ভোটরঙ্গে ঢাকার পরিবেশে নতুন ঘা
ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা না মিললেও নির্বিচারে রাজধানীর পরিবেশ দূষণে নতুন মাত্রা দিতে পেরেছে ঢাকা সিটি নির্বাচন। তবে অবদানটা ঢাকা বা নির্বাচনের নয়। পুরো কৃতিত্ব প্রার্থী, দল, নেতা-কর্মী, নির্বাচন কমিশনসহ অন্য কারো কারো। দেশের ১৭ কোটি আদমসন্তানের মাত্র দেড় কোটি গুনাহগার আপাতত এই উৎপীড়নের সরাসরি শিকার। পাঁচিলে–দেয়ালে পোস্টারসহ নানা সাঁটানিতে নগরজুড়ে উড়ছে নেতা বানানোর নিশান। এই নিশান আসমানে বা মাথার ওপর ঝুলে জানান দিচ্ছে তিলোত্তমা রাজধানী আরও কত রূপসী হচ্ছে। পোস্টারের গায়ে পরিয়ে দেওয়া পলিথিনের জামা দেশের বে-আবরু আদমসন্তানের শুমারির কোনো তাগিদ না দিলেও বার্তা মিলছে অনেক।
এবারের সিটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি নতুন উৎপাতের অভিষেক ঘটেছে। কাগজের পোস্টার ও প্রচারপত্রের বদলে প্লাস্টিকের পোস্টার লাগানো হচ্ছে। দুই সিটি নির্বাচনকে ঘিরে প্রচারপত্র, উন্মুক্ত চিঠি, কাগজ ও প্লাস্টিকের পোস্টার, ব্যানার ইত্যাদিতে ঢাকাকে সয়লাব করে ফেলেছেন প্রার্থীরা। দায়িত্ববোধ-পরিবেশবোধ এখানে অবান্তর। কান ও মস্তিষ্ক নিপীড়নের আজগুবি প্যারোডি গানে শব্দদূষণের শিকার মানুষের গোদের ওপর বিষফোঁড়া। প্লাস্টিক মোড়ানো পোস্টার বোনাস। দূষণ কত ধরনের আর কোন মাত্রায় হতে পারে, তা টের পাইয়ে দেয়া হচ্ছে। এ সর্বনাশা কাণ্ডের হোতারাই নগর উদ্ধারের শ্রেষ্ঠ সন্তান।
এমনিতেই শব্দদূষণের রেকর্ডে আমাদের ধারেকাছে কেউ নেই। তামাম দুনিয়ার সবচেয়ে দূষিত দেশ ও রাজধানীর ফর্দে আমাদের নাম উঠেছে আরো আগেই। বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের শব্দ পরিমাপ করে দেখেছে, ঢাকায় নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে গড়ে প্রায় দেড়গুণ শব্দ হয়। প্রায় এলাকায়ই শব্দ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বেশি। বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, এ অবস্থা চলতে থাকলে দ্রুতই ঢাকার জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ কোনো-না-কোনো ধরনের বধিরতায় আক্রান্ত হবে। বিশ্বব্যাপী বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়ালের বায়ুমান– একিউআই সূচকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহরের প্রথম তিনটির একটি হচ্ছে ঢাকা। ২০ থেকে ২৫ নভেম্বর ২০১৯ এর কোন কোন দিনে ‘গ্যাস চেম্বার’ আখ্যা পাওয়া দিল্লির বাতাসের চেয়েও বেশি দূষিত হয়ে পড়েছিল ঢাকার বাতাস। ২০১৯-২০ এর শীতকালীন বায়ুদূষণে ঢাকা নিকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থা ইপিএর ২০১৮ প্রতিবেদনে ১৮০টি দেশের সামগ্রিক পরিবেশ সুরক্ষা সূচকে বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭৯তম স্থানে নেমেছে। ২০০৬ সালে সর্বপ্রথম সূচকটি তৈরির সময় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৫তম। অর্থাৎ মাত্র এক যুগেই দূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নেমেছে ৫৪ ধাপ নিচে। বর্ষা মৌসুমে সামান্য বৃষ্টিতেই আরেক দুর্ভোগের নগরীতে রূপ নেয় ঢাকা। ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে বিগত এক দশকে বিভিন্ন সংস্থা মিলে শত শত কোটি টাকা খরচ করে চলছে।
