ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বালু উত্তোলন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে

সম্পাদকীয় ডেস্ক | প্রকাশিত: ০২:১৮ পিএম, ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০

নদী বিষয়ক নাগরিক সংগঠন রিভারাইন পিপলের প্রতিষ্ঠাতা ও মহাসচিব শেখ রোকন নদী বিষয়ে লেখালেখি ও গবেষণা করেন। নদী বিষয়ে তার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গ্রন্থ ও গবেষণাপত্র রয়েছে। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষকতাও করেন। বালু উত্তোলন এবং নদ-নদীতে এর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন ধরে। এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

প্রশ্ন: বাংলাদেশের নদ-নদীর সংকটগুলোর মধ্যে বালু উত্তোলন কতটা গুরুতর?
শেখ রোকন: আমি আগেও লিখেছি, বলেছি- বাংলাদেশের নদ-নদীর প্রধান সংকট চারটি; প্রবাহস্বল্পতা, দখল, দূষণ, বালু উত্তোলন। এই চার সংকটই আবার পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। সংক্ষেপে বলি। প্রবাহস্বল্পতা দেখা দিলে সেই নদীতে প্রথমে দখলের আপদ আসে। কারণ প্রবহমান নদীতে দখলের প্রকোপ কম। যে কারণে আমরা দেখি, গঙ্গা বা ব্রহ্মপুত্রের মতো প্রবল নদীতে দখল দূরে থাক, মানুষ বরং নিরাপদ দূরত্বে থাকতে চায়। নদী দখল করে যখন আবাসিক, বাণিজ্যিক এলাকা, শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠে, সেগুলোর হাত ধরে আসে দূষণ। আবার প্রবাহ যখন কমে যায়, তখন বালু উত্তোলন শুরু হয়। যখন নগর বা জনপদ সম্প্রসারিত হতে থাকে, তখন তার প্রয়োজনে কাছ থেকেই বালু উত্তোলন শুরু হয়।

প্রশ্ন: ভাঙন সংকট নয়?
শেখ রোকন: ভাঙনও এক ধরনের সংকট, তবে মূলত ওপরে যে চারটি সংকটের কথা বললাম, তার প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ভাঙন। সন্দেহ নেই, ব-দ্বীপের নদী ভাঙবেই। আমাদের এখানে সঙ্গীত সৃষ্টি হয়েছে- একূল ভাঙে ওকূল গড়ে এই তো নদীর খেলা। কিন্তু আমাদের দেশে ভাঙন নিছক প্রাকৃতিক নয়। প্রবাহস্বল্পতার কারণে তলানী প্রবাহ বা সিল্টেশন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে নদীখাত উঁচু হয়ে যায়। ওই কম গভীরতার নদীতে বান ডাকলে পানি তীরের দিকে ছোটে এবং দেখা দেয় ভাঙন। আবার যখন দখলে নদী সংকীর্ণ হয়ে আসে এবং ‘রুম ফর রিভার’ কমে আসে, তখন শুকনো মৌসুমে যেনতেনভাবে চললেও বর্ষা মৌসুমে বিপুল পানি আর ধারণ করতে পারে না। দেখা দেয় ভাঙন। আর বালু উত্তোলনের কারণেও ভাঙন দেখা দেয়। কারণ যত্রতত্র বালু উত্তোলনের ফলে প্রবাহের যে ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা, সেটা নষ্ট হয়।

