ডিজিটাল যুগের নির্বাচনী প্রচারণায় অ্যানালগ পদ্ধতি কেন?
সিভিক সেন্স বা নাগরিক বোধ বা অনুভূতি বলতে আমরা যা বুঝি, তার বিন্দুমাত্র কি আমাদের মধ্যে দেখতে পাই? সারাক্ষণই তো প্রশ্ন করি অমুকে এখানে ময়লা ফেলছে কেন, তমুকে কেন ওখানে পানের পিক ফেলছে, নগরের ভেতরে পাবলিক টয়লেট থাকলেও তা লোকজন কেন ব্যবহার না করে যেখানে সেখানে প্রস্রাব-পায়খানা করছে, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজের সামনে গাড়ির হর্ন কেন বিকট শব্দে বাজানো হচ্ছে- ইত্যাদি হাজারটা প্রশ্ন আমরা একে অপরকে দায়ী করতে পারবো। কিন্তু কখনো কি নিজের ভুলটা লক্ষ্য করেছি। বেখেয়ালী হয়ে নিজেই হয়তো যত্রতত্র থুতু ফেলছি, গৃহস্থালীর ময়লা-আবর্জনা ফেলছি। তাই আসুন না একটু পরখ করি নিজেদের। একটু সযতনে নাগরিক অনুভূতিকে জাগ্রত করি। কারণ নগরটা তো আমাদেরই।
সাম্প্রতিক বিষয়েই নজর দেই। আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি শুরু হতে যাচ্ছে দেশের পাবলিক পরীক্ষার অন্যতম একটি পরীক্ষা- এসএসসি। যাতে সারাদেশের লাখো লাখো শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। তাদের পড়ালেখা যাতে নির্বিঘ্ন হয়, সেটা দেখার দায়িত্ব তো আমাদের সবারই। কিন্তু এবার কি তা হচ্ছে? বলতে পারেন, এত পরিবার দেখবে। তা তো দেখবেই। কিন্তু আপনি আমি কি তাকে পড়ায় মনোনিবেশের মতো শান্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারছি?
এমনিতেই ঘনবসতিপূর্ণ শহর হওয়ায় চারপাশে যাপিত জীবনের নানা খুটখাট, টুংটাং শব্দ হচ্ছেই। তার উপর নির্বাচনী মাস হওয়ায় দিন-রাত চারপাশে বিকট শব্দে নানা সুরে, কথামালায় গান বাজছে। হচ্ছে স্লোগান, চলছে মাইকিং। নির্বাচনী উত্তাপে উত্তেজিত চারপাশ। যারা এই কাজগুলো করছেন, তারা কি একটিবারও ভাবছেন এই ঢাকা দুই সিটির লাখ লাখ এসএসসি পরীক্ষার্থীর কথা? হয়তো বলবেন, এটা তো সারা বছর হয় না, এবার নির্বাচনের মৌসুমে পড়ে গেল আরকি। আরে ভাই, দু'টো বিষয়ই জরুরি। তাই বলে প্রাধান্য কোনটি, সে বিবেচনায় কি এবার নির্বাচনী প্রচারণায় একটু ভিন্নতা আনা যেতো না?
আর আমরা যেখানে ডিজিটাল বাংলাদেশের সাথে এগিয়ে যাচ্ছি, সেখানে ডিজিটাল প্রচারণা হলে সমস্যাটা কোথায়? দিন দুয়েক আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে আসার পথে দেখলাম এবং শুনলাম-নির্বাচনী প্রচারণা। পোস্টারে চেয়ে গেছে সেখানকার চারপাশও।
অবাক হলাম, হাসপাতালে যেখানে জীবন-মরণ সমস্যা নিয়ে নানা ধরনের রোগী থাকেন, সেখানেও উচ্চস্বরে নির্বাচনী মাইকিং কি জরুরি? যদিও নির্বাচন কমিশন মাইকিং, উচ্চ শব্দে প্রচারাভিযানের কিছু সময়-সূচি বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, কেউ শোনারও নেই, নেই দেখার বা বলারও। উচ্চ শব্দের বাড়াবাড়ি অবশ্য থেমে যাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। কিন্তু নগরীতে রেখে যাওয়া মারাত্মক শব্দ দূষণের ক্ষতচিহ্ন কি মুছবে সহজে?
দেশ ডিজিটাল হলেও নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার হচ্ছে সেই পুরোনো পদ্ধতি। কাগজের পোস্টারে সয়লাব গোটা শহর। তা-ও আবার পলিথিনে মোড়া। যা আসন্ন বর্ষা মৌসুমে নগরীর জলাবদ্ধতা ও পরিবেশ দূষণের মারাত্মক কারণ হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে। ঢাকার অলিগলি থেকে প্রধান সড়ক নির্বাচনী পোস্টারে সয়লাব। সিটি করপোরেশন ঘিরে কত লাখ কিংবা কত কোটি পোস্টার ঝুলছে, তার হিসাব করা কঠিন। তবে সহজেই অনুমেয় যে, অগোছাল এই শহটারটাকে শব্দ আর পরিবেশ দূষণে আরও কতটা বিপর্যস্ত করে রেখে যাচ্ছে মাত্র দিন কুড়ির নির্বাচনী পুরোনো এই প্রচার পদ্ধতি।
এখন সময় এসেছে এই ব্যবস্থাকে বদলে ফেলার। সময় এসেছে, শব্দ আর পরিবেশ দূষণের মতো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এড়িয়ে নির্বাচনী প্রচার ব্যবস্থাকে কীভাবে ডিজিটাল করা যায় সে বিষয়ে ভাবারও। কারণ নগরটা আমাদের। তাই একে বাসযোগ্য রাখতে ছোট্ট ছোট্ট খুঁতগুলোও দূরে ঠেলতে নাগরিক অনুভূতি জাগাতে হবে নিখুঁতভাবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, বাংলাভিশন।
এইচআর/এমএস