বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে পূর্ণতা পেল বাঙালি জাতীয়তাবাদ
বাঙালি নরগোষ্ঠি দীর্ঘ দিনের। দ্রাবিড় এই জনগোষ্ঠিকে নিয়ে নানানা মত আছে। কোথা থেকে এরা এসেছে, আর্যরা আসার আগে এরা এখানে ছিলো কিনা- এমনি নানান প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে নানান ভাবে। তবে বাঙালি নরগোষ্ঠি আর ভাষাভিত্তিক জাতি রাষ্ট্রের একটি বাঙালি জাতি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। কারণ, এই যে জাতি রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদ, এটা সম্পূর্ণরূপে আধুনিক সভ্যতার বিষয়। পশ্চিমাদের হাত ধরেই আমাদের এ উপমহাদেশের চিন্তা চেতনায় এই জাতীয়তাবাদ প্রবেশ করে। উনবিংশ শতাব্দীতে যখন ভারতীয় উপমহাদেশে একটি জাতীয়তাবাদের জোয়ার ওঠে ওই সময়ে ওই জাতীয়তাবাদ ছিলো ভারতীয় জাতীয়তাবাদ।
ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের ভাষা ভিত্তিক স্বাতন্ত্র্য আচার আচরনের নরগোষ্ঠিগুলো নিয়ে কেউ সে সময়ে আলাদা আলাদা জাতীয়তাবাদের বিষয়টি চিন্তা করেননি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল সকলেই বাঙালি ছিলেন, তাঁরা বাঙালির সার্বিক চেতনার উন্নয়নে অনেক কিছু করেছেন। তাঁরা বাঙালিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন, তবে কখনই বাঙালি নরগোষ্ঠিকে নিয়ে আলাদা জাতীয়তাবাদের চিন্তা বা আলাদা একটি বাঙালি জাতির চিন্তা করেননি। বাংলাকে নিজের জম্মভূমি মনে করলেও নিজের দেশ মনে করেছেন ভারতবর্ষকে, জাতীয়তার ক্ষেত্রে মেনে নিয়েছেন বা বিশ্বাস করেছেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল দুজনের লেখায় বাংলাদেশ কথাটা ঘুরে ফিরে বারবার এলেও তাঁরা কখনই কিন্তু বাঙালির একটি আলাদা রাষ্ট্র ও আর সেই রাষ্ট্রের অধিবাসীদের জাতীয়তা বাঙালি, এমনটি নির্দিষ্ট করে বলেননি। বরং তাঁরা বৃহত্তর ঐক্যভূমি ভারতের মধ্যে বাংলা ও বাঙালির অবস্থানকে দেখেছিলেন।
তবে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কাজের ভেতর দিয়ে অবচেতনভাবে বা আপন জম্মভূমির শেকড় থেকে আসা চেতনার কারণে একটি বাঙালি জাতীয়তবাদ গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। যেমন একটি জাতীয়তাবাদ তৈরি হতে ওই জাতির একটি সমৃদ্ধ সাহিত্য, নৃত্য, চিত্রকলা, গান প্রভৃতির প্রয়োজন পড়ে,অর্থাৎ আপন সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী নান্দনিক ভূমি তখন অনিবার্য হয়ে পড়ে। এগুলো ওই নরগোষ্টি বা জাতির বোধকে শানিত করে না শুধু তাকে একটি ভিন্ন আত্মপরিচয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। বাংলা সাহিত্য মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপধ্যায়ের হাত ধরে আধুনিক পথে ছুটতে শুরু করলেও রবীন্দ্রনাথ এই সাহিত্যকে এমন একটি ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দেন যে তখন ওই সাহিত্য বা চিন্তা চেতনা ধারণ করে একটি আধুনিক জাতিগোষ্ঠির মনন জেগে উঠতে পারে। তেমনিভাবে অবনীনন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু, যামিনী রায় থেকে জয়নুল আবেদিন-কামরুল হাসান প্রমুখ এই জাতির একটি স্বাতন্ত্র্য চিত্রকলা দাঁড় করিয়ে দেন।
অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল দুই মিলে বাঙালির হাজার বছরের গানের ভাণ্ডারে নিয়ে আসেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিশেলের অজস্র গানের সম্পদ, যা একটি স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠি হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে অনেকটা পথ এগিয়ে দেয়। গান বা সঙ্গীত কোন নরগোষ্ঠিকে কতটা আত্মপরিচয় দেয় তা আমরা আফ্রিকান আমেরিকানদের দেখলে বুঝতে পারি। সেই কবে আফ্রিকা থেকে শিকার হিসেবে এদের নিয়ে আসা হয়েছিলো আমেরিকায়। তারপরে তাদের ওপর দিয়ে ইতিহাসের বহু জল গড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে তারাও সৃষ্টি করেছে ইতিহাস। মার্টিন লুথার কিং থেকে ওবামা অবধি পৌঁছেছে তারা আমেরিকার ইতিহাসে। কিন্তু তারপরেও তাদেরকে এখনও সব থেকে বেশি স্বাতন্ত্র্য দেয় যে বিষয়টি, যা ইউরোপীয় আমেরিকান থেকে তাদেরকে আলাদা বলে পরিচিত করে প্রতি মুহূর্তে সেটা তাদের সঙ্গীত। বাস্তবে তাদের শরীরের রঙের থেকেও বেশি স্বাতন্ত্র্য এনে দেয় নিজস্ব সঙ্গীত।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল মিলে এই জারি, সারি, ভাওইয়া, ভাটিয়ালি, বাউল ও কীর্তনের ঝাঁপিতে নিয়ে আসে আরো ঝাঁপি ঝাঁপি সঙ্গীত। যা বাঙালিকে স্বতন্ত্র জাতি হতে অনেকটা পথ সহজে এগিয়ে দেয়। এমনিভাবে উনবিংশ শতাব্দী ও বিংশ শতাব্দী মিলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রগুলো একের পর এক পরিপূষ্ট হতে থাকে নানান বাঙালি মনিষীর হাত ধরে। জাতীয়তার বিষয়টি শুধু রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক নয়, সমাজের গভীরেও সেটা থাকে। সমাজকে শুধু ছুঁয়ে যায় না সমাজের নানান উপকরণেও থাকে তার শেকড়। উনবিংশ শতাব্দী জুড়ে এমনকি বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বাঙালি সমাজ জীবনে আসে অনেক পরিবর্তন। বিশেষ করে পশ্চিমা ধাচের একটি জাতীয়তাবাদকে ধারণ করার জন্যে যে উদারতার প্রয়োজন পড়ে সেই উদারতা বাঙালি সমাজে বেশ ভালোভাবে স্থান নেয়। এমনকি একটি জাতি গঠনের জন্যে যে উদার মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রয়োজন তারও জম্ম ঘটে বাঙালি সমাজে।
কেউ হয়তো বাঙালি সমাজের উদারতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন, বলতে পারেন উদারতাই যদি থাকবে তাহলে বাঙালি কেন বিংশ শতাব্দীর মাঝভাগে এসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উম্মত্ত হলো? এ প্রশ্নের উত্তর সহজে দেয়া যায়না। কারণ বাঙালির জীবনে এ এক দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত। তাই এর উত্তর খুঁজতে হলে বেশ গভীরে গিয়ে নির্মোহ গবেষণা করতে হবে। তবে এতটা বছর পার করে আসার পরে এবং পরবর্তী অনেক বাস্তবতা থেকে বলা যায়, ওই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সমাজের গভীর থেকে ঘটেনি; তা অনেকখানি আরোপিত ছিলো বা বিশেষ প্রক্রিয়ায় ঘটানো হয়েছিলো- যে কারণে এটাই বাঙালি সমাজের সবটুকু পরিচয় নয়। বাঙালি সমাজে তখনও লালন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের চেতনা জাগ্রত ছিলো। তাছাড়া স্বভাবের দিক থেকে বাঙালি বাউল মনের অধিকারী বা সহজিয়া। তাই এ সমাজে সহজে উদারতাকে গ্রহন করার একটা অন্তসলিল ধারা রয়ে গেছে। তারপরেও ১৯৪৬ এর এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঙালি সমাজের অনেক গভীরে নাড়া দিয়েছিলো?
এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যেমন ভারতকে ভাগ করার কাজ প্রশস্ত করে তেমনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে ধর্মের উগ্রতার কাছে পরাজিত করে। পরাজিত এই ভারতবর্ষে বাঙালিও তখন একটি পরাজিত ও বিধ্বস্ত নরগোষ্ঠি। আর সে সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানও একজন পরাজিত এবং বিধ্বস্ত তরুণ। মানসিকভাবে ও আদর্শগতভাবে সম্পূর্ন না হলেও অনেকখানি বিধ্বস্ত তিনি। কারণ, ততদিনে মুসলিম লীগের প্রতি তাঁর যে বিশ্বাস ছিলো সে বিশ্বাস ভেঙ্গে গেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান তখন প্রায় বাস্তবতা তাই সেখান থেকে তিনি সরে আসতে পারছেন না। বুঝতে পারছেন, এ মুহূর্তে এখান থেকে সরে গেলে তিনি রাজনৈতিক ভাবে সমাজের কাছ থেকে, মানুষের কাছ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন। তাই যে কোন ভাবে হোক আপাতাত মানুষের সঙ্গে থাকতে হবে তাকে। কারণ, ততদিনে তাঁর নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও অনেক খানি পরাজিত একজন মানুষ। সোহরাওয়ার্দীকে মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার একটা প্রচেষ্টা ওই সময় সার্বক্ষণিক পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র যন্ত্র থেকে করা হচ্ছিলো।
অবশ্য পরবর্তী কালে দুজনেরই রাজনীতি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, পাকিস্তান সৃষ্টির মুহূর্তে তারা পরাজিত হলেও তারা বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তান একটি সাময়িক বিষয়, পাকিস্তানকে কোনমতেই একটি শক্ত রাজনৈতিক কেন, সঠিক রাজনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো যাবে না। আবার পাঞ্জাব ও বাংলার দাঙ্গা যে সামাজিক ভিত্তি ভূমি ভেঙ্গে ছার খার করে দিয়েছে তাতে নতুন কোন পথ ছাড়া এই সমাজকে নিয়ে, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যাবে না। অন্যদিকে এই রাষ্ট্র যেমন একটি সামাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হতে পারবে না, তেমনি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও হতে পারবে না। আবার ধর্মভিত্তিক কোন জাতীয়তাবাদ যে হতে পারে না বরং সেটা কেবলই একটি অন্ধত্ব তা ১৯৪৬ এর দাঙ্গা ও ধর্মের নামে পাকিস্তান সৃষ্টি হবার ভেতর দিয়ে প্রমান হয়ে গেছে। তাই তখন স্বাভাবিকই এই সত্য সামনে আসে, যদি ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের জম্ম ঘটে, তাহলে পাকিস্তান নামক দেশটি সহজে ভেঙ্গে যাবে। পাকিস্তান শুরুর পর পরই শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতি লক্ষ্য করলে এমন একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
যা হোক,হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এই সত্য দেখতে তাদের খুব একটা কষ্ট হয়নি। ফলে, ওই বিধ্বস্ত সময়েও একটি আশার আলো জেগেছিলো, তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের ভেতর থেকেই তাদেরকে পরিবর্তন আনতে হবে। আর এই পরিবর্তন আনার পথে নেমে হোসেন শহীদ সোহারওয়ার্দী রাজনৈতিক ভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে অনেকদূর এগিয়ে দিলেও শেখ মুজিবুর রহমান শুরু থেকে এককভাবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটি ভিন্ন পথ নেন। সে পথটি ছিলো রাজনৈতিকভাবে পশ্চিমা জাতীয়তাবাদের মত একটি বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলা। আর একটি স্বাধীন রাষ্ট্রই হবে ওই জাতীয়তাবাদের অন্যতম আশ্রয়স্থল।