প্রশ্ন: বর্তমানে প্রায় সারাদেশেই নদী থেকে বালু উত্তোলন করতে দেখা যায়। এই প্রক্রিয়া কীভাবে শুরু হলো?
শেখ রোকন: দেখুন, ঐতিহাসিকভাবেই নির্মাণ কাজের জন্য নদী থেকে বালু তোলা হতো। বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহের কিছু নদী এজন্য নির্দিষ্ট ছিল। আপনি দেখবেন ‘সিলেট স্যান্ড’ নামে একটি বালির ব্র্যান্ড তৈরি হয়েছিল। সম্ভবত সবচেয়ে ভালো মানের বালু, নির্মাণ কাজের জন্য। এর বাইরে সারা দেশেই ব্যাপক মাত্রায় বালু উত্তোলন শুরু হয় আসলে নব্বইয়ের দশক থেকে। ওই সময় দেশে কংক্রিটের নির্মাণ কাজ ব্যাপক হাওরে শুরু হয়। এমনকি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এই দশক থেকে ব্যাপক মাত্রায় পাকা বাড়ি-ঘর নির্মাণ চলতে থাকে। রাস্তা-ঘাট পাকা হতে থাকে। স্কুল, কলেজ, অফিস আদালত ভবন পাকা হতে থাকে। এর ফলে যেমন জাতীয়ভাবে, তেমনই স্থানীয়ভাবে বালুর চাহিদা বাড়তে থাকে। আপনি দেখবেন, একই সময়ে নিম্নভূমি, জলাভূমি, পুকুর, নালা, এমনকি বিল-ঝিলও ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ চলতে থাকে। ফলে হঠাৎ করেই বালির চাহিদা ব্যাপক বেড়ে যায়। এই বালি কোথা থেকে আসবে? সহজ উৎস হিসেবে নদীর দিকে নজর দেয় বালু ব্যবসায়িরা।

প্রশ্ন: তাহলে বালুমহাল ঘোষণা শুরু হলো কবে থেকে?
শেখ রোকন: এটা আরও অনেক পরে। জলমহাল বা জঙ্গলমহাল যেমন কয়েক শতাব্দি প্রাচীন, বালুমহাল তেমন নয়। এমনকি কয়েক দশক পুরানোও নয়। এই সেদিন, ২০১০ সালের ডিসেম্বরে, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন প্রণীত হয়। তার পরের বছর এপ্রিলে প্রণীত হয় বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা বিধিমালা। এই আইন ও বিধিমালা আসলে দেশজুড়ে আগে থেকেই চলমান বালু উত্তোলনকে লিগ্যালাইজ করার উদ্যোগ ছাড়া কিছু ছিল না। আইন ও বিধিমালা পাশের পর ভূমি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে জেলা প্রশাসন থেকে বেশ কিছু নদীতে বালুমহাল ঘোষণা করা হয় এবং জলমহালের মতো করে ইজারা দেওয়া হতে থাকে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে কতগুলো বালুমহাল আছে?
শেখ রোকন: এক অর্থে কঠিন প্রশ্ন। এই সংখ্যা স্থায়ী থাকে না। জেলাওয়ারি প্রতিবছর নতুন করে বালুমহাল নির্ধারন করা হয়। সাধারণত বৈশাখ মাসের আগে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয় জেলা প্রশাসনের পক্ষে। তার আগে ওই বছরের জন্য বালুমহাল নির্ধারণ করা হয়। সব বালুমহাল প্রতিবছর ইজারা নাও হতে পারে। যেমন ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে বালুমহালের সংখ্যা ছিল ৫৫০টি। এর মধ্যে ইজারা হয়েছিল ৩০৮টি। তার আগের অর্থবছরে ছিল ৭০৬টি বালুমহাল, ইজারা দেওয়া হয়েছিল ৩৮১টি। তারও আগের বছর, মানে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বালুমহাল ছিল ৭৬৫টি। ইজারা দেওয়া হয়েছিল ৪৩৪টি।

প্রশ্ন: সব জেলাতেই কি বালুমহাল আছে?
শেখ রোকন: না, সব জেলায় নেই। আমার জানামতে ১৫টি জেলায় বালুমহাল নেই। এর মধ্যে আমার জেলা কুড়িগাম একটি। কিন্তু তাতে কিছু যায়-আসে না। আপনি বাংলাদেশে এমন কোনো জেলা পাবেন না, যেখানে নদী থেকে বালু তোলা হচ্ছে না। সেদিক থেকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে জেলা প্রশাসন চিহ্নিত বালুমহাল নিছক সংখ্যামাত্র। বাস্তবে ওই তালিকা, এলাকা, শর্ত কিছুই গুরুত্ব বহন করে না।

প্রশ্ন: বিষয়টি আরেকটু ব্যাখ্যা করবেন?
শেখ রোকন: আমি বলতে চাইছি, যেসব এলাকাকে বালুমহাল ঘোষণা করা হয়েছে, তার বাইরেও বালু উত্তোলন হয়ে থাকে। যেমন কুড়িগ্রাম জেলায় সরকারিভাবে কোনো বালুমহাল নেই। কিন্তু সেখানে গিয়েও আপনি দেখবেন বিভিন্ন নদী থেকে দেদারছে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।

