মেয়রদের কাছে কী চাই?
আসলেই কী চাই আমরা? চাইলে কী চাই? সে তালিকা কি খুব বড়? ঢাকা শহরের একজন বাসিন্দা হিসেবে আমার চাওয়ার তালিকায় প্রথমেই রাখতে চাই যিনি মেয়র হবেন তিনি আগেই জানার চেষ্টা করবেন আমরা কী চাই আর সেই তালিকার কী কী তাদের আওতায় আর কোনটা কোনটা বাইরের বিষয়। না, এমন কোন পরিসংখ্যান আজও আমরা কাউকে প্রকাশ করতে দেখিনি। প্রার্থীরা হয়তো সমাজের নানা গ্রুপের সাথে মত বিনিময় করছেন কিন্তু সাধারণ এলাকাভিত্তিক কোন মতবিনিময় সভা করে কে কী চায় সেগুলোকে তালিকাভুক্তির মত কোন খবর চোখে আসেনি আজও।
আমরাও জানি মেয়রদের ক্ষমতার মধ্যে সমাধান আছে এমন বিষয়ের সংখ্যা খুবই কম। যতটা জেনেছি বড় বড় ইস্যুগুলোর সমাধানে সিটি কর্পোরেশনকে নির্ভর করতে হয় একাধিক সংস্থার উপর। তাই এককভাবে যেগুলো সমাধানের ক্ষমতা রাখেন আমরা নাগরিকেরা কেবল সেগুলোরই সমাধান চাইছি। যদি সে তালিকায় একটি ইস্যু থাকে তবে সেই একটিকেই আগে তালিকাভুক্ত করে ১০০ ভাগ সমাধানের প্রতিশ্রুতি চাই আমরা। প্রার্থীদের ইশতেহার আসছে। একেকজন স্বপ্নের ঢাকা উপহার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন। আমরা এর আগের মেয়রদের কাছেও একই ধারার ইশতেহার পেয়েছিলাম। নতুনত্ব কিছু আসছে বলে মনে হচ্ছে না।
বিএনপি প্রার্থী ইশরাকের ইশতেহারে একটি বিষয় আমার নজর কেড়েছে। তিনি বলেছেন নারীবান্ধব শহর গড়তে উদ্যোগ নিবেন তিনি। এই ঢাকা শহরে নারীর নিরাপত্তা আজকে সংকটের মুখে। দিনে দুপুরে নারী নির্যাতন থেকে শুরু করে বাসে, রাস্তায় নারীকে যেমন যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে তেমনি ধর্ষণের মত জঘন্য অপরাধও দেখতে পাচ্ছি আমরা। এইতো সেইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। অর্থাৎ, এই শহরে নারীরা এখনও নিরাপদে পথ চলতে পারে না। পদে পদে ভয় তাদেরকে ঘিরে ধরছে। যদি নির্বাচিত মেয়র যিনি হন না কেন তিনি নারীর নিরাপদ পথ চলাকে নিশ্চিত করতে পারেন তবে আমি ধরেই নিব তারা আর বাকি সমস্যাগুলোও সহজে সমাধান করতে পারবেন।
আশা করেছিলাম আমাদের সকল প্রার্থীর ইশতেহারে নারীর নিরাপদ শহর গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি স্থান পাবে কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য হচ্ছে আমার চোখে পড়লো না তেমন কোন প্রতিশ্রুতি। অনেকেই হয়তো বলতে পারেন, নগরের সকল নাগরিকের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হলেইতো নারীর নিরাপত্তা বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে যায়। আলাদা করে আবার নারীকে কেন নিরাপদ করতে হবে? বিষয়টা এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ যে এখনও এই সমাজে নারীরা যতটা নিগ্রহের শিকার হয়ে থাকে আর কোন নাগরিক সেগুলো মোকাবিলা করেন না। নারীর ধর্ষণের সাথে আর কোন কিছুকেই তুলনা করা যায় না। এই অপরাধ আমার কাছে অমার্জনীয় একটি অপরাধ। ধর্ষণকে এখনও অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয় না আমাদের সমাজ বাস্তবতায়। একজন নগর পিতার প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত তার নাগরিকদের জন্য একটি নিরাপদ শহর গড়ে তোলা।
