গরিবের সঞ্চয়েও হাত লুটের দায় জনগণের?
হাজার-হাজার কোটি টাকা পাচার, রিজার্ভ চুরি-লুট, খেলাপি ঋণ, দুর্নীতি-ঘুষ রোখা যাচ্ছে না। সেগুলো উদ্ধারের খবরও নেই। এসবের হোতারাও অধরা-দুর্দমনীয়। কিন্তু, গরীবের সঞ্চয়ে হাত ঢোকানো যায় নিমিষেই। একটা প্রজ্ঞাপনেই ডাকঘর সঞ্চয় মুনাফা ১১.২৮% থেকে এক লাফে কমিয়ে ৬%-এ নামিয়ে এনেছে সরকার। প্রতিবাদে টু-শব্দও নেই।
এরফলে, পেনশনভোগী, দরিদ্র, নিম্নআয় থেকে যতসামান্য জমা করা মানুষের বিনিয়োগের জায়গাটা তলানিতে চলে এলো। তাতে কি? তাদের হা-হুতাশ ছাড়া করনীয় কিছু নেই। শব্দ করে কান্নার সামর্থও নেই। আবার জেদ করে শেয়ারবাজার লুট, ব্যাংকের টাকা হাইজ্যাক, বিদেশে টাকা পাচার, দুর্নীতি করার হিম্মতওয়ালাও নন তারা। এর আগে, দফায়-দফায় কমিয়েছে বিভিন্ন ধরনের জাতীয় সঞ্চয়পত্রের লাভ। ব্যাংকগুলোর দরিদ্রবান্ধব সঞ্চয়স্কিম ‘নাই’ করে ফেলা হয়েছে বহু আগেই। মোটকথা গরীব মারার প্রকল্পে কোথাও বাধা পড়ছে না। তারা দুর্বল-কমজুরি। তাই বলে অপরাধীও?
বিদেশে টাকা পাচারে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশকে এই গরীবরা নেয়নি। ব্যাংক লুটও তারা করে না। পাচার-ঋণখেলাপিতেও জড়িত নয়। করার মধ্যে না খেয়ে না দেয়ে কিছু সঞ্চয় করে। সেটাই গুরুতর অন্যায়? সরকার সমাজের এই শ্রেণিটাকে নিস্পেষণের জন্য বেছে নিল কেন?-এ প্রশ্নের নানামুখী জবাব রয়েছে। মোটাদাগের কারণ হচ্ছে, এরা গোবেচারা। মেরে-ঠেলে খাদে ফেলে দিলেও আওয়াজ করে না এরা। সরকারের জন্য ক্ষতির ঝুঁকিমুক্ত এরা। অন্যদিকে, লুটেরা শ্রেণি দাপটশালী। তাদের লালন-পালন, তোষণ লাভজনক। আবার সরকার অর্থনৈতিক টানাপড়েনে আছে-এমন তথ্যও বেশ প্রচারিত। সরকারের খরচ বেড়ে চলছে। আয়-রোজগার কমছে। অভাবের ঘরে আবার চুরি-চেছরামি, লুটপাট, হরিলুট।
এই ছিদ্দত কাটাতে মাঝেমধ্যেই সরকার হাত দেয় ব্যাংকে। ছয় মাসের মধ্যে এক বছরের চেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে। তারপর নতুন আইন করে হাত দিয়েছে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর অর্থে। যেখানে সরকার নিজেই অতি উচ্চ পরিমাণে ব্যাংকঋণ করছে, সেখানে বেসরকারি খাতে এবং ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়বে কীভাবে? ২০১১-১২ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ২২ দশমিক ৫ শতাংশ, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসে ২৩ দশমিক ২৬ শতাংশে স্থবির হয়েছে। সরকারের অতি উচ্চ ঋণের প্রভাবে ১১ বছরে বেসরকারি খাতে ঋণ সর্বনিম্ন ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশে এসে পৌঁছেছে।
স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইন্যান্সিয়াল করপোরেশনসহ স্বশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থের স্থিতি ২ লাখ ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। সরকার স্বশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ রাষ্ট্রের কোষাগারে নিয়ে যাওয়ার আইন পাস করেছে। এখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শেয়ার পুঁজিবাজারে দেওয়া হচ্ছে ব্যাংকের হারানো তহবিলের ঘাটতি কমাতে। অথচ ব্যাংকের টাকা যারা নিয়ে গেল, তাদের ধরছে না। এখন সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোয় দেশের দুর্বল অংশের সঞ্চয়ে হাত। টাকার খোঁজে দিশেহারা সরকারের পাশে দাঁড়ানোটা নাগরিক হিসেবে তাদের যেন নৈতিক দায়িত্ব। তাদেরকে যার যা আছে তাই নিয়ে সরকারের পাশে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য করা? তাদের তো আছে বলতে জীবনটা। আর কৃপনতা করে যতসামান্য সঞ্চয়।
