৭ই মার্চের ভাষণ: আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও বিশ্লেষণ
কবি নির্মলেন্দু গুণ কবিতায় বলেছেন, "কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী? গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর- কবিতাখানী।"
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল একটি অগ্নিমশাল যা বিস্ফোরিত করেছিল মুক্তিযুদ্ধের দাবানল যার সামনে টিকতে পারেনি হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। জাতির জনকের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়কেই নাড়া দেয়নি, ভাষণটি সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এ ভাষণের মধ্য দিয়ে সমগ্র জাতিকে মুক্তির মোহনায় দাঁড় করিয়েছিলেন জাতির জনক। তিনি একটি ভাষণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন।
পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ যখন আক্রমণাত্মক কর্মসূচি ঘোষণার পক্ষে তখন বঙ্গবন্ধু সারা দেশব্যাপী ধর্মঘট এবং অহিংস ও শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনের আহ্বান জানান। ভাষণের সার্বিক বিষয় ও উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু যখন চিন্তামগ্ন তখন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বলেছিলেন, "সামনে তোমার বাঁশের লাঠি, জনগণ আর পেছনে বন্দুক। এই মানুষদের তোমাকে বাঁচাতেও হবে। তুমি যা বিশ্বাস করো, সেই বিশ্বাস থেকেই আগামীকাল বক্তৃতা করবে।" কারণ বিদ্যমান আন্তর্জাতিক পটভূমিতে বাংলাদেশের সংগ্রাম কোন রূপ ধারণ করবে, এটা কি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত হবে, নাকি স্বাধীনতাকামী মুক্তি আন্দোলনের মহিমা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করবে, সেটা নির্ভর করছিল ৭ মার্চের ভাষণের দিক-নির্দেশনার ওপর।
বঙ্গবন্ধু খুব সতর্কতার সঙ্গে বক্তৃতার মাঝখানে চারটি শর্ত আরোপ করে দিলেন। মার্শাল ল’ প্রত্যাহার, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফেরত নেয়া, নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা এবং যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা। এ ৪টি শর্ত দিয়ে একদিকে অলোচনার পথ উন্মুক্ত রাখলেন অপরদিকে বক্তৃতা শেষ করলেন এই কথা বলে যে, "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।" তিনি প্রকারান্তরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে বলেন।
ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড ঢাকায় অবস্থান করে পরিস্থিতির গুরুত্ব ও বঙ্গবন্ধুর ভাষণের তাৎপর্য ভালোভাবে অনুধাবন করে লিখেছেন, “রোববার ৭ই মার্চ প্রদত্ত মুজিবের ভাষণে তিনি যা বলেছিলেন তার চেয়ে লক্ষণীয় হলো তিনি কি বলেননি। কেউ কেউ আশঙ্কা করছিলেন আবার কেউ কেউ আশা করেছিলেন যে, তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করবেন। এর বদলে বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার লক্ষে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান তিনি জানালেন।” ৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় ঘোষণা দেওয়ার পর সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন, “You will see history made if the conspirators fail to come to their senses.” আশ্চর্য, বঙ্গবন্ধুর এই হুঁশিয়ারী উচ্চারণ বছর শেষ হতে না হতেই ফলে গিয়েছিল।
মূলত স্বাধীনতা সংগ্রাম স্বাধীনতা যুদ্ধের রুপ নেয় যখন ইয়াহিয়া - মুজিব বৈঠক চলাকালীন ২৫শে মার্চের কালরাতে জেনারেল টিক্কা খান “অপারেশন সার্চ লাইট” নামে নারকীয় গণহত্যা শুরু করে। ফলশ্রুতিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সশস্ত্রভাবে দমনের চেষ্টা হলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম সশস্ত্র রূপ ধারণ করলেও আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক সমর্থন এবং নৈতিক বৈধতা বাংলাদেশের পক্ষে চলে আসে। ১৯৭১ এর ৭ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ এই ১৮ দিনে এই ভাষণ বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষকে প্রস্তুত করেছে মুক্তির সংগ্রামে, স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। জন রিড (John Reed) রচিত বিশ্বখ্যাত 'Ten Days That Shook the World' বইতে উল্লেখিত যে ক’টি দিনে রাশিয়ায় মহামতি লেলিনের নেতৃ্ত্বে অক্টোবর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না বাঙালির কাছে ঐ ১৮ দিন স্বাধীনতার সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের। আর বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাটি এসেছিল ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি প্রাজ্ঞ ও কৌশলী ভাষণ। তাই পৃথিবীর অনেক রাষ্টবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক ৭ই মার্চের ভাষণকে নিয়ে করেছেন বহুমাত্রিক আলোচনা। বিশেষত দু'টি ভাষণের সঙ্গে তারা তুলনা করে থাকেন, যার একটি ১৮৬৩ সালের আব্রাহাম লিংকনের ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস’, তবে ভাষণটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত ও লিখিত ২৭২ শব্দের দুই মিনিটের ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষের সামনে। অপরটি ১৯৬৩ সালের মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ অ্য ড্রিম’, ভাষণটির প্রথমাংশ লিখিত ও পঠিত যা ১৬৬৬ শব্দের ১৭ মিনিটব্যাপী শ্রোতার সংখ্যা ছিল প্রায় দুই লাখ।