প্রতিশ্রুতির ভীড়ে যেন নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি হারিয়েই যাচ্ছে। একজন নারীও যদি নিরাপদে রাস্তা পার হতে না পারে তাহলে সেই শহর আমার কাছে সবচেয়ে অসুন্দর শহর বলে বিবেচিত। সেই শহর যদি সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ার মত সাজানো শহরও হয় তাও আমার দৃষ্টিতে সেই সুন্দরের কোন মূল্য থাকে না। আমরা চাই আমাদের মেয়র হবেন নারী নির্যাতনসহ যেকোন অপরাধের ক্ষেত্রে “জিরো” টলারেন্স শহরের মাথা হিসেবে আনাচে কানাচে যেখানেই যে অপরাধ ঘটবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো প্রথম কণ্ঠটি হবে আমাদের মেয়রের। উন্নয়ন চলবে প্রাকৃতিক নিয়মেই কিন্তু সেই উন্নয়নের গুণগত মান নিশ্চিত না করতে পারলে দিনশেষে সুনামের চেয়ে দুর্নামের পাল্লাই ভারি হয়ে যাবে।
মশা সামলাতে হিমশিম খাওয়া মেয়র আমাদের কাছে হিরো হতে পারে না। পরিকল্পনা হবে বাস্তবভিত্তিক। শহরের কাঠামো ও বাস্তব অবস্থার সাথে মিল রেখে, প্রশাসনের সক্ষমতা এবং নির্ভরশীলতাকে মাথায় রেখে বিষয়ভিত্তিক একটি কর্মপরিকল্পনা চাই আমরা মেয়রের কাছে। অনেক বিষয়ের ভীড়ে যেন কোন বিষয় হারিয়ে বা মিলিয়ে না যায়। ৫০ টি প্রতিশ্রুতি চাইনা যার ৪৮/৪৯টি থেকে যাবে অপূর্ণ। তার চেয়ে ৫ টি প্রতিশ্রুতি দিন যেগুলো আপনি আগামী পাঁচ বছরে পূর্ণ করতে চান যার ধারাবাহিকতায় হয়তো পরের পাঁচ বছরও আপনার জন্য রাস্তা খুলে যাবে। সেই পাঁচটির একটি হয়তো হতে পারে নগরের বাসিন্দাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির বিশেষ কার্যক্রম। নাগরিক সচেতনতা বা অংশগ্রহণ ব্যতীত কোন কার্যক্রমে সফলতা আসবে না। এটা নিশ্চিত। ডোবা নালা খনন করবেন বা উদ্ধার করবেন কিন্তু সেগুলো রক্ষা করতে হলে দরকার নাগরিকের সচেতন অংশগ্রহণ।
৪০০ বছরের পুরনো শহরকে বাসযোগ্য করতে হলে বিকেন্দ্রীকরণের কোন বিকল্প নেই। এই বিকেন্দ্রীকরণ সরকারের পরিকল্পনাতেও আছে। তাই আমাদের মেয়রদের সকল পরিকল্পনার মাঝেই থাকা দরকার সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনার ছাপ। বিচ্ছিন্নভাবে নয়, সিটি কর্পোরেশন যেমন রাষ্ট্র থেকে আলাদা নয় তেমনি স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমেই সরকার তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে থাকে। আর বিভাগীয় শহরের ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকাটা পালন করে আমাদের সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ। সিটি কর্পোরেশন মেয়র সরকারের একজন উন্নয়ন সহযোগী ব্যতীত আর কিছু নয়। আর সেজন্যই সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনার বাস্তবায়নে সিটি কর্পোরেশনকে একক ক্ষমতাশালী কর্তৃপক্ষ হিসেবে গঠন করার বিকল্প আর কিছু নাই।
লেখক : কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম