স্বপ্ন আর শঙ্কার দোলাচলে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন
যে গ্যালারিতে উপচে পড়ার কথা উচ্ছ্বাসের ঢেউ, সেখানে স্তব্ধতা! সবুজ মাঠের মাঝখানের ২২ গজে একটা উইকেট পতনের পর যেখানে উল্লসিত হওয়ার কথা বোলার-ফিল্ডারদের, সেখানে নীরবতা! জাম্প করে বাস্কেটে বল রাখার পর খেলোয়াড়-সমর্থকদের যেখানে একসঙ্গে উল্লাস করার কথা, সেই দৃশ্য হাওয়া! এক একটা ক্রিকেট সিরিজের মাঝপথে ক্রিকেটাররা ধরছেন দেশে ফেরার ফ্লাইট। সব মিলিয়ে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের আপাতত দৃশ্যমান চেহারা এটাই। সৌজন্যে- করোনাভাইরাস।
তবে দৃশ্যমান চেহারা যাই হোক; অদৃশ্য এবং অজানা এক শঙ্কা পৃথিবীর ক্রীড়াঙ্গনজুড়ে। হয়তো কোন একদিন সংক্রমণমুক্ত হবে ক্রীড়াক্ষেত্রসহ গোটা বিশ্ব। জীবনের চেয়ে বড় কোন খেলা নয়। আগে জীবন তারপর বাকি সব। তবে সেই জীবন যদি ছন্দ হারিয়ে ফেলে সেখানে স্বাভাবিক গতি ফিরবে কীভাবে? ক্রীড়াক্ষেত্র এখন বিপন্ন এক সময় পার করছে। বন্ধ খেলাধুলা। শঙ্কা আগামী নিয়ে। ক্রীড়াঙ্গনে গতি ফেরাতে যে অর্থের প্রয়োজন সেটা আসবে কোথা থেকে?
এই প্রশ্নটা উঠেছে। কিন্তু অর্থ নয়; মানুষ এখন ‘করোনাভাইরাস’ আতঙ্কমুক্ত হতে চায়। কিন্তু চাইলেই কী মুক্তি মেলে! কেউ বলতে পারছেন না কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে এ মহামারি। সচেতনতা নিয়ে অনেক কিছু বলা হচ্ছে। সেই সচেতনতা নিয়েও বাংলাদেশে চলছে এক ধরনের অসততা। মুখের মাস্ক বিক্রি নিয়ে যে কারসাজি তা পেঁয়াজ, তেল, চালের কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে। যে রোগের এখনও ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি সেটা বাজারে এলে তা নিয়ে কী হতে পারে, তারও আভাস মিললো।
করোনা স্তব্ধ করে দিয়েছে ক্রীড়াঙ্গন। এরপর নিঃস্ব না করে অনেকের জীবনকে। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ, ইউরোপা লিগ, লা- লিগা, বুন্ডেশ লিগা, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ বন্ধ। যার অর্থ গোটা ফুটবল দুনিয়া স্তব্ধ। আর্থিক ক্ষতির শঙ্কা ক্লাবগুলোর। স্পন্সরশিপের ভবিষৎ কী হবে তার উত্তর খুঁজতে শুরু করেছেন ক্রীড়া বিপণন বিশেষজ্ঞরা।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের অনেকগুলো ক্লাবের সাথে জড়িত চায়নার বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। শুধু ইংলিশ কেন, ইউরোপজুড়ে বিজ্ঞাপনদাতাদের বড় একটা অংশ চীনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তাদের অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়ার অর্থ ক্রীড়া অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য।
ক্রিকেটের বড় বাজার ভারত। সেখানেও করোনার ছায়া। সাউথ আফ্রিকা তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজ বাতিল করে দেশে ফিরে গেছে। আর্থিক ক্ষতি অনিবার্য ভারতীয় ক্রিকেটে। সেটা পুষিয়ে নিতে ভারত এবং সাউথ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ড নতুন করে সিরিজটা আয়োজনে সম্মত হয়েছে। তবে সেটা করোনার প্রকোপ কমলে। তাই প্রশ্ন থাকছে কবে কমবে? ফ্রেশ সিরিজ কবে হবে?
সিরিজ বাতিল করে লংকা ছেড়েছে ইংলিশরাও। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিডিউল বিপর্যয় দেখা দিতে পারে, শ্রীলংকা-ইংল্যান্ড সিরিজ পুনরায় আয়োজন করতে হলে। ইংলিশদের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের ওপরও পড়েছে অনিশ্চয়তার ছায়া। অনিশ্চিত অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড টি-টোয়েন্ট সিরিজও।
এরকম অনিশ্চয়তার মধ্যে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না বাংলাদেশ শেষ দফায় পাকিস্তান সফরে যাচ্ছে। যেখানে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় এবং শেষ টেস্টের পাশাপাশি একটা ওয়ানডে ম্যাচ খেলার কথা বাংলাদেশের।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটেও করোনার প্রভাব। অনিশ্চিত অনেকগুলো লিগের ভবিষৎ। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ আইপিএল ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপর শুরু করা যাবে ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল লিগ তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ নিয়েও অনিশ্চয়তা।
চারদিকে অনিশ্চতার অন্ধকার নেমে আসছে। এরকম অবস্থায় অলিম্পিক মশাল জ্বলবে কীভাবে? টোকিও অলিম্পিক পিছিয়ে যেতে পারে। সেরকম এক বাস্তবতা দেখছেন অলিম্পিক পদকগুলোর বড় এক দাবিদার খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি রাখঢাক না রেখে বলেছেন, টোকিও অলিম্পিক আগামী জুনে করার যুক্তি নেই। এক বছরের জন্য পেছানো উচিত।
আপাতত উচিত-অনুচিত, আশা-শঙ্কার দোলাচলে চলছে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন। ক্রীড়াঙ্গন দুলছে দুলুক। তবে বাঁচুক মানুষ। মানুষ বাঁচলে ক্রীড়াঙ্গনের সব অন্ধকার দূর করে আলো ফিরিয়ে আনবেই তারা।
লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।
এইচআর/এমএস