তারা সংগঠিত নয়। তবে, সংখ্যায় অনেক। কিন্তু, সরকারের জন্য হুমকি হয়ে ওঠার মতো জনশক্তি নয়। অন্যদিকে, রাজনৈতিক প্রভাবশালী, ব্যাংক মালিক, পরিচালকরা বোঝাপড়ায় শক্তিমান। ভাগবাটোয়ারায় বুঝবান। লুটপাটের টাকায় সেকেন্ড হোমে আরাম-আয়েশ তাদের। ইনডেমনিটির মতো তাদের সুরক্ষা ব্যবস্থা আছে। এর বাইরেও নানান অভয় ও প্রণোদনা রয়েছে তাদের। এমন স্বস্তিদায়ক অবস্থায় কেবল লুট নয়, লুট করে যাওয়ার সময় আগুন দিয়ে সব ছারখার করে যেতেই ভয় কিসের? এ ধরনের ঘটনায় সচরাচর দোষী সাব্যস্ত হন গিরস্থই। বিশ্বের এক নম্বর অর্থমন্ত্রী থাকতে কেন এ দশা হবে-এমন জিজ্ঞাসাও রয়েছে মানুষের। যে কারণে দেশের অর্থনৈতিক এ পরিস্থিতিটি ইচ্ছাকৃত কি-না, প্রশ্ন আছে কম বোঝা মানুষের শধ্যে। তারা সোজা হিসাব বোঝে। তারা সাদা চোখেই দেখছে, যাদের হাতে টাকার থলি তারাই টাকার খোঁজে হয়রান।
প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসে। রফতানির মাধ্যমেও আসে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে দাবি করে সরকার। প্রধান খাদ্যশস্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় না। তারপরও কেন দেশ অর্থ সংকটে পড়বে? দেশের টাকা, জনগণের টাকা লুটপাট করে বিদেশে পাচার করলে দেশ অর্থনৈতিক ভাবে দেউলিয়া হয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। সরকার সেটা থামায় না কেন? কেন হয় না বিচার? কেনই বা হানা ক্ষুদ্রদের সঞ্চয়ে?
আমানত সুরক্ষার খসড়া আইনে বলা হচ্ছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসায়নে সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ মাত্র এক লাখ টাকা। এতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লালবাতি জ্বললে মাঝারি ও বড় আমানতকারীদের সুরক্ষাহীন হয়ে ভীত হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এক অঙ্কের সুদনীতির সঙ্গে এটা সরাসরি সাংঘর্ষিক মনে হচ্ছে। কেননা, ৬ শতাংশের ওপরে থাকা মূল্যস্ফীতির সমান বা তারও কম সুদের ফলে লোকে যখন ব্যাংকে টাকা রাখতেই উৎসাহ হারাচ্ছে, তখন দরকার ছিল গ্রহণযোগ্য শতাংশ হারে আমানতের বিমা নিশ্চয়তা দেওয়া। ২০০০ সালের আইনেও এক লাখ টাকার সুরক্ষা থাকলেও ২০ বছর পরে এসেও তা মূল্যস্ফীতি যোগ করে পুর্নির্ধারণ করা হয়নি-যেমনটা ভারতে করা হয়েছে অতি সম্প্রতি।
নতুন আইনে টাকার অঙ্ক বদলায়নি, সংযোজন শুধু নন–ব্যাংকিং আর্থিক খাত। আমানত সুরক্ষার অঙ্ক বাড়ালে বিমা খরচ কিছুটা বাড়লেও নতুন আমানত উৎসাহ পেত। কিন্তু তা না করায় লোকে ব্যাংকে টাকা রাখা কমিয়ে দেবে। এতে ঋণপ্রবাহে দীর্ঘতর নেতিবাচক ধারা সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবশালী, ব্যাংক মালিক, পরিচালক ও ব্যবসায়ী—এই চার পক্ষ বোঝাপড়ায় একের পর এক জালিয়াতির মুখে আর্থিক খাত যখন টালমাটাল, তখন এমন আইন বৈধ এবং অবৈধ উভয় ধরনের পাচার বাড়াতেই উৎসাহ দেবে। আশঙ্কা হয়, উদ্দেশ্যমূলক ব্যাংক লোপাট করে, আইনি কাঠামোয় দায়মুক্তি দেওয়ার ফন্দি এটা নয় তো! এর মাধ্যমে আমরা কি এই সংকেত পাচ্ছি যে, ব্যাংকগুলো আবারও লুটের কবলে পড়তে যাচ্ছে? বড় ধরনের অনাস্থা ও অবিশ্বাসের প্রেক্ষাপটে, নতুন আইনের মাধ্যমে ব্যাংকের আমানত কমে ঋণপ্রবাহে দেখা দিতে পারে আরও বেশি নেতিবাচক ধারা।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, বাংলা ভিশন।
এইচআর/জেআইএম