প্রশ্ন: কারা তুলছে?
শেখ রোকন: নিশ্চিতভাবেই রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালীরা। যে কারণে প্রকাশ্যই বালু তোলা হলেও প্রশাসন বাধা দিতে পারে না। অনেকসময় প্রশাসনের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও যোগসাজস থাকে। নদীর বালু যেন অভিভাবকহীন সম্পত্তি। দেখার কেউ নেই।

প্রশ্ন: বালুমহালগুলোতেও নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে বালু তোলা হয়?
শেখ রোকন: না, না, সেখানেও দেখবেন যে, ইজারা নেওয়া হয়েছে যতটুকুর জন্য, সেই সীমানা মানা হচ্ছে না। আরও কথা হচ্ছে, ইজারাও নিয়ম মেনে দেওয়া হয় না। পেশাগত দক্ষতা ও উৎকর্ষ না দেখেই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা বালুমহাল ইজারা পায়। অনেকে ক্ষেত্রে তারা ইজারা নিয়ে থার্ড পার্টিকে সাবকন্ট্রাক্ট দেয়। বালুমহাল আইনে ও বিধিমালায় বালু তোলার নানা নিয়ম স্পষ্ট অক্ষরে লেখা আছে। যেমন বালু তোলার সময় নদীর ঢাল বা তলদেশ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা বিবেচনা করে সুষমভাবে বালু তুলতে হবে।

মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র ও আবাস যাতে নষ্ট না হয়, জীববৈচিত্র্য যাতে হুমকিতে না পড়ে, তা বিবেচনা করতে হবে। সেতু, বাঁধ, সড়কসহ অন্যান্য স্থাপনার জন্য কোনো ঝুঁকি তৈরি করা যাবে না। অন্তত এক কিলোমিটার দূর থেকে বালু তুলতে হবে। কিন্তু আপনি দেখবেন, যেখানে যেখানে ড্রেজার বসিয়ে যেভাবে খুশি বালু তোলা হচ্ছে। সেতুর পিলারের কাছ থেকে বালু তোলা হচ্ছে, এমন ছবি প্রায়শই পত্রিকায় ছাপা হয়। এমনভাবে বালু তোলা যাবে না যাতে, ওই এলাকায় ভাঙন দেখা দেয়। কিন্তু বালু উত্তোলনের কারণে ফসলী জমি বা গ্রাম ভাঙনের মুখে পড়েছে, এমন খবরও বিরল নয়।

প্রশ্ন: তাহলে কৃর্তপক্ষ কী করে?
শেখ রোকন: দেখুন, কর্তৃপক্ষ ইজারা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে। অথচ আইন বলছে, বালু তুলতে গেলে বিআইডব্লিউটিএ হাইড্রোগাফিক জরিপ করে ছাড়পত্র দেবে, তারপর বালু তুলতে পারবে ইজারাদার। বালু তোলার আগে, সময় ও পরে নদীর পরিস্থিতি দেখার জন্য জেলা প্রশাসনের তরফে পরিদর্শন ও জরিপ করার কথা। বালু উত্তোলনের কারণে পরিবেশ বা প্রতিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হলে জেলা প্রশাসক বিভাগীয় কমিশনারের কাছে প্রস্তাব পাঠাবেন যে, ওই বালুমহাল বিলুপ্ত করা হোক। কিন্তু এসব নিয়ম কোথায় মানা হয় বলে আমার অন্তত জানা নেই।

প্রশ্ন: আর বালুমহালের বাইরে বালু উত্তোলনের ক্ষেত্রে?
শেখ রোকন: বালুমহাল আইনের ১১ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে- বালুমহাল ঘোষিত ও ইজারা দেওয়া এলাকার বাইরে কোনোপ্রকার বালু উত্তোলন, পরিবহন, বিপণন করা যাবে না। অন্য কোনোভাবে রাজস্ব আদায়ও করা যাবে না। কিন্তু এসব সবক্ষেত্রেই হচ্ছে।

প্রশ্ন: নিয়মভঙ্গের শাস্তি কী?
শেখ রোকন: শাস্তি, জরিমানা, কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা সর্বোচ্চ দু্ই বছর কারাদণ্ড হতে পারে। কিন্তু তাতে লাভ কী? আইনের তো প্রয়োগ হচ্ছে না।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে কয়টি নদীতে এখন ইজারা বা ইজারা ছাড়া বালু তোলা হচ্ছে?
শেখ রোকন: এর সঠিক হিসাব নেই। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমরা রিভারাইন পিপল থেকে একটি জরিপ করে দেখেছি ৮০টির বেশি নদ-নদী থেকে বালু তোলা হয়। কিন্তু আপনার মনে রাখতে হবে, সব খবর সংবাদমাধ্যমে আসে না। এর বাইরেও নিশ্চয়ই আরও নদীতে বালু তোলা হয় এবং এর ফলে নদীর পরিবেশ, প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। বিভিন্ন নদীতে আগের তুলনায় ভাঙন বাড়ছে।

প্রশ্ন: কিন্তু বালু উত্তোলন তো এক ধরনের খনন। এতে করে নদীর ভালো হওয়ার কথা নয়? এর মধ্য দিয়ে নদীর ড্রেজিং হতে পারে না?
শেখ রোকন: এই ধারণা আমাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ড্রেজিং আর বালু উত্তোলন এক নয়। যদি নিয়ম মেনেও বালু উত্তোলন করা হয়, তাতে করে নদীর ক্ষতি বৈ কল্যাণ হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমি যতদূর বুঝি। ভাঙন বৃদ্ধির কথা তো আগেই বলেছি। বালু উত্তোলনের ফলে মৎস্যসম্পদও কমে যাচ্ছে। কারণ মাসের আবাস ও প্রজননস্থল ধ্বংস হচ্ছে। বালু উত্তোলনে নদীর কাঠামোও নষ্ট হয়। যেখানে বালু তোলা হচ্ছে, তার ভাটিতে চর পড়তে পারে। আর আমাদের মতো বদ্বীপ অঞ্চলে নদীর নাব্য ফেরানোর জন্য ড্রেজিং কতখানি কার্যকর, সেই প্রশ্নও রয়েছে। গড়াই নদীতে আমরা দেখছি, যতবারই ড্রেজিং করা হয়েছে, পরের বর্ষায় আবার তা ভরাট হয়ে গেছে।

প্রশ্ন: বালু উত্তোলন করে সরকারের তো রাজস্ব আয় হয়।
শেখ রোকন: রাজস্ব মানে কত? যেমন ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই খাত থেকে আয় হয়েছে সারাদেশে কমবেশি ৬৩ কোটি টাকা। লাখো কোটি টাকার জাতীয় বাজেটের ক্ষেত্রে এটা কোনো টাকা? কিছুই না। কিন্তু এর ফলে যে ক্ষতি হচ্ছে, তার মূল্য অনেক। শুধু যদি মৎস্যসম্পদের কথাই ধরি, সেটা রক্ষা করলে এর কয়েক গুণ বেশি রাজস্ব আসবে সরকারের ঘরে। এছাড়া ভাঙনের কারণে জনপদ রক্ষায় যে বাজেট বরাদ্দ হয়, তাও অনেক বেশি। একদিকে সামান্য টাকার জন্য বালু উত্তোলন করতে দিয়ে আরেকদিকে ভাঙন রক্ষার জন্য বাজেট বরাদ্দ দূরদর্শীতা হতে পারে না।

প্রশ্ন: নির্মাণ কাজের প্রয়োজনীয়তাও দেখতে হবে না?
শেখ রোকন: সেজন্য যত্রতত্র বালুমহাল ঘোষণা না করে এবং বালু মহালের বাইরে এক ইঞ্চি জায়গাতেও বালু উত্তোলন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যেখানে ইজারা নিয়ে বালু উত্তোলন হবে, সেখানেও যাতে এই কাজে বৈজ্ঞানিকজ্ঞানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান ইজারা পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। নদীর কাঠামো বা ঢাল নষ্ট না করে, পরিবেশ-প্রতিবেশ বিনষ্ট না করে সীমিত এলাকায় বালু তোলা যেতে পারে।

