ্ট ডিরেক্ট কন্টাক্ট, স্পর্শ থেকে করোনাভাইরাসের জীবাণুর ট্রান্সমিশন খুব সহজেই সম্ভব এবং এভাবেই তা ছড়িয়ে পড়তে পারে গোটা দেশব্যাপী। এ হাটগুলোর মাঝে রয়েছে ফ্লোটিং মার্কেট, ভাসমান কলার হাট, ভাসমান পেয়ারার হাট, জামদানির হাট, হলিডে হকার্স মার্কেট, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির হাট, গরু-ছাগলের হাট, কাপড়-চোপড়ের হাট, সাপ্তাহিক মাছের বাজার, সাপ্তাহিক মাংসের বাজার, সাপ্তাহিক গাড়ির হাট, সাপ্তাহিক সীমান্ত হাট, সাপ্তাহিক শাড়ি মেলা, কাতান শাড়ি মেলা, টাঙ্গাইল শাড়ি মেলা, সাপ্তাহিক বেনারসী মেলা, সাপ্তাহিক কাঠের বাজার, সাপ্তাহিক ফার্নিচার মেলা, সাপ্তাহিক ফুটপাত ইত্যাদি। যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ নিম্ন আয়ের, এই সমস্ত হাটও জমে ওঠে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের ভিড়। নিম্নে আমি এ রকম কয়েকটি হাটের কথা তুলে ধরছি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের বীরগাঁও ইউনিয়ন মেঘনা নদীর তীরের শতবর্ষী এক বিরাট গরু-ছাগলের হাট যার নাম বাইশমৌজা বাজার। ঐতিহ্যবাহী এই বাজারটির বয়স প্রায় ২০০ বছর। এই বাজারটির নাম আগে ছিল আছি মাহমুদের বাজার। বাজারটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুই উপজেলার বিবাদের বিষয়ও বটে । নবীনগরের সঙ্গে মেঘনা নদীর অপর পাড়ের আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুরের সাথে বিবাদ লেগেই থাকত। পরবর্তীতে সম্মিলিত সিদ্ধান্তে নবীনগর উপজেলায় মেঘনা নদীর তীরে এই বাজারের নামকরণ করা হয় ‘বাইশমৌজা বাজার’। এ উপজেলার বীরগাঁও ও কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের ২২টি গ্রামের সম্মিলন করে এর নামককরণ করা হয় বাইশমৌজা বাজার। সপ্তাহে শনিবার ও মঙ্গলবার বসে এটি। এই সাপ্তাহিক হাটে আসে বহু দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতা ও বিক্রেতাগণ যেমন- অষ্টগ্রাম, ইটনা, মিঠামইন, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা, পূর্বধলা, কিশোরগঞ্জ, ভৈরব, রায়পুরা, মনোহরদী, নরসিংদী, গোপালদী, বাঞ্ছারামপুর, আড়াইহাজার, সরাইল, নাসিরনগর, লাখাইসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকাররা। এছাড়া সাধারণ ক্রেতা তো আছেই। বাজারটিতে যাতায়াতের একমাত্র বাহন হলো নৌকা। যেদিক দিয়ে যাওয়া হোক না কেন নৌকা ছাড়া উপায় নেই। মানুষ, পশু ও মালামাল একই নৌকায় আনা-নেয়া করছেন মাঝিরা। এখন প্রশ্ন হলো শত ঐতিহ্যের ধারক-বাহক এ বাজারটি দেশের অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখছে । কিন্তু যে ভয়াবহ সংকট আমাদের মাথার ওপর শিরে সংক্রান্তি হিসেবে উপস্থিত হয়েছে, সপ্তাহের দুদিন যদি এত লোক সমাগম হয় এ বাজারে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সমবেত ক্রেতা-বিক্রেতার এই যে এক বিশাল সম্মিলন, তা থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং তা ধীরে ধীরে গোটা দেশে প্রসার রোধে এই বাজারটি কি সাময়িক বন্ধের যৌক্তিক দাবি রাখে না?
