ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

‘ছোবল’ নতুন প্রজন্মকে বার্তা দেবে

মাকসুদা আখতার প্রিয়তী | প্রকাশিত: ০২:৪২ পিএম, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

একুশে বইমেলার মৌসুমটা আসলেই মনের ভিতর কেমন যেন এক বিশেষ আলোড়নের সৃষ্টি হয়। দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে থাকি, তারপরেও মনে হয় কেন যেন এই উৎসবটার জন্যই হয়ত পুরো বছর অপেক্ষা করে থাকি। দূর থেকেই অনুভব করতে পারি তার কম্পন। মনে পড়ে যায়, স্কুলের বইমেলার কথা।

স্কুলে যখন বইমেলা হতো, বাড়ি থেকে মাত্র দুটো বই কেনার টাকা দিত। কিন্তু আমার তো দুটি বই কিনে মন ভরতো না। আমার আরও বই লাগবে। বইমেলা থেকে কত বার যে বই চুরি করেছি তা আপাতত মনে নেই। বই পড়ার প্রতি এক ধরনের নেশা ছিল। বাড়ির কাজের খাতার পিছনে কত শত ছোট ছোট গল্প লিখেছিলাম, তা এখন মনে করে আফসোসের শেষ নেই। তখন লিখতাম, আর ভাবতাম কি সব হাবিজাবি লিখছি, ছিঁড়ে ছুড়ে ফেলে দিতাম। ওইসব লেখা পড়ার কিংবা লেখার প্রতি উৎসাহ দেবার মতো আমার কেউ ছিল না ওই বয়সে। গুরুত্ব দেইনি।

কিশোর বয়সের শুরুতেই যখন প্রেমে পড়েছিলাম, সেই প্রেমিক আমার বই পড়ার প্রতি আসক্তি দেখে প্রথম যে উপহার দেয়, তা ছিল বই। সেই সময়ের যত বই পড়েছি তার একটার নামও আমি এখন বলতে পারব না। এই নাম নিয়ে আমি বেশ বিড়ম্বনায় পড়ি। কোন কিছুর নাম মনে থাকে না। হোক না তা মানুষের কিংবা বইয়ের কিংবা জায়গার। সে যাক গে, বাংলাদেশ থেকে যখন আয়ারল্যান্ডে আসি, তখন আমার লাগেজ এর ওজন বাড়ে শুধু বইয়ের কারণে। সব কিছু বাদ দিয়ে যেন আমার বই নিতে হবে। তাতে তখন মা বেশ বিরক্ত হয়েছিল বৈকি। কিন্তু আমার আবদার, জেদ আর আল্লাদের কাছে মা, পরাজিত।

এরপর থেকে যখন দেশে আসতাম লাগেজ এলাউন্সের সিংহভাগ চলে যেত বইয়ের ওজনে। কি যে রাগ উঠতো এয়ারলাইনওয়ালাদের ওপর! তাদের কি দরকার এত লাগেজের ওজন এর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে? অন্তত ছাত্রদের বই নেয়ার ওপর কিছুটা ছাড় দিতেই পারেন, উনারা। আমার মনে আছে, প্রবাস জীবনের শুরুর দিকে, এয়ারপোর্টে এমন (বইয়ের) অনুরোধ করে ওজন বেশি হলেও কয়েকবার বই নিয়ে যেতে পেরেছিলাম, কিন্তু পরের দিকে উনারা বেশ কড়া হয়ে যান। এখন তো আর ভাবাই যায় না।

আমি যেই সঙ্গীর সাথে ছিলাম, বাসা বদলানোর সময় বেশ বিরক্ত হয়ে যেতেন, আমার বইগুলো এক বাসা থেকে আরেক বাসায় স্থানান্তর করতে। কিন্তু আজ সেই প্রাণপ্রিয় বইগুলো আমার কাছে আর নেই, যখনই মনে পড়ে ভিতর টা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। কারণ আমি তো আর চাইলেই নীলক্ষেতে গিয়ে সেই বই কিনে আনতে পারবো না।

জীবনের ব্যস্ততা আস্তে আস্তে কেমন করে যেন কিছু বছরের জন্য বই থেকে দূরে সরিয়ে ফেলল। গত ২০১৬ সাল থেকে আবারও বইমেলায় যাওয়া শুরু করলাম। সেই প্রাণের বইমেলা। নতুন বইয়ের গন্ধ, সব কবি- লেখকদের আনাগোনা, পরিবারের সকল সদস্যরা মিলে একত্রে যাওয়া, নতুন প্রেমিক-প্রেমিকারা হাত ধরে ঘুরে ঘুরে বই কেনা, উপহার দেয়া। অন্য একরকম আবহ বয়ে বেড়ায় এই একুশে বইমেলার প্রাঙ্গণে। তাদের দেখে আমার প্রচণ্ড ইচ্ছা-ক্ষুধা জাগে, আমিও প্রিয়জনের হাত ধরে ধরে মেলায় ঘুরে ঘুরে পছন্দের বইগুলো কিনি। যদিও সেই সাধ আজ পর্যন্ত মেটেনি। জানি না কখনো মিটবেও কি-না।

