ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বাংলাকে বিপন্ন হতে দেব না

মোস্তাফা জব্বার | প্রকাশিত: ০১:৩৪ পিএম, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০

প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ফেব্রুয়ারি মাস এসেছে। প্রতি বছরই আসে আবার মাত্র ২৮/২৯ দিনে সেটি পারও হয়ে যায়। এরই মাঝে পত্র-পত্রিকা-টিভি ও অন্যান্য মিডিয়াতে ভাষা শহীদদের নিয়ে মাতম শুরু হয়েছে। প্রায় সবাই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস চর্চায় ব্যস্ত। অথচ ডিজিটাল যুগে বাংলা ভাষা ও হরফ যে বিপন্ন সেটি কাউকে বলতে শোনা যায় না। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ নিয়ে তেমন কোন আলোচনা হচ্ছেনা। তবে প্রতিবরের মতো এবারও একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার শহীদ মিনারে মানুষের ঢল নামবে।

দেশের অন্য শহীদ মিনারে প্রধানত ছাত্র-ছাত্রীরা কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুসারে প্রভাতফেরি করে ফুল দেবে। হয়তো জানবেওনা এই প্রভাতফেরি বা ফুল দানের কার্যকারণ কি? ঢাকার বইমেলা শেষ হবে ফেব্রুয়ারির শেষ দিন এবং তার পরের দিন ১ মার্চ থেকে সেই মাতমের ছিটেফোটাও আমরা কোথাও পাবনা। এমনকি বই প্রকাশও হয়তো পুরো এক বছরের জন্য থমকে থাকবে। কিন্তু এই মুজিববর্ষে শ্রদ্ধা জানানো উচিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি, যিনি এই ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। স্মরণ করুন এই মানুষটিকে যিনি ৫২ সালে চীনে এবং ৭৪ সালে জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় বক্তব্য রেখেছিলেন।

খোলামেলাভাবে বলতে গেলে বাঙালি তার বাংলা ভাষা বর্জনের স্থানটিকে খুব স্পষ্টভাবেই চিহ্নিত করে ফেলেছে। এককথায় যদি বলা হয় তবে এখন শহুরে বা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির ঘরোয়া মুখের ভাষা বাংলা হলেও তার ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প-কল-কারখানা বা দৈনন্দিন জীবনের আনুষ্ঠানিকতা কিংবা এমনকি লেখাপড়ার ভাষাও বাংলা নয়। ভাষার জন্য রক্ত দানকারী জাতির এমন ভিমরতি কেন হয়েছে তা গবেষকরা খুঁজে দেখবেন। তবে আমি খুব সহজেই অনুভব করতে পারি যে, পুঁজির বিকাশের ফলে একশ্রেণির বাঙালির কাক হয়ে ময়ূরের পুচ্ছ ধারণ করার প্রবণতা ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। তারা ইংরেজ হতে চাচ্ছে এবং তাতেই তাদের জীবনের মুক্তি বলে মনে করছে। অন্যদিকে অক্ষম বা ক্ষমতাহীন বাঙালির ভাষার নাম বাংলা। এই জনগোষ্ঠী বাংলা ছাড়া আর কোন ভাষা জানেনা। ভুল ইংরেজিও বলতে বা লিখতে পারেনা। বাংলা ছাড়া তার কোন গতি নেই।

সাংবিধানিকভাবে বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা হলেও একটি পুঁজিবাদী গোষ্ঠী নানা কৌশলে বাংলা বর্জনের চরম পথে পা বাড়িয়েছে। এর মাঝে ডিজিটাল রূপান্তরের নামে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব বিপন্ন করাটাই আমার নিজের কাছে চরম উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্য আমার বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে বাংলা ভাষার ডিজিটাল যাত্রার চ্যালেঞ্জের জন্য কি এই ভাষাটির ব্যবহার হ্রাস পাবার কোন যৌক্তিক কারণ আছে। এখন আমার মনে হচ্ছে যে একটি সময় আসবে যখন ডিজিটাল প্রযুক্তির নামে বাংলা ভাষার ব্যবহার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যদিও ৩৫ কোটি লোকের ভাষা বা তার চাইতেও বেশি মানুষের হরফ পুরোপুরি হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও বাংলাদেশের সাধারণ কাজে বাংলার ব্যবহার উদ্বেগজনকভাবে কমছে। বিশেষ করে ডিজিটাল যুগের আগে আমরা বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যতোটা সচেতন ছিলাম এখন সেটি নেই।