অন্যদিকে জাতীয়তাবাদের সম্পূর্ন আশ্রয়স্থল কখনই কেবলমাত্র রাষ্ট্র হয় না- সমাজ ও সংস্কৃতি সব সময়ই জাতীয়তাবাদের অনেক বড় ভিত্তি। তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান তাই পাকিস্তানের রাজনীতিতে ফিরে এসে শুধুমাত্র রাজনৈতিক অঙ্গনের আন্দোলনের মধ্যে নিজ অবস্থানকে স্থির রাখেননি। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাত্রা যাতে বৃদ্ধি পায় সেদিকে সব সময়ই তার সহযোগীতা বজায় রাখেন। যে কোন রাষ্ট্রকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলতে হলে ওই রাষ্ট্রের বা ভূখণ্ডের সমাজকে পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক হিসেবে গড়ে তুলতে হয়। এটাই ছিলো ওই মুহূর্তে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্যে সব থেকে কঠিন কাজ। কারণ, সাম্প্রদায়িকতার নামে তখন সবেমাত্র পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে ওই সময়ে সেকুলারইজমের পথে হাঁটা মোটেই সহজ কাজ ছিলো না।
অবশ্য বাঙালি জাতি যেহেতু কোনদিনই উগ্রসাম্প্রদায়িক নয়, বরং উদার- তাই রাজনৈতিক উম্মাদনায় ধর্মের নামে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও সমাজের গভীরে সাম্প্রদায়িকতা খুব বেশি প্রবেশ করতে পারেনি। অন্যদিকে পাকিস্তানী নেতারা বিশেষ করে জিন্নাহ ও নাজিমউদ্দিন একাজে কিছুটা সহযোগিতাও করেন ভাষা বির্তককে সামনে নিয়ে এসে। এর পাশাপাশি সমাজের মধ্য যে বিষয়গুলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে জম্ম নিয়েছিলো তা ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন পাকিস্তান আন্দোলন যতই সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঝুঁকে গিয়েছিলো ততই প্রগতিশীল শিক্ষিত মুসলিম তরুণ গোষ্টি এর সঙ্গে আর শতভাগ একাত্মতা বোধ করতে পারেনি। তাদের একটি অংশ বামপন্থার দিকে ঝুঁকে যায় আরেকটি অংশ ঠিক বামপন্থাকে পছন্দ করতে পারেনি, তারা একটি মধ্যপন্থা বা উদারনৈতিক পন্থা খুঁজছিলো। বাঙালি সমাজ যেহেতু হাজার বছর ধরে সহজিয়া, তাদের আনন্দ উপাচার সবই সহজ ও সরল তাই স্বাভাবিকই এখানে কোন কট্টর জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠার পথ ছিলো না। এখানে পথ খোলা ছিলো একমাত্র সহজাত একটি উদার জাতীয়তাবাদ। যা মূলত বাঙালির জারি, সারি, ভাওইয়া,ভাটিয়ালি, বাউল ও কীর্তনের মতই সহজ ও সরল। আপন স্বভাবগত কারণে ওই সময়ে বামপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়া ও উদার নৈতিক মুসলিম তরুণ শ্রেনী তাদের নিজ নিজ পরিমন্ডলে একটি উদার আবহাওয়া গড়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকে।
বাঙালি বামপন্থী মুসলিম তরুণদের অনেকে দুই দিকে ঝোঁকা ছিল। একদিকে তাদের ভেতর একটি জাতীয় স্বাতন্ত্র্য ছিলো অন্যদিকে তারা বামপন্থী হওয়াতে সাধারণ মানুষের জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করার আগ্রহে অনেক বেশি উদার ছিলো। এটা তাদের কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল হতে যতো না সাহায্য করে তার থেকে বেশি সাহায্য করেছিলো একজন উদার মানুষ বা ধর্মীয় রাজনীতির গন্ডি থেকে বেরিয়ে আসা একজন মানুষ হবার জন্যে। এমনকি অবচেতনভাবে জাতীয়তাবাদের দিকে বা কায়মনো বাক্যে বাঙালি হবার দিকে ঠেলে দেয়।