তেমনি একটি ব্রাক্ষণবাড়িয়ার কসবার সীমান্ত হাট। বাংলাদেশ ভারত দু-দেশের মধ্যকার মৈত্রী হাট। প্রচুর লোক সমাগম হয় এ হাটটিতে। দুই দেশের লোকজনেরই উপস্থিতি মিলে এ হাটে। যদিও তা ইতোমধ্যে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। জানা যায়, কলেজ বন্ধ রেখে শিক্ষা কার্যক্রম বিনষ্ট করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের চাতলপাড় ডিগ্রি কলেজ মাঠে বসানো হয় সাপ্তাহিক গরু-ছাগলের হাট। যেখানে প্রচুর লোক সমাগম হয়। এ নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক ও দ্বন্দ্বও, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ এলাকাবাসীর মধ্যে চরম অসন্তোষও রয়েছে। এটিও একটি নিয়মিত লোকসমাগমের জায়গা। এটিও যদি বন্ধ করা যেত, তাহলে একদিকে বেঁচে যেত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠনিটি অন্যদিকে আপদকালীন করোনা ঠেকাতে নিঃসন্দেহে সহযোগিতা হত।
খুলনা বিভাগের বাগেরহাট-খুলনা-মংলা মহাসড়কের দুই পাশে বিভিন্ন স্থানের অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় ঝুঁকিপূর্ণ হাট বসছে বছরের পর বছর। এর মধ্যে দিগরাজ, ভাগা, গুনাই, সিঅ্যান্ডবি বাজারসহ বিভিন্ন পয়েন্টে ব্যস্ততম এ সড়ক ঘেঁষে নিয়মিত বাজার বসায় যানবাহন চলাচলে ভোগান্তি তীব্র ভোগান্তি ও যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। আবার ব্যাপকহারে দুর্ঘটনাও ঘটছে অহরহ। ঢাকার তেজগাঁও ও কারওয়ানবাজারেও গাজীপুরে টঙ্গীতে রেললাইন ঘেঁষে মৎস্য ও তরিতরকারির বাজার যেভাবে অতি ঝুঁকি নিয়ে চলছে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, তা থেকে সৃষ্ট ভিড়ে সংকটময় সময়ে করোনাভাইরাস ছড়াবে নিঃসন্দেহে।
এ রকম ভাসমান বাজার, সাপ্তাহিক হাট বাংলাদেশে ভুড়ি ভুড়ি। কয়টার নামই বা আমি জানি, কয়টাই বা আমি দেখছি। আমি জানি তার ভিড়ের ভয়াবহতা-ই বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। চুয়াডাঙ্গায় রয়েছে ভগিরথপুর হাট, কুড়ালগাছি হাট, সরোজগঞ্জ বাজার, বদরগঞ্জ বাজার, কুতুবপুর বাজার, নয় মাইল বাজার, ডুগডুগী পশুহাট, ডুগডুগী শুক্রবারের তরকারি হাট, কুমারী সাপ্তাহিক হাট, দুর্লভপুর সাপ্তাহিক হাট, জয়রামপুর স্টেশন হাট, কার্পাসডাঙ্গা হাট, দামুড়হুদা হাট, গোবিন্দহুদা হাট, জগন্নাথপুর হাট, ঠাকুরপুর হাট, বড়বলদিয়া হাট, মদনাদহ হাট, ওসমানপুর সাপ্তাহিক হাট। তেমনি করে পঞ্চগড়ে রয়েছে সাপ্তাহিক ভাসমান হাট যেমন: জয়বাংলা হাট, ঠেকরপাড়া হাট, দলুয়া হাট, আমকাঠাল হাট, আমলাহার হাট, কহুরুর হাট, কাজির হাট, গলেহা হাট, গোয়ালঝাড় হাট, চাকলাহাট, জগদল হাট, পেত্নীর হাট, পুরাতন বোর্ড অফিস হাট, পুখুরীডাংগা হাট, টুনির হাট, ঢাংগীপুখুরী হাট, পানিমাছ পুকুরী হাট, ঝলই হাট, দেওয়ান হাট, দশ মাইল হাট, তালমা হাট, জিয়াবাড়ী হাট, ভাউলাগঞ্জ হাট, গাজোকাটি হাট, ডাডুয়ার হাট, ক্লাবগঞ্জ হাট, বাগদহ বাজার, শীবের হাট, নতুন হাট, চেংঠীহাট, সিকটিহারী হাট, লীলার