ছোঁয়াচে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে কার কী করণীয়
ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী
ভয়ানক ছোঁয়াচে করোনা ভাইরাসের ইতিবৃত্ত
ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রাক্কালে ৬০’র দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কলেরা জীবাণুর মাধ্যমে জীবাণু যুদ্ধের বিস্তারের জন্য ব্যাপক গবেষণা করছিল ঢাকার মহাখালীর সিয়োটা কলেরা ল্যাবরেটরিতে, যা বর্তমানে আইসিডিডিআরবি নামে বিশ্বখ্যাত।
এই শতাব্দীর প্রথম দশক থেকে সার্স-করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত গবেষণা চলছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের উহানের গবেষণাগারে। জনশ্রুতি আছে, জীবাণু যুদ্ধে ভাইরাস ব্যবহারের উপযোগিতা পরীক্ষা ছিল মূল লক্ষ্য।
কথিত আছে প্রাণী থেকে করোনাভাইরাস গত নভেম্বর মাসে মানুষে সংক্রমিত হয়। সার্স ভাইরাস ৩৮৪ বার পরিবর্তিত হয়ে নভেল করোনা কোভিড-১৯ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ রোগকে কোভিড-১৯ নামকরণ করে ২০২০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এবং কোভিড-১৯ মহামারি হিসেবে ঘোষণা দেয় ১১ মার্চ।
কোভিড-১৯ অন্যান্য ভাইরাস থেকে অপেক্ষাকৃত বড় এবং ভয়ানক ছোঁয়াচে, মানুষ থেকে মানুষে অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এক রাষ্ট্র থেকে অন্য রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ প্রবাসী নাগরিকদের দেশে প্রত্যাবর্তন, বিনোদন বা পরিজনের সঙ্গে সময় যাপনের জন্য আগমন।
কোভিড-১৯ এর উপসর্গগুলো হচ্ছে— জ্বর, কফ-কাশি, হাঁচি, মাংসপেশীর বেদনা, গলাদাহ, যা দুই থেকে ১৪ দিনের মধ্যে ফুসফুসের সমস্যা সৃষ্টি করে। দ্রুত চিকিৎসা না হলে স্পঞ্জি ফুসফুস শ্লেটের মতো শক্ত হয়ে যায়।
১৭ মার্চ পর্যন্ত ৭ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি কোভিড-১৯ রোগীর মৃত্যু হয়েছে ১৭০টি দেশে এবং আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে চীন, কোরিয়া, ইরান, ইতালি, স্পেন ও ফ্রান্সে। বাংলাদেশে প্রমাণিত কোভিড-১৯ রোগী এখন পর্যন্ত ১৪ জন এবং একজন মারা গেছেন। বাংলাদেশে এ রোগে আক্রান্তদের সংখ্যা যে লাফিয়ে বেড়ে যাবে না তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। তবে সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
১. বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর প্রবেশদ্বার
ক. ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চার হাজার কিলোমিটারের বেশি সীমান্ত রয়েছে। বিভিন্ন পথে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা যায়। প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ যাতায়াত করেন। কয়েকশ ভারতীয় ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করে। পুরো বিষয়টির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সক্ষমতা অর্জন করা দরকার। প্রয়োজন কঠোর স্ক্রিনিং। ভারতীয়রা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারলেও, ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা দেশে ফিরছেন। স্ক্রিনিং ঠিক মতো না হওয়ায় বিপদের আশঙ্কা বাড়ছে।