আমি তাই মনে করি বাঙালী জাতির মাতৃভাষার সহস্রাধিক বছরের ইতিহাসে এর উৎপত্তি, বিকাশ, রূপান্তর ও সমৃদ্ধির পথচলায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে এর ডিজিটাল যাত্রা। সেই ১৭৭৮ সালে বাংলা হরফের মুদ্রণ বা ৭২ সালে এর বাংলাদেশের বাংলা টাইপরাইটারে যাত্রা, আশির দশকে ফটোসেটারের উদ্ভব, ৮৭ সালে কম্পিউটারে বাংলা পত্রিকা প্রকাশ থেকে এই সময়ে ডিজিটাল উপায়ে বাংলার ব্যবহারের মাঝে রয়েছে প্রযুক্তিগত বিবর্তনের-উদ্ভাবনের অসম সাহসী ইতিহাস। অন্যদিকে ২০ সালে বাংলা ভাষা ও তার লিপি ডিজিটাল যাত্রার এক অসাধারণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রথম বার বাংলা ভাষার ডিজিটাল যাত্রার পথে সবচেয়ে বড় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার লগ্ন উপস্থিত হয়েছে। সরকার ১৫৯ কোটি ২ লাখ টাকার একটি প্রকল্প তৈরি করে তার সহায়তায় বাংলা ভাষার ডিজিটাল যাত্রার সহায়ক ১৬টি টুল উন্নয়নের কাজ শুরু করেছে। কম্পিউটার দিয়ে বাংলা পত্রিকা প্রকাশের তেত্রিশ বছর পূর্তির সময়ে আমরা বাংলা ভাষা ও বর্ণমালার ডিজিটাল যাত্রাকে একটু ভালো করে ব্যাখ্যা করে দেখতে চাই। আমার তেত্রিশ বছরের লড়াই-এ এমন একটি সময় এর আগে আর কখনও আসেনি বলেই আমি মনে করছি। এখনই সময় পুরো প্রেক্ষিতটি পর্যালোচনা করার।

গত শতাব্দীতে বাংলাদেশের বাংলা ভাষার জন্য সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ছিলো কম্পিউটারে বাংলা ভাষার প্রচলন। যদিও আশির দশকের শুরুতেই বাংলাদেশের নাগরিকদের দ্বারাই এই কাজটি শুরু হয়, তথাপি এটি কার্যত এক নতুন মাইলফলক হিসেবে আবির্ভূত হয়, ১৯৮৭ সালের ১৬ মে, আমার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক আনন্দপত্র প্রকাশের মাধ্যমে সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে কম্পিউটার প্রয়োগের সূচনা দিয়ে। এরপর কম্পিউটারে বাংলা ভাষার বড় ঘটনাটি হচ্ছে ১৯৮৮ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় কীবোর্ড-এর আত্মপ্রকাশ-এর মাধ্যমে। এই শতকে এসে এটি আরও সম্প্রসারিত হয় এবং সকল প্রকারের ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলার প্রয়োগ ঘটতে থাকে।