বাজার হাট, লক্ষ্মীরহাট, খোচাবাড়ী হাট, টোকরাভাষা রামগঞ্জ বিলাসী হাট, শালডাঙ্গা হাট, কালীবাড়ি বাজার, দেবীগঞ্জ হাট, ঢাঙ্গীর হাট, শান্তিরহাট, ফুলবাড়ী হাট, জগন্নাথ হাট, টেপ্রীগঞ্জ হাট, শেখবাধা ফুলবাড়ী হাট, কালীগঞ্জ হাট, খোগের হাট, গুঞ্জরমারী, চুচুলী বটতলী হাট, তোড়িয়া হাট, দিঘীরকোন হাট, ধামোর হাট, নুনুমন্ডল হাট, পাটশিরি হাট, বারঘাটি হাট, রাখালদেবী হাট, রাণীগঞ্জ হাট, সিপাইপাড়া বাজার, তিরনই বাজার চড়ক ডাংগী বাজার, বুড়াবুড়ি বাজার, ভজনপুর বাজার, ডুংডুংগী বাজার, দেবনগড় বাজার, আমজুয়ানী বাজার, মাগুড়মারী চৌরাস্তা বাজার, রনচন্ডি বাজার, শালবাহান বাজার, কালান্দিগছ রোড বাজার, কালান্দিগছ বাজার, সিরাজনগর বাজার, মুহুরী বাজার, শিলাইকুঠি বাজার । তেমনি রয়েছে কুমিল্লার নিমসার কাঁচাবাজার। ইহা একটি বিশাল কাঁচাবাজার ও তরকারির হাট। কুমিল্লার মুরাদনগর থানার রামচন্দ্রপুর বাজারও একটি বিরাট জনসমাগম কেন্দ্র। রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের কালিকচ্ছ বাজার। এ জেলারই নাসিরনগর উপজেলার ফান্দাউক বাজার ও কসবা উপজেলার কুটিবাজার ও আখাউড়া উপজেলার ধরখার ও তন্তর বাজার।
আরও রয়েছে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার হাট, গোপালদী হাট, নরসিংদীর মাধবদীবাজার ও শেখেচর বাজার। শেখেরচর বাজার যা প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার খ্যাত উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ কাপড়চোপড়ের পাইকারী হাট। সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার এ বাজার বসে। সারাদেশের খুচরা পোশাক বিক্রেতাদের সর্ববৃহৎ মোকাম হলো বাবুরহাট শেখেরচর। এখানে সপ্তাহের এ তিন দিন প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক লোক সমাগম হয় এ বাজারে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পার্শ্বে অবস্থিত এ বাজারে প্রতি সপ্তাহে চার থেকে পাঁচশ কোটি টাকার লেনদেন হয়। কিন্ত জনসমাগমের কথা চিন্তা করে করোনা মোকাবিলায় মানুষেড় ভিড় এড়াতে এসব বাজার সাময়িক বন্ধ করে দেয়া উচিত। মানুষের ভিড় ওই অঞ্চলে হাঁটাই যায় না। প্রতি বর্গফুটে মানুষের ভিড় অবিশ্বাস্য। মানুষের সাথে মানুষের ঘেষাঘেষি, ধাক্কাধাক্কি করে পথ চলতে হয়। একইভাবে মাধবদী বাজার সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার। এ যেন হঠাৎ কোন পল্টন ময়দান। মানুষ আর মানুষ। কোথা থেকে যে এত মানুষের মহাসমাবেশ আর মহামিলন ঘটে। রাস্তায় কোনো মানুষকে স্বাভাবিক হাঁটতে দেখা যায় না। সবাই শুধু দৌড়ায়। কিসের নেশায়, কিসের পিছে ছুটছে মানুষ, বোঝা বড় দায়। কারোর যেন হাতে সময় নেই। কেউ কারও দিকে তাকাবার ফুরসত নেই। এত ব্যস্ত আর এত মানুষ। এ বাজারটিও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখলেও আপতত সংকটকালীন করোনাভাইরাস ছড়ানোর ক্ষেত্রে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