খ. বাংলাদেশের সব কারাগারের মিলিত বন্দি ধারণক্ষমতা ৪০ হাজারের চেয়ে কিছু বেশি। কিন্তু, রাজনৈতিক হয়রানি, পুলিশের ঘুষ বাণিজ্য ও আইন শৃঙ্খলার অবনতির কারণে কারাবন্দি আছেন প্রায় ৯০ হাজার। কারাগারের জনাকীর্ণতা কোভিড-১৯ এর জন্য উন্মুক্ত দ্বার সৃষ্টি করতে পারে। প্রতিকার হিসেবে সরকারের উচিত হবে ফাঁসির আসামি, যাবজ্জীবন ও ১০ বৎসরের অধিক দণ্ডপ্রাপ্ত ছাড়া অন্য সকল দণ্ডপ্রাপ্ত অভিযুক্তদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে মুক্তি দিয়ে দেওয়া এবং বুঝিয়ে বলা পরিবারের বাইরে যেন বেশি বিচরণ না করেন।
গ. সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কয়েক লাখ বিপদগ্রস্ত মানুষ ও উকিল-মুহুরি ও অন্যান্য কর্মচারী আদালত প্রাঙ্গণ থেকে শুরু করে এজলাস পর্যন্ত ভয়ানক ভিড় করে থাকেন। একে অপরের গায়ে প্রায় লেগে থাকেন। আদালতে এত মামলার মূল কারণ রাজনৈতিক হয়রানি ও পুলিশের অনৈতিক ঘুষবাণিজ্য।
কোভিড-১৯ এর ছোঁয়াচে সংক্রমণকে বিবেচনায় নিয়ে উচিত হবে ৭০ ভাগ অভিযুক্তদের ২০৫ ধারায় কোর্টে উপস্থিতি থেকে রেহাই দেওয়া যতদিন না মামলার চূড়ান্ত শুনানি শুরু হয়। দ্বিতীয়ত: অন্যদের ক্ষেত্রে সকল মামলার শুনানি ও উপস্থিতির জন্য তিন মাস অন্তর তারিখ দেওয়া।
ঘ. রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বাড়ানো প্রয়োজন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো অত্যন্ত জনাকীর্ণ এবং ক্যাম্পে সাধারণ জীবন যাপনের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। রোহিঙ্গারা যেন ক্যাম্পের বাইরে না আসে, সেদিকে যেমন লক্ষ্য রাখতে হবে, একইভাবে স্থানীয় জনসাধারণের ক্যাম্পে প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
২. সব ধর্মের প্রার্থনা স্থানের প্রবেশ পথে ৬-১০ ইঞ্চি দূর থেকে ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা নির্ণয় করা উপযুক্ত কাজ হবে। খুতবায় কোভিড-১৯ সম্পর্কে তথ্য দিতে হবে, গুজব না ছড়িয়ে বা গুজবে কান না দিয়ে পাড়া-প্রতিবেশীদের বিদেশ প্রত্যাগত আত্মীয়-স্বজনকে ১৪ দিন আলাদা রাখার পরামর্শ দিতে হবে। একইভাবে বাড়ির সবাইকে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধোয়া ও কনুই পর্যন্ত ধুয়ে অজু করার পদ্ধতি অনুসরণ করতে অনুপ্রাণিত করতে হবে। করমর্দন ও আলিঙ্গন পরিহার করতে হবে, না ছুঁয়ে সালাম দেওয়ার অভ্যাস করতে হবে—হ্যান্ডসেক নয়, সালাম দিন।
৩. বাস-ট্রেন স্টেশন, বন্দর, বাজার ও লঞ্চঘাটে যাত্রীদের তাপমাত্রা পরীক্ষা করার উদ্যোগ নিন হাতে ধরা ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে। এবং বাড়িতে ফিরে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুতে হবে।
৪. প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশের সমৃদ্ধির যোগানদার। প্রায় এক কোটি প্রবাসীর মধ্যে ২৫ লাখ চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, ফার্মাসিস্ট, আইটি পেশাজীবী, শিক্ষক, ব্যবসায়ী স্থায়ীভাবে বিদেশে বসবাস করেন। এরা তাদের উদ্বৃত্ত সম্পদ বিদেশে রাখেন। দেশে পাঠান না। বাকি প্রায় ৭৫ লাখ সাধারণ শ্রমজীবী প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রায় ১০০টি দেশে কঠিন শ্রমদিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। প্রতি তিন-চার বছর পরপর তারা স্ত্রী-পুত্র পরিজন ও আত্মীয়দের দেখার জন্য দেশে ফিরেন ১০ থেকে ৪০ ঘণ্টা উড়োজাহাজে ভ্রমণ করে।
কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে বিমানবন্দরে পৌঁছার পর তাদেরকে কোয়ারেন্টিনে রাখা বিজ্ঞানসম্মত। তারা যদিও ‘নবাবজাদার অর্ভথ্যনা’ প্রত্যাশা করেন না, তবে সরকারের নৈতিক দায়িত্ব হবে যে, তাদেরকে ১৪ দিন আহার-বিশ্রামের জন্য পাঁচ তারকা অর্ভথ্যনা ও সুযোগ সুবিধা দেওয়া। তাদেরকে আইসোলেশনের বৈজ্ঞানিক কারণ ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়া, যাতে বাড়ির বাইরে ১৪ দিন ঘোরাফেরা না করেন। জরিমানা করা অমানবিক কাজ।
৫. পৃথিবীর প্রায় সব দেশ কঠিন সমস্যায় পড়েছে, বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। তবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে দুর্বলতা হচ্ছে— হাসপাতাল, ক্লিনিক নামক অজস্র ভবন আছে, কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত জনবল নেই সরকারি ভুল নীতিমালার কারণে।
বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) রিভার্স পলিসারজ চেইন রিমত্র্যাকসন পরিচালনায় দক্ষ ৫০ জন ভাইরোলজিস্ট, এনটোমোলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট নেই।
সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ল্যাবরেটরিতে উন্নতমানের পিসিআর নেই। সর্বোপরি বাংলাদেশে মেডিকেল যন্ত্রপাতির ওপর অদ্ভুত ধরনের অতিরিক্ত শুল্ক ও বিবিধ ট্যাক্সের প্রয়োগের নিয়ম প্রযোজ্য আছে। মেডিকেল শয্যার ওপর সর্বমোট ট্যাক্স হচ্ছে ৫৮ শতাংশ, গ্যাস এনালাইসিস, ভেন্টিলেটর, থার্মোমিটার অক্সিজেনের সিলিন্ডারের ওপর ধার্য সর্বমোট শুল্ক হচ্ছে ৩১ শতাংশ। এছাড়াও, বিভিন্ন কর্মকর্তাদের খুশি করার জন্য অন্যান্য উপরি ব্যয় তো আছেই।
সকল মেডিকেল যন্ত্রপাতি এবং প্রয়োজনীয় রি-এজেন্ট ও সামগ্রীর শুল্ক শূন্য করা সরকারের আশু দায়িত্ব। সকল প্রবেশ পথে পর্যাপ্ত স্ক্যানার ছাড়াও কমপক্ষে ২০-৩০টা হাতে ধরা ইনফ্রারেড থার্মোমিটারের ব্যবস্থা থাকা উচিত। তিন শিফটে কাজ হবার মতো স্বাস্থ্যকর্মীর ব্যবস্থা রাখতে হবে।
পত্রিকান্তরে খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভান্ডারে মাত্র ১ হাজার ৭৩২টি কোভিড-১৯ জীবাণু পরীক্ষার কিট আছে। আইইডিসিআর কোভিড-১৯ শনাক্ত করার জন্য মাত্র ২৬৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করেছে, যা অত্যন্ত অপ্রতুল। যেকোনো একটি উপসর্গ থাকলেই চিন্তিত রোগীর নমুনা পরীক্ষা প্রয়োজন। প্রস্তুতি থাকতে হবে মাসে কয়েক লাখ সম্ভাব্য রোগীর নমুনা পরীক্ষার। সম্প্রতি আর্ন্তজাতিক স্বাস্থ্য সাময়িকী দি ল্যানসেটে ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে কোভিড-১৯ ভাইরাসের বিস্তৃতির তথ্য প্রকাশ হয়েছে।