এমন একটি পরিবেশে ভাষা আন্দোলন একটি ল্যান্ডমার্ক হয়ে দাঁড়ায় বাঙালি জীবনে। যে ভাষা এতদিন তার জন্যে সহজাত ছিলো, অর্থাৎ তার চারপাশের বাতাসের মত ছিলো- ওই ভাষা হঠ্যাৎই তার অন্তরের অন্তস্থলের একটি জাগ্রত বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ভাষা তার নিজস্ব শক্তি নিয়ে জাতীয় জীবনের জেগে ওঠার ফলে অনিবার্যই জেগে ওঠে বাঙালি সংস্কৃতি। এই সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে দেখা যায় আরো একটি নতুন যাত্রা। অর্থাৎ যে সকল তরুণ ও তরুণীরা বাম আদর্শকে আকড়ে ধরেছিলো আর যারা নিজেদেরকে উদার একটি রাজনৈতিক বা সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিলো তারা সকলে মিলে আস্তে আস্তে খুঁজতে শুরু করে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি। বলা যেতে পারে এটাই বাঙালির প্রথম জাতীয়তাবাদের পথ চলা শুরু বা বাঙালির তার নিজের ঘরে ফেরা শুরু।
এরা যখন বাঙালি সংস্কৃতির পথে চলতে শুরু করে তখনও তাদের কোন স্পষ্ট ধারণা ছিলো না যে তারা কোন ধরনের কাঠামোর মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ খুঁজছে ? সেটা কি পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যে না বাঙালির স্বতন্ত্র একটি রাষ্ট্রের মধ্যে? এত বছর পরে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের নানান সত্য বের হয়ে আসাতে এখন স্পষ্ট হওয়া যায় যে তিনি পাকিস্তান সৃষ্টি হবার অব্যবহিত পর থেকেই বাঙালির এক স্বতন্ত্র আবাসভূমি খুঁজছিলেন। তাই স্বাভাবিকই তাঁর বাঙালি জাতীয়তাবাদের পথ চলাটি ছিলো বাঙালির একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের মধ্যে। আর একজন বড় মাপের উদার রাজনীতিকের যা কাজ সেটাই তাঁর ভেতর পাওয়া যায়, কোনরূপ উগ্রতা দিয়ে তিনি কখনই বাঙালি জাতীয়তাবাদকে জাগানোর চেষ্টা করেননি। এর একটি বড় কারণ হতে পারে, ধর্মীয় উগ্রজাতীয়তাবাদের ফল ১৯৪৬ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করা। তাই শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখা যায়, পঞ্চাশের দশকে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ও সমাজে যা কিছু উদারনৈতিক ঘটনা ঘটতে থাকে তিনি সেগুলোকে সবই নিজের মধ্যে ধারণ করে চলেছেন। আর প্রতি মুহূর্তে ওই আত্মপরিচয়ের পথে চলার কাজকে রাজনৈতিক নিরাপত্তা দিয়ে চলেন তিনি।
ওই সময়ে ভাষা আন্দোলনের পর পরই বাঙালি তার নিজস্ব পরিচয়ের পথে একের পর এক পা ফেলতে থাকে। যেমন মুসলিম লীগ সরকারের উদ্যোগে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে নিজেদেরকে ধর্মের পরিচয়ের বাইরে এনে বাঙালি হিসেবে রুখে দাঁড়ানোর জন্যে একদল উদার তরুণ তরুণী এগিয়ে আসে। শেখ মুজিবুর রহমান তখন তার সহযাত্রী উদার রাজনৈতিক নেতা, কর্মী ও সমাজের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে রাজনৈতিক পথে এগিয়ে আসেন। যারা রুখে দাঁড়াতে এগিয়ে এসেছিলো তাদের শুধু নিরাপত্তা দেন না, তাদের নেতৃত্বও দেন। অর্থাৎ সমাজের এই শুভবুদ্ধিকে, বাঙালি হবার পথের ঐক্যতানকে তিনি নিজের ভেতর ধারণ করেন, রাজনীতির ভেতর অবস্থান দেন। যা মূলত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুইভাবেই বাঙালির পথে যাত্রাকে সহায়তা করে।
