উহান শহরে এখনও সুস্থ এবং খুবই ভালো আছি
পড়ালেখার উদ্দেশ্যে ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট চীনের উহান শহরে আসি। ২০১৮ সালের মধ্য ভাগে পড়াশোনার পাঠ শেষ করে উহান শহরেরই উহান বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ ফেলো হিসেবে কর্মরত। বর্তমানে করোনাভাইরাস সংকটেও আমি, আমার স্ত্রী এবং আমাদের তিন বছরের ছেলে সবাই উহানেই আছি।
যাই হোক, এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে প্রায় ৯০টিরও বেশি দেশের মানুষ সংক্রমিত হয়েছে। তবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা বিশ্বের মধ্যে চীনেই সর্বাধিক। চীনের মধ্যে উহান শহরের অবস্থা বেশি নাজুক। আলহামদুল্লিলাহ আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা সেই উহান শহরে এখনও সুস্থ এবং খুবই ভালো আছি।
এ সংকটময় পরিস্থিতিতে অন্য সবার মতো আমরাও কিছুটা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম। গত ২৩ জানুয়ারি থেকে উহানের সাধারণ নাগরিকদের তাদের নিজেদের বাসস্থানে অবস্থান করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনার জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের সুপারশপে যেতে পারি। এই সুপারশপে এখন মাছ ও হালাল মাংস পাওয়া যায় না। আমরা একটু চিন্তিত হই আমাদের তিন বছরের বাচ্চার পুষ্টির ভারসাম্য নিয়ে। ঠিক সে সময়ই আমার মুসলিম বন্ধু সোলায়মান আল্লাহর ইচ্ছায় তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। আমি যখন তাকে জানালাম এ মহামারির কারণে আমাদের দেশের (বাংলাদেশ) যারা উহানে ছিল তার প্রায় ৯০ ভাগই বিশেষ ফ্লাইটে দেশে ফিরে গেছে। কিন্তু হাদিসের নির্দেশ অনুসারে আমরা পরিবারসহ উহানেই থেকে গেছি। তখন তিনি খুবই খুশি হলেন এবং জানালেন উনি এবং উনার পরিবার একই কারণে উহান ছেড়ে যাননি।
সোলায়মান ভাই এবং আমরা একটু দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ করার চেষ্টা করি। সেই সূত্রেই তা সঙ্গে আমার পরিচয়। তিনি মূলত চীনের নিংশিয়া প্রদেশের উজহং শহর থেকে উহানে ব্যবসার জন্য এসেছেন। সেখানে সোলায়মান ভাই খাওয়ার হোটেল এবং হালাল মাংসের ব্যবসা করেন। বর্তমানে উহানে মাছের কিছুটা সংকট দেখা দিয়েছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারশপে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু তাকে আমার ছোট বাচ্চার কথা বলায় তিনি অনেক খুঁজে প্রায় ৫-৬ কেজি মাছ কিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে দিয়ে যান। শুধু মাছই নয়, সঙ্গে দুধ এবং অন্যান্য খাবার তিনি নিজে এসে পৌঁছে দেন। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে তার এ সাহায্যে আমরা খুবই অভিভূত হই।
আরও অবাক করা বিষয় হলো, এ সব খাদ্য দ্রব্যের জন্য তিনি কোনো অর্থ নেননি। যদিও আমি তাকে উইচ্যাটের মাধ্যমে অর্থ প্রদান করেছিলাম কিন্তু তিনি ওই অর্থ আমাকে ফিরিয়ে দেন এবং বলেন তুমি যদি এগুলোর বিনিময়ে আমাকে অর্থ দাও তাহলে তোমার সঙ্গে আমি আর যোগাযোগ রাখব না।
সোলায়মান ভাই এবং তার পরিবার বর্তমানে উহানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন। করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তিদের সেবা দেয়ার জন্য অন্যদের মতো চীনের অন্যান্য প্রদেশ ও শহর থেকে বেশকিছু মুসলিম চিকিৎসাকর্মী উহানে এসেছেন। মূলত তাদের হালাল খাবারের ব্যবস্থা করেন আমাদের সুলাইমান ভাই। যাই হোক আলহামদুলিল্লাহ আমাদের ঘরে আগে থেকেই মুরগি এবং ছাগলের মাংস ছিল। কিন্তু আমরা প্রায় দেড় মাস হালাল মাংস কেনার জন্য বাইরে যেতে পারছি না। যদিও আমার বাসায় এখনও তিন থেকে সাড়ে তিন কেজি মুরগি ও ছাগলের মাংস আছে।
তার পরও ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য এবং অন্যান্য ভাইদের মাংস শেষ হওয়ায় সোলায়মান ভাইকে মাংস সরবরাহের কথা জানাই। উনি আমাকে বলেন, তোমার এবং অন্য মুসলমানদের (উহানের অন্য যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়) যদি কিছু প্রয়োজন হয় তাহলে তাকে যেন অবশ্যই অবগত করি। তিনি জানান, গরুর মাংস পর্যাপ্ত পরিমাণে তার কাছে মজুত আছে। আমরা কয়েকজন মিলে সোলায়মান ভাইয়ের কাছ থেকে আমাদের চাহিদা অনুযায়ী মাংস কিনি। যদিও বর্তমানে উহানে সব কিছুরই দাম একটু বেশি; তারপরও তিনি বলেন, আমরা মুসলমান তাই দাম বেশি নেবেন না। আগের বারের মতো এবারও বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে মাংস আনতে গিয়ে দেখি আমার মতো অন্য আরও একজন মুসলিম ভাই সোলায়মান ভাইয়ের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করার জন্য ওখানে উপস্থিত হন। গতবারের মতো এবারও মাংসের সঙ্গে সোলায়মান ভাই ডিম, আলু, টমেটো এবং বাঁধাকপি নিয়ে হাজির।
আমার মনে হয়, আল্লাহ পাক তাদের মতো মানুষের জন্যই এই পৃথিবী এখনও টিকিয়ে রেখেছেন। দোয়া করি আল্লাহ পাক তার এবং তার পরিবারের নেক ও বরকতময় হায়াত দান করুন। সোলায়মান ভাইসহ সব মুসলিমকে আল্লাহ মাফ করে দিয়ে সরাসরি জান্নাত দান করুন। সেই সঙ্গে যে সব অমুসলিম এই সংকটময় পরিস্থিতিতে মানুষের সেবা করছেন আল্লাহ যেন তাদেরও হেদায়েত দান করেন। দোয়া করি আল্লাহ পাক যেন পুরো বিশ্বের মানুষকে হেদায়েত দান করে বিনা হিসাবে জান্নাত দান করেন।
লেখক : পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ ফেলো, উহান বিশ্ববিদ্যালয়, উহান, হুবেই, চীন।
আরএআর/জেআইএম