গণমাধ্যমে ‘উৎসবমুখর’ নামে সম্বোধন করা এই তৎপরতায় কোন কাণ্ডজ্ঞানহীনতা না হচ্ছে? মাইকের উচ্চশব্দে চারদিক প্রকম্পিত! কানের পর্দা ফাটানো শব্দ ঢাকার অলিগলিসহ সব প্রান্তে। বিধি-বিধানের তোয়াক্কা নেই। দিন-রাত সমানে মিছিলের উচ্চ শব্দ, মোটরসাইকেলের হর্ন, গান-স্লোগানের অশালীন প্রতিযোগিতা। প্রচার-প্রচারণার সময় কর্মীরা রাস্তাঘাটে আবর্জনা ফেলছেন ডেমকেয়ারে। দেয়ালজুড়ে লাখে লাখে পোস্টার, রাস্তাজুড়ে হাজারে হাজারে ব্যানারকেন্দ্রিক শোডাউন নগরীর শ্রীহানি করলেও নিশ্চুপ সবাই।
এই অসভ্যতা-অত্যাচারকে নিয়তিই ভাবছে সুস্থ-বিবেকবানরা। শত শত টন কাগজ ঢাকায় হাওয়া খাচ্ছে? তার গায়ের জামার ওজনও নিছক কম নয়। পরিবেশ নিয়ে কাজ করা মহল হয়তো হিসাব করে বলতে পারবেন, এই কাগজ তৈরিতে কত শত টন গাছ বলি হয়েছে। এই টন টন পলিথিনের দূষণ থেকে মুক্ত করতে উঠতি ধনী বাংলাদেশের কী বিপুল পরিমাণ কড়ি গুনতে হবে। স্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হবে, তার হিসাব করার কেউ আছেন নিশ্চয়। কত কত ওষুধ কোম্পানির পকেটে কত শত কোটি টাকা বেমালুম ঢুকে যাবে, চাইলে তারও একটা জরিপ চালানো যায়।
পরিবেশদূষণের ন্যূনতম উপলব্ধি নির্বাচন কমিশন, রাজনীতিবিদসহ কোনো মহলেই লক্ষণীয় নয়। বৈধ-অবৈধ উপায়ে অর্জিত অঢেল অর্থে চলে নির্বাচনী প্রচারণার ডামাডোল সমাজে ওপেন সিক্রেট। রাজনীতি ও নির্বাচনে লগ্নি করা অর্থ নিয়ে কানাঘুষা হলেও বড় কোনো সমস্যা হয় না। নির্বাচনী এই বিনিয়োগ তুলে আনা তেমন বিষয়ই নয়। প্রার্থীর পোস্টার বানানোর দায়িত্বে সমন্বয়কারী থাকুন বা না-থাকুন, ওয়ার্ডের নেতা-কর্মীরা ভবিষ্যৎ আয়ের পথ উন্মুক্ত রাখতে নিজেরাও প্রচারপত্র, খোলা চিঠি, কাগজ ও প্লাস্টিকের পোস্টার, ব্যানার ইত্যাদি তৈরিতে বিনিয়োগ করেন।
এই অর্থের উৎস বৈধ না অবৈধ, চাঁদাবাজি না নিজের গাইটের তা ধর্তব্য নয়। এ নিয়ে প্রশ্ন করে মার খাওয়া নিশ্চিত। নির্বাচনী প্রচারণা পরিবেশবান্ধব করার দায়িত্ব তো প্রার্থী ও নির্বাচন কমিশন উভয়ের। কিন্তু এ অসভ্যতার লাগাম টানার কোনো কর্তৃপক্ষের দেখা নেই। তাতে কি? নানা বাহারি প্রতিশ্রুতিতে চিড়া ভিজিয়ে ফেলছেন কয়েক প্রার্থী। এবার আর ঢাকা থাকবে না, সত্যি সত্যিই সিঙ্গাপুর বা ব্যাংকক হয়ে যাবে। শব্দদূষণ ও প্লাস্টিক বর্জ্যে নগরীর পরিবেশের এমন সর্বনাশ করা প্রার্থীরাই হবে নগরবাবা-মা হয়ে পরিচ্ছন্ন নগরী উপহার দেবেন! দূষিত এই সংস্কৃতিতে কেউ কারো চেয়ে তত পিছিয়ে নন। নিরাপদ ঢাকা, স্বাস্থ্যকর ঢাকা, সচল ঢাকা, স্মার্ট ঢাকা, ডিজিটাল ঢাকা গড়বেন তারা? ঢাকার যানজট নিরসন, পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান, হাউজিং সমস্যার সমাধান, ঐতিহ্যরক্ষা, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি বন্ধ করবেন তারা?
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/জেআইএম