‘দয়া করে বেশি পণ্য কিনবেন না’
এখন একটি হাঁচি দিলেই ভয়ে আতকে উঠি। সাথে সাথে শরীরের জ্বর মাপি। কাশি হচ্ছে কিনা তাও অনুভব করার চেষ্টা করি। আবার নিজেই অনুভব করার চেষ্টা করি, শরীর কেমন অনুভব করছে? কিন্তু একটি হাঁচির পর আমাদের মন কি বলছে, তা কি আমরা অনুভব করি? সত্যি বলতে আমি এমনটা জানতে চাচ্ছি কারণ, আমাদের বর্তমান সময়টি দেখে। এমন পরিস্থিতিতেও কিভাবে আমরা এতো অপেশাদার হয়েছি বা কিভাবে এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছি। করোনাভাইরাসের এই সংকটে আমাদের সব থেকে বেশি প্রয়োজন মানসিক শক্তি আর সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া। কিন্তু হয়তো এমন পরিস্থিতিতে আমরা এর দুটোই হারিয়ে ফেলেছি।
গত সপ্তাহে আমি হালকা জ্বর অনুভব করি আর এ কারণে আমি নিজেই নিজেকে গৃহবন্দি করে ফেলি। তবে নিজেকে নিজে কোয়রেন্টাইনে নিলেও প্রতিদিন চোখ রেখেছি টিভি আর পত্রিকার পাতায়। প্রতিদিনকার মিডিয়ায় নজর থাকার কারণে ভেবেই নিয়েছিলাম, কোয়ারেন্টাইন শেষে হয়তো ভয়ানক কিছু দেখবো। যেমনটি ভাবা, তেমনটিই হলো।
গত শনিবার বাজার করার উদ্যেশ্যে বাসা থেকে বের হলাম। বের হয়েই আমি এক নতুন শহরকে আবিষ্কার করলাম। পুরো অচেনা এক নগরীর রূপে দেখলাম বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত নগরীর অন্যতম লন্ডনকে। চারদিকে খা খা। রাজপথ, হোটেল, রেস্তোরাঁ, পাব সব শূন্য। মনে হলো যুদ্ধের ভয়ে লুকিয়ে রয়েছে মানুষগুলো।
কিন্তু না সচেতন লন্ডনবাসীরা নিজেরাই নিজেদের সেল্ফ কোয়ারেন্টাইনে রেখেছে। আর এর মাধ্যমে নিজেরা নিজেদের সাথে যুদ্ধ করছে। বাসে কথা হলো ৭০ বছরের এক নারীর সাথে। স্যালিন নামের সেই নারী বললেন,“ অনেক দিন পর বের হয়েছি। একটু আলো, একটু বাতাস আর রঙ বেরঙের মানুষ দেখতে। হয়তো এ রকম আর দেখার সুযোগ আর নাও হতে পারে। তবুও দেখতে ইচ্ছে হলো, তাই বের হয়েছি।”
তার চোখের আনন্দ দেখে নিজের মনের ভয়কে তার সামনে তুলে ধরলাম। অনুরোধ করলাম ঘর থেকে না বের হতে। কিন্তু স্যালন অকপটে বললো, হয়তো বাঁচার সময় শেষ হয়ে গিয়েছে। তারপরও তো পৃথিবী দেখতে ইচ্ছে হয়। তবে এরপর হোম কোয়ারেন্টাইনে চলে যাওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেয় আমাকে।
শুধু মাত্র স্যালিন নয় সত্তরোর্ধ্ব সবাইকে যেতে হবে স্বেচ্ছা কোয়রেন্টাইনে। গত ১৫ই মার্চ রবিবার স্বাস্থ্য সুরক্ষা (করোনাভাইরাস) নিয়ন্ত্রণ আইন ২০২০ নামে ইংল্যান্ডের সরকারি ওয়েবসাইটে জানানো হয়, ৭০ বছরের উপরের নাগরিকদের অসুস্থ্য না হলেও ৪ মাসের স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহ হলেই ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। আর কেউ করোনাভাইরাস পরীক্ষা ও কোয়ারেন্টাইনে যেতে অস্বীকৃতি জানালে ১ হাজার পাউন্ড জরিমানা অথবা জেলদণ্ড হতে পারে।পুলিশকে এ আইনটি প্রয়োগ করার জন্য বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে দেশটির সরকার।
লন্ডনের বয়স্কদের জন্য নেওয়া পদক্ষেপ আর স্যালিনকে দেখে আমি উৎসাহ পেয়েছি আরও পেয়েছি অনুপ্রেরণা। তবে এমন অনুপ্রেরণার মাঝেই হতাশ হলাম সুপারশপগুলোতে গিয়ে। বেশিরভাগ সুপারশপই খালি। আর শপগুলোর দরজার সাথে সাদা কাগজের নোটিশ ঝুলছে আমাদের মতো ক্রেতাদের জন্য। নোটিশে ক্রেতাদের অনুরোধ করে লেখা রয়েছে, দয়া করে বেশি পণ্য কিনবেন না। সবার প্রয়োজনের কথা মাথায় রাখুন। আপনি ঘরে মজুদ করে না রেখে অন্যের চাহিদার কথা চিন্তা করুন। জাতি এখন সংকটে আছে। তাই ক্রেতারা আপনারা দয়া করে সংযত হোন।
এমন নোটিশ দেখে লজ্জ্বিত আমি কিংবা আমার মতো অনেক ক্রেতা। মানুষ যখন বাঁচার লড়াই করছে, তখন আমাদের চারপাশের কিছু মানুষ প্রয়োজনের বেশি পণ্য কিনে ঘরে মজুদ করে রাখছেন।
গত দুই দিন ধরে লন্ডনের এক বাসার ভিডিও ফেসবুকে ঘুরছে। বাড়ির মালিক তার রান্নাঘর, স্টোরঘর, বসার রুম মজুদ করেছে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য। যে চিত্র দেখে মনে হচ্ছে যেন বিয়ে বাড়ির জন্য বাজারের আয়োজন।
করোনাভাইরাসে আমরা এতো আতঙ্কিত যে বাঁচার জন্য হয়তো একটু বেশিই খাদ্য মজুদ করছি। কিন্তু যখন বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বলেন, ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ২২ লাখ আর যুক্তরাজ্যে অন্তত ৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে। তখন হয়তো এই মজুদকৃত খাদ্য ভয়েও আমাদের গলা থেকে নামবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি কোন দেশকে। এতো মৃত্যু হয়তো হার মানাবে যে কোন বড় যুদ্ধকে।
এক অদৃশ্য ভাইরাস থেকে সংক্রমিত মহামারি মোকাবিলায় যুদ্ধ করছে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। কিন্তু এই যুদ্ধের শেষ কোথায় বা কখন শেষ হবে, তার কোন উত্তর জানা নেই কারও কাছে।
তবে আমাদের যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করতে হবে। নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে হবে, ঘরে থাকার যুদ্ধ। ঘুরতে না যাওয়ার, বেশি মানুষ এক জায়গায় না হওয়ার, আড্ডাবাজি না করার যুদ্ধ। করোনা নামক শত্রু একবার ঢুকে পড়লে হয়তো এ যুদ্ধে আমরা হেরে যাব। তাই শত্রু ঢুকে পড়ার আগেই আমাদের সব প্রস্তুতি নিতে হবে। হয়তো এর মাধ্যমেই এ রকম যুদ্ধের জয় হবে।
এইচআর/এমকেএইচ