শেখ হাসিনাই পারেন তাকে পারতেই হয়
করোনা-মুজিববর্ষ ঘিরে ধেয়ে আসা ঘোর অনেকটা কেটে গেছে। ঘোরটি কাটিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পূর্বনির্ধারিত মুজিব জন্মশতবর্ষের আনুষ্ঠানিকতা পড়েছে অনির্ধারিত করোনার চলতি পথে। বিশ্বের ১০৫টিরও বেশি দেশ করোনা আক্রান্ত। স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর কর্মকর্তারা শনিবার ৭ মার্চ রাতেই নিশ্চিৎ হন ইতালি ফেরত প্রবাসী দুজনসহ তিনজনের করোনাভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে। এক রাত পর রবিবার ৮ মার্চ তথ্যটি প্রকাশ করেন তারা। বিদ্যুতের গতিকেও হার মানিয়ে এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে।
মুজিববর্ষের আনুষ্ঠানিকতার কারণে সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্য বিষয়টি বাড়তি যন্ত্রণা হয়ে দেখা দেয়। দল ও সরকারের কেউ কেউ চাচ্ছিলেন খবরটি ঝুলে থাকুক। সময় কাটুক ধোঁয়াশার ঘোরে। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের পর ঘোষণা দিয়ে গোটা জাতিকে নিয়ে নেমে পড়ার বুদ্ধি আঁটছিলেন তারা। কিন্তু, এর ঘোরতোর বিরোধী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ধরনের নিষ্ঠুর চাতুরির চেষ্টা নাকচ করে দেন তিনি। দেরি না করে সিদ্ধান্ত নেন, মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান পরেও করা যাবে। সন্ধ্যার আগেই প্রচার হয়ে যায় এই সিদ্ধান্তের কথা। তার নির্দেশনায় সন্ধ্যায় হয় আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন মুজিববর্ষ উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। জানান, মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান কাটছাটের কথা। দাফতরিক ভাষায় সেটা ‘পুনর্বিন্যাস’।
কামাল নাসের জানিয়েছেন, জনস্বাস্থ্য ও জনগণের সুবিধার বিষয়টি মাথায় রেখে এ অনুষ্ঠানমালা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। বিদেশি অতিথিরাও আসছেন না মুজিববর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। তবে জনসমাগম এড়িয়ে বছরব্যাপী উদযাপন করা হবে মুজিববর্ষ। প্যারেড স্কয়ারে জনসমাগমের যে অনুষ্ঠানটি সেটাকে পুনর্বিন্যাস করে পরবর্তীতে করা হবে। তবে বঙ্গবন্ধু ভবনে যে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং টুঙ্গিপাড়ায় যে শ্রদ্ধা নিবেদন সেই কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে। পাশাপাশি সারা বাংলাদেশের দোয়া মাহফিল এবং শ্রদ্ধাজ্ঞাপন সেটাও থাকবে। এর আগে দেশে তিনজন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার প্রেক্ষিতে মুজিববর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠক করেন। এতে ছিলেন শেখ রেহানাও। বৈঠকেই প্রধানমন্ত্রীর মোটিভ প্রকাশ পায়। যা গোপন থাকেনি সন্ধ্যা পর্যন্ত।
দেশে করোনা ধরা পড়া, সেটা স্বীকার করা, মুজিববর্ষের আলিশান অনুষ্ঠান হচ্ছে না, ভারতের নরেন্দ্র মোদি আসছেন না-এগুলো এ মুহূর্ত্যের গরম খবর। আর আলোচনার বিষয় শেখ হাসিনার ক্যারিশমা। বোদ্ধারা বলছেন, এমন সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনার পক্ষেই নেয়া সম্ভব। তিনি পারেন। পারতে হয়। ননস্টপে পেরেই চলছেন। প্রধানমন্ত্রীর কর্মপরিধি নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা উঠেছে। তাকে কেন সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যেনতেন বিষয়ে নির্দেশ দিতে হয়, তার নির্দেশ ছাড়া কেন কাজ হয় না? –এ ধরনের অসংখ্য প্রশ্ন রয়েছে। আবার এমন কথাও বলা হয়, তিনি কি অন্যদের কাজ করতে দেন না? না-কি, অন্যরা ঠিকভাবে কাজ পারেন না বলে শেষমেষ তাকেই এগিয়ে যেতে হয়?