আবার এর কিছুদিন পরেই ঢাকা কেন্দ্রিক শিক্ষিত ও অগ্রসর তরুণ তরুণীরা বাঙালির একটি নিজস্ব নববর্ষ তৈরির পথে নামেন। এ কাজে তারা বাংলা সালকেই বেছে নেন। দীর্ঘকাল ধরে ফসল উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত বাঙালির যে সাল ছিলো, যেদিন সে ফসল বিক্রির অর্থ দিয়ে নানান দায় দেনা শোধ করতো- আর যার ভেতর দিয়ে শুরু হতো কৃষিজীবী ও সাধারণ বাঙালি ব্যবসায়ীদের পরবর্তী বছরে প্রবেশের দিন, ওই দিনটিকে নিজস্ব নববর্ষ করার পথে নামেন তারা। ওই তরুণী ও তরুণরা ছিলেন সকলে সাংস্কৃতিক কর্মী বা সেবী। সেখানে কোন রাজনীতি ছিলো না। বরং তারা ওই দিনটির সঙ্গে আধুনিক বিশেষ করে উনবিংশ ও বিংশ শতকে কোলকাতা কেন্দ্রিক রেনেসাঁর ফলে বাঙালি সংস্কৃতিতে যে পরিবর্তন গুলো এসেছিলো, যা পূর্ণতা পেয়েছিলো রবীন্দ্র নজরুলের হাত ধরে সেগুলোর যোগ ঘটান। প্রাচ্য ও পাশ্চত্য মিলে রবীন্দ্র নজরুলের হাত সংস্কৃতিতে নতুন যে অনেক উপাদান প্রবেশের জন্যে তৈরি ছিলো তাই নিয়ে তারা নতুন একটি সাংস্কৃতিক বৃক্ষের জম্ম দেবার কাজে নেমে পড়ে। মূলত তারা গ্রাম বাংলা থেকে বাংলা সনের নতুন বছরের বৃক্ষটির শিকড় নিয়ে এসে তার সঙ্গে কলম করে উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে পরিবর্তিত বাঙালি সংস্কৃতির শাখাটির। যারা মাধ্যমে নতুন একটি গাছ সৃষ্টির পথে নামেন তারা। পৃথিবীর তাবৎ সংস্কৃতি এভাবেই নতুন পথে যাত্রা করে। পূর্ববাংলায়ও ষাটের দশকে শুরুতে সেটাই ঘটেছিলো।
তাদের ওই সংস্কৃতির রূপান্তর করানোকে সহজভাবে নেয়নি পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ, বিশেষ করে সামরিক শাসকরা। কারণ, ততদিনে পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক পাকিস্তানি শাসকরা বুঝে গেছে যে বাঙালি তার নিজস্ব জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির কাজে নেমেছে। তাই তারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ওই তরুণী ও তরুণদের কাজের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিতে থাকে প্রতি মুহূর্তে। এ সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান ওই তরুণ তরুণীদের কাজের নেতৃত্ব নেন না এমনকি তাদের নেতৃত্ব দিতেও এগিয়ে আসেন না ঠিকই কিন্তু তিনি হন তাদের মূল রাজনৈতিক সহায়ক। তিনি তাঁর রাজনীতিতে ও তার রাজনৈতিক দলে সংস্কৃতির ওই রূপান্তরিত রূপকে নিজস্ব বলে গ্রহণ করিয়ে তাঁর রাজনৈতিক দল ও কর্মীর মাধ্যমে সাধরণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার কাজে নামেন। যার ফলে বাঙালির নতুন রূপের নিজস্ব নববর্ষ পালন সাধরণের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে যায়। এ কাজে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি বাম রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গুলোও এগিয়ে আসে। তাদেরকেও সহযোগিতা করেন শেখ মুজিবুর রহমান। কারণ, ততদিনে তিনি প্রায় একক নেতা হয়ে উঠেছেন পূর্ব বাংলায়। অন্তত একক তরুণ নেতা যে তিনি ততদিনে হয়ে উঠেছিলেন তাতে কোন সন্দেহ ছিলো না।