chobol

আমি বাংলা লেখার চর্চা আবার শুরু করি ২০১৪ সাল থেকে যেই বছর আমি মিস আয়ারল্যান্ড খেতাব অর্জন করি। ছোট ছোট লেখা লিখে অনেক অনুপ্রেরণা পাই সবার মাঝ থেকে। এই অনুপ্রেরণা আমাকে নিয়ে পৌঁছায় আমার জীবনী ‘প্রিয়তীর আয়না’ লেখা পর্যন্ত, যা আমি আমার দায়িত্ব মনে করেছি, সমাজের মানুষগুলোর প্রয়োজনে। আমাদের সমাজ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে চোখকান বন্ধ রাখে, তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে সতর্ক বার্তা পৌঁছানো আমার দায়িত্ব ছিল। দায়িত্ব ছিল নারীদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দেয়ার, যেখান থেকে হয়তো কেউ কেউ নতুন উদ্যমে আবার জীবন নতুন করে শুরু করার প্রত্যয়ী হবেন। নিজের ভিতর নিজেই হয়তো সাহস জোগাবেন। অনেকের কণ্ঠস্বর হয়ে কথা বলেছি, প্রিয়তীর আয়নায়।

‘প্রিয়তীর আয়না’ পাঠকদের মাঝে সাড়া ফেলার পর আমি আমার পরবর্তী দায়িত্বের দিকে এগোই। আমার দায়িত্ব নব প্রজন্ম বা এখনকার প্রজন্মকে জানানো গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের আড়ালের আসল বীভৎস রূপ। দেশ কিংবা আন্তর্জাতিক অঙ্গন, যা নিয়ে আমরা কম বেশি শুনলেও যারা সফল এই ক্ষেত্রে উনারা সচারাচর ভিন্ন রূপ নিয়ে কথা বলেন না বা সতর্ক করেন না। তাই লেখা শুরু করলাম ‘ছোবল’। কাল্পনিক নয়, সত্য ঘটনা নিয়ে লেখা আমার পরবর্তী বই ‘ছোবল’।

যশ খ্যাতি, ক্ষমতা, অর্থ, গ্ল্যামার, পরিচিতি, জনপ্রিয়তা, বিলাসবহুল জীবনযাত্রা ইত্যাদি এই জাতীয় ক্ষুধায় হাজারো মানুষ বিশ্বব্যাপী শো-বিজ অঙ্গনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে নিজের স্বপ্নকে পিছু করতে করতে। স্বপ্নের পথে যাত্রা এক জাদুর মতোই সুন্দর, যতক্ষণ পর্যন্ত স্বপ্নের সাথে বিশেষ লেনদেনের আদান-প্রদান না হয়। এই হাজারের ভিড়ে কেউ কেউ সফলতার চূড়ান্ত শিখায় পৌঁছাতে পারে কিংবা কেউ কেউ খুব কাছাকাছি পৌঁছায়। আবার কেউ কেউ সফলতার সুরঙ্গ পথে পথভ্রষ্ট হয়ে অন্ধকারে তলিয়ে যায়, কেউ টেরও পায় না।

অনেক সফল ব্যক্তিরা সফলতার গল্প শোনায়, যেই গল্প শুনে নতুনদের চোখ জ্বল জ্বল করে ওঠে আশার আলোয়। কিন্তু সবাই মুদ্রার এক পিঠের গল্প শোনালেও, অপর পিঠের গল্প আড়াল করে যায়। কেউ সতর্ক করে না, আলোচনা করে না সেই পথে থাকা সুপ্ত অভিশাপগুলোর কথা, যা হয়তো তিনি নিজে দেখে এসেছেন কিংবা নিজেও সেই অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে হেঁটে এসেছেন। কেনো করেন না? জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে নাকি নিজেরই মুখোশ উন্মেচন হওয়ার ভয়ে? কেন স্বীকার করেন না, প্রতিবাদ করেন না, সেই কালো অধ্যায়গুলোর উপস্থিতির কথা? কেন সবাই জেনেও না জানার ভান করেন? কারা মূলত দায়ী?

‘ছোবল’ জানাবে তাদের চোখে আঙুল দিয়ে সত্যি কিছু ঘটনা, বর্ণনা দিবে মুদ্রার দুই পিঠের চিত্রকে। নব প্রজন্মদের মাঝে কিছু জরুরি বার্তা পৌঁছানোর জন্য এই ‘ছোবল’ বইয়ের জন্ম।

লেখক : বৈমানিক, সাবেক মিস আয়ারল্যান্ড, মডেল।

এইচআর/জেআইএম