বস্তুত ১৯৮৭ থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তেই বাংলা ভাষার ডিজিটাল যাত্রায় কোন না কোন উন্নয়ন হয়েছে। একটি নতুন ফন্টের ডিজাইন, মাউস দিয়ে বাংলা লেখার সুযোগ তৈরি, বাংলায় ইমেইল প্রচলন, বাংলা অভিধান, ইউনিকোডে বাংলা, নতুন নতুন কীবোর্ড-এর জন্ম, কীবোর্ড প্রমিতকরণ, বিডিএস ১৫২০: ২০১৮ প্রণয়ন, বিডিএস ১৯৩৫:২০১৮ প্রণয়ন বা বিডিএস ১৮৩৪:২০১৮ প্রণয়ন, মোবাইলের জন্য বাংলা বাধ্যতামূলক করা বা একটি নতুন সফটওয়্যারে বাংলা লেখার সুযোগ তৈরি হওয়া-এসব চলেই আসছে। এরই মাঝে আমরা ডট বাংলা ডমেইন চালু করেছি। সবচেয়ে বড় কথা ২০১৭ সালে সরকার ১৫৯.০২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে বাংলা ভাষার জন্য ১৬টি টুলস উন্নয়ন করার উদ্যোগ নিয়ে সেটি বাস্তবায়ন করছে। এসব কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে যে বাংলা একটি জীবন্ত ভাষা এবং বাংলা ভাষাভাষীরা অসাধারণ মেধাসম্পন্ন জাতি। এটিও এতে প্রমাণিত হয় যে বাঙালি জাতি বাংলা ভাষা ও হরফকে পুরোই ভুলে যায়নি। এতে এটিও প্রমাণিত হয় যে কিছু লোক বাংলাবিদ্বেষী হলেও আমরা এখন নিজেদেরকে ততোটা অসহায় বিবেচনা করতে পারিনা। তবে এই বিষয়টিও আমরা এখন অনুভব করছি যে স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষার যতোটা উন্নয়ন হতে পারতো তা আমরা বিগত ৫০ বছরেও করতে পারিনি। বিশ্বের উন্নত ভাষাসমূহের সাথে তুলনা করার মতো সমন্বিত উদ্যোগ আমাদের এর আগে ছিলো না। এবার সম্ভবত সেই দুঃস্বপ্নকে অতিক্রম করার সময় হয়েছে।

আমি ৮৭ সালের ২৮ শে এপ্রিল কম্পিউটারের বোতাম স্পর্শ করা থেকে এই লেখা সম্পাদনার মুহূর্ত পর্যন্ত ডিজিটাল বাংলার এই স্রোতধারায় একীভূত হয়ে মিশে আছি। আমার রক্তের প্রতি ফোটায় বাংলা ভাষা ও তার হরফ বিরাজ করে। ফলে আমার সাথে যেমনি আছে ডিজিটাল বাংলার ইতিহাস, তেমনি আছে এর সমস্যা, সংকট, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা। বিভিন্ন সময়ে আমি এসব বিষয় নিয়ে লিখেছি। যেমনি করে নিজের সকল শক্তি দিয়ে ডিজিটাল বাংলার যাত্রাপথ সুগম করেছি তেমনি এই যাত্রা পথে যখনি কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে তখনি তাকে সরানোর জন্য প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছি। জাতিগতভাবে বাংলা ভাষা নিয়ে নীরব থাকার মানুষ নই আমরা। সেই ৪৭ সালে যখন পাকিস্তানের মোহ এই জনপদকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো, তখনও আমরা বাংলার সামান্য অবমূল্যায়ন সহ্য করিনি। এর আগেও যখন বাংলা ভাষা রক্তচক্ষুর চাপে পড়েছে তখনও বাঙালিরা প্রাণের ভয় করেনি।