এছাড়াও অনেকের গবেষণায় তৎকালীন সমসাময়িক আরও দুটো ভাষণ তুলনায় উঠে এসেছে। ১৯৪০ সালের উইনস্টন চার্চিলের ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস’, ভাষণটি ৩৭৬৮ শব্দের ১২ মিনিট ১৬ সেকেন্ডব্যাপী যা শুধুমাত্র আইনসভার ৬০০ মানুষের সামনে দেওয়া হয়েছিল এবং ১৯৪৭ সালের জওহরলাল নেহেরুর ‘অ্যা ট্রাইস্ট উইথ ডেস্টিনি’, ভাষণটি ৭৫৫ শব্দের পাঁচ মিনিট নয় সেকেন্ডব্যাপী সেটিও সংবিধান পরিষদের ৫০০ মানুষের সামনে দিয়েছিলেন।প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণটি ছিল তাৎক্ষণিক, উপস্থিত ও অলিখিত। ১৮ মিনিট স্থায়ী ভাষণটি ১০৯৫ শব্দ-বুলেটের মালা গেঁথে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে শেষ করেন। ১০ লক্ষাধিক বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সামনে পাকিস্তানি হানাদারদের কামান-বন্দুক-মেশিনগানের হুমকির মুখে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে প্রদান করেন। ভাষণটি ছিল তার হৃদয়ের গভীরে যে বিশ্বাস, সেই বিশ্বাস থেকে উৎসারিত।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ক্ষমতাবান সরকারসমূহ ও বিশ্বসম্প্রদায় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিল। ১৯৭৪ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী শন ভ্যাকব্রাইড বলেছেন, "শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতাই যথেষ্ঠ নয়, প্রয়োজন মানুষের মুক্তি, বেঁচে থাকার স্বাধীনতা। সাম্য ও সম্পদের বৈষম্য দূর করাই স্বাধীনতার সমার্থ। আর এ সত্যের প্রকাশ ঘটে ৭ই মার্চের ভাষণে।" অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন বলেছেন, "তিনি ছিলেন মানব জাতির পদ প্রদর্শক।…তাঁর সাবলীল চিন্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয় সমস্ত পৃথিবীও স্বীকার করবে।" পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত সাবেক মূখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছেন, "৭ই মার্চের ভাষণ একটি অনন্য দলিল। এতে একদিকে আছে মুক্তির প্রেরণা। অন্যদিকে আছে স্বাধীনতার পরবর্তী কর্ম পরিকল্পনা।" কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছেন, "৭ই মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুধুমাত্র ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।" ।
গ্রেট ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ বলেছেন, "পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগরুক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।"
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী গণমাধ্যমেও এ ভাষণকে একটি যুগান্তকারী দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ হিসাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। ‘নিউজউইক’ সাময়িকীর বিখ্যাত রিপোর্ট, যেখানে বঙ্গবন্ধুকে অভিহিত করা হয়েছিল ‘পোয়েট অব পলিটিকস্’ হিসেবে। "৭ই মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয় একটি অনন্য কবিতা। এই কবিতার মাধ্যমে তিনি ‘রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি পান।" ১৯৯৭ সালে টাইম ম্যাগাজিনে বলা হয়েছে, "শেখ মুজিব ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমেই আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ঐ ভাষণে গেরিলা যুদ্ধের কৌশলও ছিল।" বিবিসি ১৯৭১- এর মতে "পৃথিবীর ইতিহাসে জন আব্রাহাম লিংকনের গেটিস বার্গ ভাষণের সঙ্গে তুলনীয় এই ভাষণটি। যেখানে তিনি একাধারে বিপ্লবী ও রাষ্ট্রনায়ক।"
থমসন রয়টার্স ১৯৭১-এর মতে "বিশ্বের ইতিহাসে এ রকম আর একটি পরিকল্পিত এবং বিন্যস্ত ভাষণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে একই সংগে বিপ্লবের রূপরেখা দেয়া হয়েছে এবং সাথে সাথে দেশ পরিচালনার দিকনির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।" একই সালে এএফপি বলেছে, "৭ই মার্চের ভাষণের মধ্যদিয়ে শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বাঙালিদের যুদ্ধের নির্দেশনাও দিয়ে যান। ঐ দিনই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।" দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট ১৯৭১-এর এক ভাষ্যে বলা হয়, "শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে ঐ ভাষণেরই আলোকে।" আনন্দবাজার পত্রিকা' ১৯৭২ এক নিবন্ধে বলা হয়, "উত্তাল জনস্রোতের মাঝে, এ রকম একটি ভারসাম্যপূর্ণ, দিকনির্দেশনামূলক ভাষণই শেখ মুজিবকে অনন্য এক ভাবমূর্তি দিয়েছে। দিয়েছে অনন্য মহান নেতার মর্যাদা।"
সম্প্রতি ইউনেস্কো মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে 'মেমোরি অফ দা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে' যুক্ত করেছে। বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হল ভাষণটি বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষণ। পৃথিবীর কোনো ভাষণ কোনো দেশে এতবার প্রতিধ্বনিত হয়নি। ভাষণটি ১২টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়! এই ভাষণটি কালজয়ী যুগোত্তীর্ণ ভাষণ। যুগে যুগে এ ভাষণ নিপীড়ত, লাঞ্ছিত স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রেরণা ও উদ্দীপনার উৎস হিসেবে কাজ করবে। পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগরুক থাকবে।
লেখক: ডেপুটি এটর্নি জেনারেল, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট।
এইচআর/এমএস