সপ্তাহের প্রতি সোমবার নরসিংদীর মাধবদী বাজারে সারাদিনব্যাপী বসে ভাসমান হাট। সর্বসাধারণের চলাচলের যে রাস্তা, সে রাস্তার ওপরই বসে এই হাট। এই হাটটি সম্পূর্ণই কাঁচামাল আর মুদি মনোহারী দ্রব্যাদির। পুরা পৌরসভার রাস্তাঘাটেই এই হাট। মোটামুটি সারাদেশ থেকেই এখানে লোকজন ভিড় করে। সারাদিনে কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয় এই হাটে। নিঃসন্দেহে তা জিডিপিতে প্রভাব ফেলে এবং দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে দেশের এক প্রান্ত থেকে আংশিক হলেও অবদান রাখে। এবার বলি এ হাটে ভিড়ের বর্ণনা। মানুষের সাথে মানুষের গাঁদাগাঁদি এতটাই বেশি হয় যে, মাঝে সাঝে পদদলিত হওয়ার উপক্রমও হয়। প্রচণ্ড ভিড়ে, গরমে, ঘামে একাকার হয়ে লেপটে যাওয়ার মতো অবস্থা। এ যদি হয় অবস্থা তাহলে সেখান থেকে কী পরিমাণ ভাইরাস হিউম্যান টু হিউম্যান ট্রান্সমিশন।
দেশে এত করোনার প্রকোপ গোটা বিশ্বে যখন মৃত্যুর মিছিল ও শোকের মাতম, তখন কীভাবে ঠিক গতকালও অর্থাৎ ২৩ তারিখেও এই হাট অনুষ্ঠিত হয় এবং লোকে লোকারণ্য। যখন সরকারি হিসাব মতে এদেশে করোনায় ঘোষিত মৃতের সংখ্যা ৪ এবং আক্রান্তের সংখ্যা ৩৩, গোটা বিশ্বে করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা প্রায় ১৫ এবং আক্রান্ত প্রায় ৪ লাখ এবং বিশ্বজুড়ে জনসমাগম এড়িয়ে চলার আহ্বান সবার কানে পৌঁছে গেছে, হুঁশিয়ারি বাণী যখন তুঙ্গে, তখন কীভাবে এত বড় একটি হাট যেখানে আনুমানিক রাউন্ড দ্য ক্লক ২৫/৩০ হাজার লোকের সমাগম হয়, সেখানে কেমন করে এত বড় একটা হাট বসলো? বাঙালির হুঁশ আসলে কবে হবে? কবে জাগবে আমাদের চৈতন্যবোধ? যেখানে আমার দেশের সরকার জাতীয় স্বার্থে এবং এই কঠিন দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশের সকল স্কুল-কলেজ আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ দিয়েছে শুধু মানুষের সামাজিক সংস্পর্শ রোধ করেতে এবং করোনা নামক ভয়াবহ ভাইরাসের দ্রুত বিস্তার রোধ করতে, সেখানে আমরা কেন আজও থামছি না জনসমাগম থেকে। আইন করে, লাঠিচার্জ করে, সেনা মোতায়েন করে কন্ট্রোল না করলে কি আমাদের পরিবর্তন সম্ভব নয়? আমাদের সিভিক সেন্স কবে যে ডেভেলপ করবে! এই প্রাদুর্ভাবের ভয়াবহতা কি বাঙালির আজও বোঝার বাকি? আমাদের ইতালি থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত।
আশার দিক হলো গতকাল দৈনিক প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় দেখলাম এমনই একটি ঘোষণা যা নিয়ে আমি ভাবছি এবং আমার আজকের লেখা। ‘২৫ থেকে ৩১ মার্চ বিপণিবিতান-মার্কেট সাত দিন বন্ধ থাকবে’। যদি তা সরকারি আদেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পালিত হয়, তাহলে হয়তো করোনা মোকাবিলা খানিকটা সহজতর হবে এই হাইপার ডেনসিটির বাঙালির পক্ষে। অন্যথায় হিউম্যান টু হিউম্যান ডিরেক্ট কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে ভাইরাসটি ট্রান্সমিট হয়ে ছড়িয়ে পড়বে জ্যমিতিক হারে। এত লোক সমাগম, এত পরিচ্ছন্নতা জ্ঞানহীন জনগোষ্ঠী আমরা, কী যে হবে আমাদের ভেবে পাই না। ভালো করে ভাবলেই অস্থির লাগে। ম্যাথমেটিক্সের ভাষায় এক্সপোনেনশিয়াল রেট বলতে আমি বুঝি দুই থেকে চার, চার থেকে আট, আট থেকে ষোল, ষোল থেকে বত্রিশ, বত্রিশ তেকে চৌষট্টি- এভাবে বাড়তে থাকে ।