বাঙালি যেমন তার নিজস্ব নববর্ষকে সেদিন নবরূপ দেয় তেমনি তারা আবার নতুন করে আঁকড়ে ধরে বাঙালি সংস্কৃতিকে। পাশাপাশি তারা আঁকড়ে ধরে, যিনি সত্যি অর্থে আধুনিক জাতীয়তাবাদের এমনকি মানবিকতাবাদের সংস্কৃতিতে পরিণত হবার উপাদানের ডালি ভরে দিয়ে গেছেন সেই রবীন্দ্রনাথকে। পাকিস্তান সরকার চেয়েছিলো বাঙালি জীবন থেকে রবীন্দ্রনাথকে সরিয়ে দিতে, তারা বুঝতে পেরেছিলো যত বেশি রবীন্দ্রনাথকে আঁকড়ে ধরবে বাঙালি তত তাড়াতাড়িই তারা বাঙালি হবে। কিন্তু পাকিস্তান যে পথে বাঙালি থেকে রবীন্দ্রনাথকে আলাদা করতে চেয়েছিলো তা ছিলো সম্পূর্ণ ভুল পথ। বরং পাকিস্তান সরকার যা করে তা ছিলো মূলত আগুনে ঘি ঢেলে দেয়া। তারা জোর করে বাঙালির জীবন থেকে রবীন্দ্রনাথকে কেড়ে নেবার চেষ্টা করতেই বাঙালি শিক্ষিত সমাজ ফুঁসে ওঠে। ফলে বাঙালি রবীন্দ্রনাথকে চর্চায় বা চর্যায় আঁকড়ে ধরে আরো বেশি। আর একথা সত্য বাঙালিকে একটি আধুনিক বাঙালি জাতি হবার জন্যে যতটুকু সংস্কৃত হবার দরকার তার সিংহভাগই উপাদান রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জাতিকে দিয়ে গেছেন।
বাঙালি বুদ্ধিজীবী, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত তরুণ তরুণী ষাটের দশকে রবীন্দ্রনাথকে তখন আপন আত্মার অংশ হিসেবে গ্রহণ করে এ সময়ে এ কাজে সকল রাজনৈতিক নিরাপত্তা শুধু শেখ মুজিবুর রহমান দেননি, তিনি অতি সহজ পথে রবীন্দ্রনাথকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যান। যেমন মহাত্মা গান্ধী রাজনীতির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন ভারত-আত্মার মহত্ত্বকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ববাংলায় সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যায় রবীন্দ্রনাথের হাতে পরিবর্তিত বাঙালির আত্মপারিচয়ের বা সাংস্কৃতিক বোধের মহত্ত্ব। বাঙালি জাতীয়তাবাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে এ ছিলো এক বিশাল মাপের পদক্ষেপ। যারই পরিপূর্ণ রূপ আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশ সৃষ্টি হবার আগেই অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক সংগঠন তাদের অনুষ্ঠান শুরু করছে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ এই রবীন্দ্র সঙ্গীতটি দিয়ে। আর বঙ্গবন্ধু ততদিনে তাঁর ঘনিষ্টজনের কাছে ঘোষণা দিয়েছেন, এটাই হবে বাঙালির জাতীয় সঙ্গীত। জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে আমার সোনার বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত হতে অনেক রক্তের সাগর পাড়ি দিতে হয়েছিলো। তারপরেও মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অমোঘ অস্ত্র হয়েছিলো ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। তবে তার আগেই যখন অধিকাংশ বাঙালি কণ্ঠে তুলে নিয়েছিলো ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’- তখনই বাঙালি জাতীয়তাবাদ পূর্ণতা পেয়ে যায়। আর এই অধিকাংশের কাছে পৌঁছে দিয়ে , অধিকাংশকে প্রস্তুত করে এই পূর্ণতা সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই দিয়েছিলেন। তাই তিনিই বাংলা নামের দেশের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠাতা।
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক।
এইচআর/জেআইএম