সরকারকে অনতিবিলম্বে আগামী এক মাসের মধ্যে এক লাখ চিকিৎসক ও দুই লাখ নার্স-টেকনিশিয়ান, প্যারামেডিক ও ফিজিওথেরাপিস্টদের কয়েক ঘণ্টা করে করোনা রোগের ধরন, উপসর্গ বিস্তৃতি, রোগ নির্ণয় পদ্ধতি ও প্রতিরোধক ব্যবস্থা, ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, আলিঙ্গন না করে সালাম দেওয়ার অভ্যাস করা ও সম্ভাব্য রোগীকে দেখে ভয়ে পালিয়ে না যাবার জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে। শেখাতে হবে যে রোগীকে পরীক্ষা না করে পালানো, রাসুলুল্লাহর মতে যুদ্ধের মাঠ থেকে পলায়নতুল্য। চিকিৎসক ও নার্সদের ভালো করে হাত না ধোয়া সম্পর্কে বৃটিশ মেডিকেল জার্নালে একাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল কয়েক বছর আগে।
৬. সরকারি সহযোগিতা পেলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র এক মাসের মধ্যে কোভিড-১৯ নির্ণায়ক গণস্বাস্থ্য র্যাপিড ডট ব্লট বাজারজাত করবে। ড. বিজন কুমার শীল যিনি সিঙ্গাপুরে ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাস নির্ণায়ক— র্যাপিড ডট ব্লট উদ্ভাবন দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন, তিনি বর্তমানে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণস্বাস্থ্য অধ্যাপক ও ফার্মাসিউটিকেলসের প্রধান বিজ্ঞানী। ড. বিজন কুমার শীল ও তার তিন জন সহকারী ড. নিহাদ আদনান, ড. ফিরোজ আহমদ ও ড. বায়জিদ মিলে জমির উদ্দীন গণস্বাস্থ্য ল্যাবরেটরিতে অ্যান্টিবডিএসেজ (ইমমিউনোগ্লোবিন-এ, ইমমিউিগ্লোবিং- জি ও ইমিউনোগ্লোবিল-এম ইমমিউনোত্রসেজ) পদ্ধতি ব্যবহার করে কোভিড-১৯ ভাইরাস নির্ণায়ক পদ্ধতি র্যাপিড ডট ব্লট উদ্ভাবন করেছেন। সরকার দ্রুত বিভিন্ন করোনা ভাইরাস অ্যান্টিবডি, নিউ ক্লোপ্রোটিন, স্পাইন গ্লাইকোপ্রোটিন, করোনাভাইরাস এনভেলাপ প্রোটিন প্রভৃতি ইংল্যান্ড থেকে সংগ্রহের অনুমতি দিলে বাজারজাতকরণের জন্য পর্যাপ্ত র্যাপিড ডট ব্লট প্রস্তুত হবে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে। প্রতিটির উৎপাদন খরচ হবে ২০০ টাকা, সরকার শুল্ক, বিভিন্ন প্রকার ট্যাক্স ও ভ্যাট মওকুফ করে দিলে জনগণ মাত্র ৩০০ টাকায় পরীক্ষা করে কোভিড-১৯ সংক্রমণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে।
পিসিআর পদ্ধতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ভিজিট কন্ট্রোল র্যাপিড ডট ব্লট উদ্ভাবনের উদ্যোগ নিচ্ছে এবং গণস্বাস্থ্যের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
ছোঁয়াচে রোগের সূচনা
আফ্রিকার মুর মুসলমানরা তারিক বিন জাহিদের সেনাপতিত্বে ৭১১ খৃষ্টাব্দে জিব্রালটার বিজয় করে ক্রমে ৭২০ সালের মধ্যে পুরো স্পেন ও পুর্তগালে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করে এবং কর্ডোবায় রাজধানী স্থাপন করে। বর্তমানের বহুল প্রশংসিত কর্ডোবা ক্যাথেড্রাল ৭০০ বছর (৮০০-১৫০০ সাল) যাবৎ পরিচিত ছিল আকর্ষণীয় কর্ডোবা মসজিদ রূপে, যা স্থাপন করেছিলেন মুসলিম মুর শাসকরা। ১৫ শতাব্দীতে মুসলিম শাসনের পতন হলে স্পেনিয়ার্ডরা কর্ডোবা মসজিদের নতুন নামকরণ করে কর্ডোবা ক্যাথেড্রাল নামে। কর্ডোবা ক্যাথেড্রালের স্পেনীয় নাম হচ্ছে ‘দ্য মস্ক- মসজিদ’।
মুসলমাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও দ্বিধা বিভক্তির কারণে ১৪৯২ সালে স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। একই বছর পরিব্রাজক ক্রিস্টোফার কলম্বাস নতুন মহাদেশ আমেরিকা আবিষ্কার করে স্পেনে ফিরে আসেন, তিনি নতুন মহাদেশে দিয়ে আসেন ইউরোপের রোগ হাম, বসন্ত ও যৌন রোগ গনোরিয়া। সঙ্গে নিয়ে আসেন বিস্তর স্বর্ণখন্ড ও যৌন ছোঁয়াছে রোগ সিফিলিস। সিফিলিস রোগের জীবাণুর নাম ট্রেপেনোমা প্যালিডিয়াম। কলম্বাসের নাবিকদের অবাধ যৌন বিহার ও গণিকা পেশার মাধ্যমে সিফিলিস পুরো আন্দুলুসিয়া, পুর্তগাল ও ইতালিতে ছড়িয়ে পড়ে। ১৪৯৬ সালে ছড়িয়ে পড়ে ডেনমার্কে ও সুইজারল্যান্ডে। ফ্রান্সের সম্রাট অষ্টম চার্লস বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত বিরাট ভাড়াটে সেনাদল নিয়ে ১ সেপ্টেম্বর ১৪৯৫ সালে ইতালি প্রবেশ করেন, পথিমধ্যে ব্যাপক যৌন আমোদে অংশ নিয়ে নেপলস পৌঁছেন ১২ মে ১৪৯৫ সালে। প্যারিসে প্রত্যাবর্তন করেন জুলাই মাসে, সঙ্গে নিয়ে আসেন ‘রেঁনেশা জীবাণু’ যা ফ্রান্সে পরিচিত লাভ করে ‘নেপোলিয়ান ব্যামো’ বা ফরাসি ব্যামো নামে, যার দ্রুত বিস্তৃতি ঘটে জার্মানি ও উত্তর-পূর্ব ইউরোপে।
ভাস্কো দা গামা ১৪৯৭ সালের ৮ জুলাই বিরাট নৌবহর নিয়ে লিসবন ছাড়েন এবং ভারতের পশ্চিম উপকূলে কালিকটে তরী ভেড়ান ১৪৯৮ সালের ১৭ মে। তার নাবিকরা ভারতীয় রমণীদের মধ্যে প্রসার ঘটায় ফিরিঙ্গি রোগ নামে খ্যাত সিফিলিসের। এ রোগ ১৫১০-২০ সালের মধ্যে আফ্রিকা, মালায়ে দ্বীপপুঞ্জ, জাপান ও চীনে ছড়িয়ে পড়ে। চীনে সিফিলিসের পরিচিতি ছিল ‘চেনিক ঘা’ নামে।
১৯৪৬ সালে অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন বাজারজাত না হওয়া পর্যন্ত যৌনাচারে সংক্রমিত সিফিলিস রোগ সারা পৃথিবীকে ৬০০ বছর পর্যুদস্ত করে রেখেছিল। অনেকটা আজকের ছোঁয়াছে রোগ করোনা সংক্রমণের ধারায়।
১৯২৮ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং, হাওয়ার্ড ফ্লোরি, আর্নেস্ট বরিস চেন ও নরমান হিটলির সম্মিলিত গবেষণায় অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন। যে কয়েকটি পাত্রে প্রথম পেনিসিলিন উৎপাদন করা হয়েছিল, তার একটি পাত্র বিজ্ঞানী নরমান হিটলি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে উপহার দেন ১৯৮০ সালে, যা বর্তমানে সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে রক্ষিত আছে।
পেনিসিলিন প্রথম ব্যবহৃত হয় লন্ডনের পুলিশ আলবার্ট আলেকজান্ডারের প্রদাহ নিবৃত্তির জন্য ১২ ফ্রেব্রুয়ারি ১৯৪১ সালে। পেনিসিলিনের ব্যাপক উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি অ্যাবট, লিডারলি, ফাইজার, মার্ক ও স্কুইবের ভূমিকা স্মরণযোগ্য।
শেষকথা, সঠিক তথ্য দিন, গুজব ছড়াবেন না, বাংলাদেশের জনগণের ওপর আস্থা রাখুন। ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মীসহ সবাই সাবান দিয়ে বারে বারে হাত ধোয়ার অভ্যাস করুন, হ্যান্ডশেক নয়, সালাম দিন। ‘আল্লাহর আজাব’ থেকে নিশ্চয়ই সবাই মুক্তি পাবেন।
‘মহামারি আল্লাহর আজাব’- হযরত আয়িশাহ (রা:)।
‘মহামারিপীড়িত গ্রাম বা শহরে প্রবেশ নিষেধ। পক্ষান্তরে কেউ যদি পূর্বে থেকে আক্রান্ত জায়গায় থেকে থাকে, তাহলে সেখান পলায়ন করা নিষিদ্ধ। মহামারি আক্রান্ত এলাকা থেকে পলায়ন জিহাদের ময়দান থেকে পলায়নতুল্য অপরাধ’- বুখারি ৩৪৭৩, ৫৭২৮।
জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী: ট্রাস্টি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র
এনএফ/এমএস