নিম্নে একটি ছকের মাধ্যমে আমরা যদি এক্সপোনেনশিয়াল গ্রোথকে দেখাই তাহলে দেখা যাবে একজন ব্যক্তি থেকে ছড়িয়ে তা বহুগুণে বেড়ে যায় কীভাবে। আর করোনাভাইরাস ঠিক এভাবেই ছড়াচ্ছে কারণ একজন থেকে দুইজন, দুইজন থেকে চারজন এভাবেই দ্রুত বিস্তার লাভ করছে।
আল্লাহ মাফ করুক। আল্লাহ পাক রাববুল আলামিন পৃথিবীর মানুষের ওপর রহমত নাজিল করুক। এইভাবে যদি বাড়তে থাকে তাহলে আমাদের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?। আমরা চাই না এভাবে দেশে সংক্রমণের মাত্রা বৃদ্ধি পাক। আমরা তা রুখবোই ইনশাআল্লাহ। আমাদের রয়েছে দৃঢ় মনোবল ও অগাধ দেশপ্রেম। আমাদের উচিত সরকারকে কো-অপারেট করা যার যার লেভেল থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণে ঠিক যেমনটা এ মুহূর্তে প্রয়োজন। গোটা দেশ এখন ভীষণ বিভীষিকাময় একটা পরিস্থিতির ওপর কাটাচ্ছে। দেশ কেন, গোটা পৃথিবী। স্থানিক এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতি। কার কুলে মাথা ঠেকাব? মায়ের না বাবার? ভাইয়ের না বোনের? স্বামীর না স্ত্রীর? কেউতো তো নিরাপদ না। সবাই সবাইকে সাহায্য করুন। তাই বলে বাইরে গিয়ে নয়, ঘরে বসে। প্রতিষেধক নয়, প্রতিরোধই হতে পারে স্থায়ী চিকিৎসা। আপনিই পারেন আপনাকে বাঁচাতে, সেই সাথে আপনার পরিজনকেও। আমাদের সবারই দায় আছে, শুধুমাত্র সরকারের একারই দায়িত্ব নয়। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশ কানাডা বা জার্মানি নয়। এটা প্রায় ষোল মতান্তরে সতের কোটি মানুষের জনবহুল একটি দেশ। এখানে ডিসাস্টার বা ক্যালামিটি বা এপিডেমিক বা প্যানডেমিক মোকাবিলা করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। সরকারের পাশাপাশি জনগণও যদি এ দুর্যোগে সরকারকে সাহায্য করতে এগিয়ে না আসে, তবে ভুগতে হবে আমাদের নিজেদেরই।
করোনা বোঝে না জাত আর অজাত। করোনা করছে না করুণা, না শিশু না বৃদ্ধ, না গরিব না ধনী, না হুজুর না পাদ্রী, না হিন্দু না মুসলিম, না বৌদ্ধ না খ্রিস্টান, না ক্যাথলিক, না পণ্ডিত না মূর্খ ,না নাপিত না ফুলবাবু, না কসাই না মুচি, না কমিশন্ড না নন-কমিশন্ড, না মেজর না কর্নেল, না পুলিশ না ক্রিমিনাল, না মালিক না শ্রমিক- কারও প্রতিই না। করোনা কাউকে চেনে না। জাতভেদ, বর্ণভেদ বোঝে না সে। কি রাজা কি প্রজা, কি মন্ত্রী কি আমজনতা, কি ব্যবসায়ী কি আমলা, কি ডাক্তার কি কবিরাজ, কি ক্ষমতাান কি ক্ষমতাহীন, কি শিক্ষক কি ছাত্র, কি কৃষ্ণাঙ্গ কি শেতাঙ্গ, কি কুলি কি মজুর, কি আস্তিক কি নাস্তিক- কাউকে চেনে না। অতএব, কী উপায় এর থেকে বাঁচার? একমাত্র প্রতিরোধ। দুর্বার হাতে গড়ে তুলি প্রতিরোধ। স্টে হোম, স্টে সেফ হোক- আমদের প্রত্যয়দীপ্ত অঙ্গীকার, যতক্ষণ না পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসে।