প্রশ্ন: আমরা একসময় বালু রফতানির উদ্যোগের কথা শুনেছিলাম। তার কী অবস্থা?
শেখ রোকন: ওই উদ্যোগ ছিল আত্মঘাতী। কারণ বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে ও টিকে আছে নদীর পলল বা বালু দিয়ে ভূমিগঠন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এটাই হলো ব-দ্বীপের ধর্ম। পলল উজান থেকে সাগরে যাবে এবং যেতে যেতে দুই পাশের প্লাবন ভূমিতে ছড়িয়ে যেতে থাকবে। এতে করে একদিকে নতুন ভূমি সম্প্রসারিত হবে, অন্যদিকে ব-দ্বীপের ভূমি ক্ষয়ের সঙ্গে ভারসাম্য তৈরি করবে। আমাদের ভূমির উর্বরতা শক্তি বজায় থাকবে। বালু রফতানি মানে, আপনি পুরো প্রক্রিয়ায় একটি গুরুতর ভারসাম্যহীনতার তৈরি করছেন। স্বস্তির কথা, ভূমি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এমন উদ্যোগ নিলেও তা পরিবেশ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সমর্থন পায়নি। আমি যতদূর জানি। বালু রফতানির কোনো ধরনের উদ্যোগ হবে বিপর্যয়কর। এখন তাও নদী থেকে বালু উত্তোলন করে বাংলাদেশেই থাকছে; রফতানি করা হলে তা আর ফিরবে না।

প্রশ্ন: বালু উত্তোলন বা এর প্রভাব নিয়ে গবেষণা কেমন হয়েছে?
শেখ রোকন: খুব বেশি নয়। আপনি এ বিষয়ে বিচ্ছিন্ন লেখালেখি পাবেন। সামগ্রিক চিত্রও পাবেন না। যেসব এলাকায় বালু উত্তোলন করা হয়, সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী বিক্ষোভ করে, আবেদন-নিবেদন করে, তা সংবাদমাধ্যমে সামান্য ঢেউ তোলো। এর বেশি কিছু হয় না। আমাদের উচিত এ ব্যাপারে আরো জোর দেওয়া।

প্রশ্ন: আপনার কাছে শুনে মনে হচ্ছে, বালু উত্তোলন এক বড় সংকট। কিন্তু দখল-দূষণ বা প্রবাহস্বল্পতা নিয়ে যত কথা হয়, বালু উত্তোলন নিয়ে ততটা নয় কেন?
শেখ রোকন: এর কারণ এই সংকটের পূর্ণরূপ এখনো স্পষ্ট হয়নি। স্থানীয়ভাবে জনসাধারণ বুঝছে এবং বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবাদ করছে। চাষের মাছের কারণে আমরা হয়তো বুঝতে পারছি না, বালু উত্তোলনের কারণে নদীর মাছের উৎপাদন কতটা কমেছে। আমার বিবেচনায় বালু উত্তোলনই নদ-নদীর জন্য বৃহত্তম বিপদ। কিন্তু নদ-নদীর চার-পাঁচটি সংকটের মধ্যে সম্ভবত বালু উত্তোলন নিয়েই সবচেয়ে কম কথা হয়।

প্রশ্ন: নীতিনির্ধারণী মহল কি এই চিত্র জানে না?
শেখ রোকন: আমার মনে হয় না। জানলে মাত্র একশ কোটিরও কম টাকার ইজারার জন্য সারাদেশের নদ-নদীর এতটা ক্ষতি করতে দিত না। জাতীয় বালুমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটি নামে একটি জাতীয় কমিটির কথা বালুমহাল আইনে বলা রয়েছে। কিন্তু ওই কমিটি আদৌ গঠিত হয়েছে কি-না এবং গঠন হলেও কখনো আলোচনা পর্যালোচনায় বসেছে কি-না আমার জানা নেই।

প্রশ্ন: ধন্যবাদ, সময় দেওয়ার জন্য।
শেখ রোকন: আপনাদেরও ধন্যবাদ, নদীময় শুভেচ্ছা।

এইচআর/জেআইএম