প্রশ্ন কোনোটাই ফেলনা বা অবান্তর নয়। পাশাপাশি নির্জলা সত্য হচ্ছে, অনন্যতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই সেরা। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্যারিশমায়ও তার ধারেকাছে কেউ নেই। সব কর্নারের খবরই তিনি রাখেন। নিজ মন্ত্রণালয়ের বাইরে সব মন্ত্রণালয়ের এতো তথ্য তার কাছে থাকে যা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, সচিবদের কাছেও থাকে না। বাস্তবতা বুঝেই নিজেকে এ উচ্চতা বা অবস্থানে নিয়ে গেছেন তিনি। সেই আলোকে দলে-সরকারে সময়ে সময়ে তার কিছু নির্দেশ ও সিদ্ধান্ত অনেককে অবাক করে দিচ্ছে। ঘাবড়ে দিচ্ছে। ততক্ষণে কাজ যা হওয়ার সেটাও হয়ে যাচ্ছে। এর সুবাদে সন্তুষ্টু হচ্ছেন উপকারভোগীরা। পাশাপাশি উঠছে সব কিছুতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা সংক্রান্ত নানা প্রশ্ন। এসব প্রশ্নে থমকে দাঁড়াচ্ছেন না, পিছু হটছেন না তিনি। এগিয়ে যাচ্ছেন নিজস্ব গতিময়তার বৈশিষ্ট্যে। এর আগে পরীক্ষা ও শিক্ষাবিষয়ক কিছু ঘটনা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ইত্যাদি বিষয়ে জটিলতার এক পর্যায়ে হস্তক্ষেপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ফয়সালাও এসেছে।
গত কিছুদিন ধরে একটা অনাকাঙ্খিত অবস্থা তৈরি হতে থাকে মুজিববর্ষের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে। একের পর এক অঘটন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অতি উৎসাহী তেলবাজি হাস্যকর পর্যায়ে উঠতে থাকে। এর মাঝে যোগ হয় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্ভাব্য সফর। এ নিয়ে কয়েক মন্ত্রীর অতিকথন পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছে। ক্ষেত্রবিশেষে আগুনে ঘি ঢেলেছেন তারা। এর সঙ্গে বাড়তি যোগ করোনা। দুয়ে মিলে একটা গোলমেলে পর্যায়ে এসে প্রধানমন্ত্রীর সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। এক সিদ্ধান্তে দুই ফয়সালা। প্রাণঘাতি করোনা নিয়েও সময় গড়াতে না দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্রুত পদক্ষেপ কাম্য। নইলে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া নিয়ে মন্ত্রী-মেয়রদের আগের মতো বিনোদনমূলক কথাবার্তা-তৎপরতার শঙ্কা থেকে যাবে। এরইমধ্যে করোনা নিয়েও একেবারে কম হচ্ছে না। করোনা মোকাবেলার সামর্থের দুর্বলতাও ধরা পড়ছে।
বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্যানারে চেকিংয়ের কি হাল! করোনাভাইরাসে আক্রান্তরা বিমানবন্দর পার হলেন কিভাবে?-যুক্তিপূর্ণ এসব প্রশ্নের জবাব নেই। উল্লেখ্য ইতালিফেরত এই আক্রান্তদের সনাক্ত করতে পারেনি বিমানবন্দরে ব্যবহৃত থার্মাল স্ক্যানার মেশিন। উল্টো রোগীরাই হটলাইনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজেদের তথ্য দিয়েছেন। প্রমাণ বা প্রশ্নের অপেক্ষা রাখে না, প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিলে ফল আসবে। পরিস্থিতির উন্নতি আসবে। সংশ্লিষ্ট কারো কারো জানা, করোনা ভাইরাস বিষয়ক পরীক্ষা উপকরণ, প্রস্তুতি, অবকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদির জন্য বিশ্বব্যাংক এবং আইএফসির কাছে ১২ বিলিয়ন ডলার আলাদা অনুদান রিজার্ভ রয়েছে। সেটা বন্টন হবে ‘আগে আসিলে আগে পাইবেন’ ভিত্তিতে।
বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই এটি সুবর্ণ সুযোগ। কিন্তু নেওয়ার জন্য আগ্রহ-উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান নয়। উদ্যোগের এখনই মুখ্য সময়। এ ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীই মূল ভরসা। অন্য কারো ওপর ভরসায় ঝুঁকি থেকেই যায। বার বার তা প্রমাণিত। যতো অভয়ই দেয়া হোক, করোনার আক্রমণের ফলাফল বহুমুখী। প্রাণহানির পাশাপাশি ভাইরাসটি আরো বহু ক্ষতি করে যায়। ধরলে করোনা কাউকে ছাড়ে না। না মানে মানচিত্র, না করে করুণা। জাত-পাত ছাড়ছে না। করোনা আক্রান্ত দেশের সংখ্যা কেবল বাড়ছেই। এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, কোনো মহাদেশই ছাড় দিচ্ছে না। সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, কুয়েত, মালয়েশিয়া, আফগানিস্তান, বাহরাইন, মিশর, আলজেরিয়ার মতো মুসলিম দেশেরও রক্ষা নেই।
যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলারুশ, ব্রাজিল, কম্বোডিয়া, কানাডা, ডেনমার্ক ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভারত তো রয়েছেই। অবশেষে যোগ হলো বাংলাদেশও। পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-হু একে বলেছে 'বৈশ্বিক মহামারীর' আলামত। কাজেই এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্টিয়ারিংয়ে থাকতে হবে প্রধানমন্ত্রীকেই। বাদবাকিরা থাকবেন তার সহযোগী। অন্যদের ব্যর্থতার পর তার হস্তক্ষেপে সাফল্য আসার মতো বিষয় নয় এটি। ততক্ষণে সর্বনাশের অবশিষ্ট না-ও থাকতে পারে।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, বাংলা ভিশন।
এইচআর/পিআর