কিন্তু একটি চরম সত্য কথা হচ্ছে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে বাংলা ভাষার যেসব চ্যালেঞ্জ ছিলো এখন তেমনটি আর নেই। পাকিস্তান আমলে আমদের লড়াই ছিলো বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। রক্ত দিয়ে সেই লড়াইটা আমরা করেছি। কিন্তু স্বাধীনতার পর প্রথম লড়াইটা ছিলো অফিস আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলন করা। অতীতে কোনদিন যে ভাষা অফিস বা আদালতের ভাষা হতে পারেনি সেই ভাষাকে বঙ্গবন্ধু সরকারি ভাষা হিসেবে প্রবর্তন করেন। তিনি যান্ত্রিক সংকটও দূর করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সরকারিভাবে বাংলাকে নির্বাসিত করার চেষ্টা করা হয়। সামরিক শাসকরা মজ্জাগতভাবে ইংরেজির দাস হবার ফলে বঙ্গবন্ধু সরকারি অফিসে বাংলা ব্যবহারের যে বাধ্যবাধকতা চালু করেছিলেন তাকে শিথিল করা হয়।

স্বৈরাচারী শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে সরকারি কাজে বাংলা ব্যবহারের জন্য আইন করলেও পরবর্তীতে সেটি তামাশায় পরিণত হয়। এখন সরকারি অফিসে গ্রামের রাস্তার উন্নয়নের প্রকল্প ইংরেজিতে প্রণীত হয়। সেমিনারের ভাষা হয় ইংরেজি। তারা কথা বলেন ইংরেজিতে, প্রবন্ধ লিখেন ইংরেজিতে। বেসরকারি বড় বড় অফিসে বাংলা একেবারেই নেই। উচ্চ শিক্ষায় বাংলা নেই। উচ্চ আদালতেও বাংলা নেই। এমনকি সাধারণ শিক্ষায় বাংলার ব্যবহার ইংরেজিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। তথাকথিত ইংরেজি মাধ্যম ও ইংলিশ ভার্সনের বদৌলতে শিশুদেরকে মাতৃভাষা বর্জন করতে হচ্ছে।

কেউ কেউ এই কথাটি বলতে পারেন যে, বাংলাকেতো ইংরেজির মতো ব্যবহার করা যায় না। এর ব্যাকরণ ও বানান শুদ্ধিকরণ সফটওয়্যার নেই। এর জন্য প্রণীত অপটিক্যল ক্যারেক্টর রিডার সফটওয়্যার কজ করেনা। এর অনুবাদক সফটওয়্যার নেই বা খুব ভালো করপাস গড়ে ওঠেনি। এসব সত্য কথা। কিন্তু আমরা ২০১৭ সালে এসে সেই সত্যকে অতিক্রম করার পথে পা দিয়েছি। শেখ হাসিনার সরকার ৩ জানুয়ারি ২০১৭ অনুষ্ঠিত একনেকের সভায় ১৫৯.০২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে তার মাধ্যমে ১৬টি টুলস উন্নয়ন করার প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বাংলা ভাষার ডিজিটাল টুলের ঘাটতিটা কেটে যাবার কথা।

তবে বাংলা ভাষার বর্তমান সংকটটা কেবল টুলসের অপ্রাপ্যতা নয়। সংকট মানসিকতার। আমরা আমাদের জীবনধারায় বাংলাভাষাকে ঠাঁই দিচ্ছিনা। বাড়িতে নিজেরা বাংলায় কথা বললেও বিয়ের দাওয়াতের কার্ডটাও ইংরেজিতে করি। এমনকি আমাদের নতুন প্রজন্মের কিছু লোক রোমান হরফে বাংলা বা রোমান হরফ দিয়ে লিখে বাংলায় রূপান্তর করার কুচর্চা করছে। এর ফলে বাংলা ভাষার বানান চর্চায় কেবল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়নি বরং দিনে দিনে একটি প্রজন্ম বাংলা হরফ বা যুক্তাক্ষর চিনতে ভুলে যাচ্ছে। এই চরম অরাজক অবস্থা আমরা মানতে পারিনা। কিছু বিভ্রান্ত মানুষের জন্য বাংলা ভাষা ও বর্ণমালাকে আমরা বিপন্ন হতে দিতে পারিনা। এখনো আমরা আমাদের সেই পূর্বপুরুষদের পথ ছাড়িনি। বাংলার জন্য তাই আমাদের লড়াইটা চালু আছে। থাকবে।

এইচআর/এমএস