সরকারের কাছে আমার প্রাণের দারি- অন্তত আপদকালীন সংকট নিরসনের লক্ষ্যে আপনাদের নেয়া প্রতিটি প্রশংসনীয় উদ্যোগের পাশাপাশি একবারে প্রজ্ঞাপন বা রুল জারি করে সাময়িক কালের জন্য এইসব সাপ্তাহিক ও ভাসমান হাটগুলো বন্ধ করে দেয়া হোক। তাহলে অবিস্মরণীয়ভাবে জনসমাগম রোধ হবে এবং আমরা করোনা রুখতে সফল হব ইনশাআল্লাহ। সেই সাথে আধুনিক ও বিলাসবহুল বিপণিবিতানগুলো যেমন- বসুন্ধরা সিটি, সীমান্ত স্কয়ার (সাবেক রাইফেলস স্কয়ার), ইস্টার্ন প্লাজা, ইস্টার্ন মল্লিকা, ঢাকা নিউ মার্কেট, চাঁদনীচক, নীলক্ষেত, বদরুদ্দোজা সুপার মার্কেট। আনাম র্যাংগস প্লাজা, ক্যাপিটাল প্লাজা, ফরচুন স্কয়ার, মাসকাট প্লাজা, নর্থ টাওয়ার, গাউছিয়া মার্কেট, মৌচাক মার্কেট, আনারকলি মার্কেট, আয়েশা শপিং কমপ্লেক্স. যমুনা ফিউচার পার্ক, কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি, গুলিস্তান ঢাকা ট্রেড সেন্টার, বঙ্গবাজার, গুলিস্তান হকার্স মার্কেট, খিলগাঁও তালতলা মার্কেট, মিরপুর শাহ আলী সুপার মার্কেট, শান্তিনগর টুইন টাওয়ার, ওয়ারী রাজধানী সুপার মার্কেট, জেনেটিক প্লাজা, সানরাইজ প্লাজা, মিরপুর বেনারশী পল্লী, মেট্রো শপিংমল, পুলিশ প্লাজা কনকর্ড, রাপা প্লাজা, পিংক সিটি গুলশান, ডিএনসিসি মার্কেট গুলশান, সিটি হার্ট শপিং কমপ্লেক্সসহ সারাদেশের এমন অসংখ্য বিলাসবহুল বিপণিবিতান ও যেখানে প্রচুর জনসমাগম হয় এবং প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে মানুষ সেখানে ভিড় জমায়। এই মার্কেটগুলো মানুষের জন্য একটা বিনোদনকেন্দ্রও বটে।
প্রজ্ঞাপন জারি করে এগুলো সাময়িক বন্ধ না করলে এখোনে মানুষ যাবেই। কারণ আমরা বাঙালি, আমাদের চিরকালই ছোটবেলা থেকেই বেত্রাঘাত করে পড়াতে হয়েছে, আমরা এমনি এমনি পড়তে চাইনি। আমাদের কাঁঠাল কিলায়ে পাঁকাতে হয়। এমনি এমনি পাকে না। আমাদের বোধোদয় আজও হয়নি। আমাদের মূল্যবোধ ও নৈতিকতার মানদণ্ড আজও উন্নত হয়নি। অথচ রাষ্ট্রের আদেশ মানা দেশপ্রেমেরই নামান্তর এবং রাষ্ট্রীয় আদেশ না মানা রাষ্ট্রদ্রোহীতারই নামান্তর। সরকারকে সাহায্য করুন এহেন জাতীয় তথা বৈশ্বিক দুর্যোগ মোকাবিলায়। দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমের স্পিরিটে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন, মেতে উঠুন মানবতায়, জেগে উঠুন ভালোবাসায়, আসুন দেশটাকে বাঁচাই, শুধু একটু কম্প্লাই করি রাষ্ট্রীয় আদেশ নিষেধের সাথে। আপনার একটু সহযোগিতা বাঁচাতে পারে অনেকের জীবন। আর আপনার নির্লিপ্ততা, গড্ডালিকা প্রবাহ, রিলাক্টেন্সি ও উদাসীনতা, কেয়ারলেসনেস ও অসতর্কতা ঘটাতে পারে আপনারই প্রিয়জনের অকাল প্রয়ান।
বাঙালির বোধোদয় হোক, উদয় হোক শুভবুদ্ধির, জেগে উঠুক সুকোমল মানসিকতা ও দেশপ্রেম, জেগে উঠুক ভাতৃত্ববোধ ও ভালোবাসা। উন্নত প্রলেপে গড়ে উঠুক আমাদের সিভিক সেন্স ও মিউচুয়াল রেসপেক্ট।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক।
এইচআর/বিএ/পিআর