ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

দূরপাল্লার যাত্রীবাহী পরিবহনও হতে পারে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি

সম্পাদকীয় ডেস্ক | প্রকাশিত: ১০:৩২ এএম, ২৩ জানুয়ারি ২০২০

কামরুল হাসান হীরা
বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় মানব সভ্যতার সার্বিক পরিবর্তন হলেও, মানুষ দিন দিন তার সামাজিক সম্পর্কের জায়গা থেকে পিছিয়ে পড়ছে। সমাজে নানা প্রকার অসংগতি ও বৈষম্য বিরাজ করায় মানুষের নৈতিক গুণাবলী সংক্রমিত হয়ে সমাজ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার কাঠামোগত উন্নয়ন করা প্রয়োজন । সমাজকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে হলে সংস্কৃতিমনা, সুশিক্ষিত, জ্ঞানী, বিচক্ষণ এবং যোগ্য ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের প্রয়োজন হয়।

একজন সচেতন মানুষ একটি পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থাকে নানান ভাবে প্রভাবিত করতে পারেন। সুশিক্ষা,সাহিত্যচর্চা এবং সংস্কৃতির সংস্পর্শে বিকশিত মানুষই পারেন সমাজকে নতুন করে স্বপ্ন দেখাতে। বাস্তব জীবনে যেকোনো বিষয়ে গভীর চিন্তা ও সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডের জন্য বই একমাত্র বিকল্প ব্যবস্থা। এই ক্ষেত্রে যেকোনো ভালো বই সমাজ পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে । কেননা একটি বই একজন পাঠকের সাথে সাথে পুরো সমাজকে নতুন করে ভাবতে শেখায়।

একটি বই একযুগের মানুষের সাথে আরেক যুগের মানুষের সম্পর্ক তৈরি করে দেয় । একটি বই অতীতের সাথে বর্তমানের মেলবন্ধন করে দেয় । একটি বই মানব জীবনের মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করতে গুরুত্ব বহন করে। বিখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় বলা যায়, বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না। এছাড়াও, জগৎ বিখ্যাত গবেষক ও মনীষীরা মনে করেন, জীবনে তিনটি জিনিসের গুরুত্ব অপরিসীম তা-হলো বই, বই এবং বই। কিন্তু, মানুষের মধ্যে বই পড়া বা লেখালেখির প্রবণতা দিন দিন কমে যাচ্ছে । বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা একটি নীরব যুদ্ধ।

এক্ষেত্রে সাহিত্যচর্চাই হতে পারে দেশের সংস্কৃতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রধান উপায়। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় এই যে, বইমেলার পাঠকদের মত মানুষের হাতে আর বই দেখা যায় না । এমনকি, নতুন নতুন বই নিয়েও কোন গল্প হয় না । অতিমাত্রার সোশ্যাল মিডিয়া ভিত্তিক অপসংস্কৃতি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। বর্তমান যুগে মানুষ হয়ে যাচ্ছে এক একটা যান্ত্রিক রোবট । বস্তুত, সামাজিক মূল্যবোধের জায়গা থেকে আমরা দিন দিন পিছিয়ে পড়ছি। আমাদের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হল সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় অনীহা।

এই সমস্যা থেকে বাঁচতে হলে আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে হবে। সাহিত্যচর্চা ও পাঠক সমাজের পরিধি বাড়ানোর জন্য নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা অতীব জরুরি। এই ক্ষেত্রে নতুন প্রকল্প হিসেবে দূরপাল্লার পরিবহন গুলোকে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া, নতুন নতুন রাস্তা, বহুমুখী লেন, ব্রিজ, সেতু, ওভারব্রিজ, ফ্লাইওভার, মেট্রো রেল, এক্সপ্রেসওয়ে, দ্রুত গতির রেল, আধুনিক নৌযান ও বিমান ইত্যাদি দেশের বর্তমান যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তাছাড়া যান্ত্রিক ত্রুটি, নিরাপত্তা ও অজানা কারণে যাত্রীদেরকে নানাপ্রকার ভোগান্তিতে পরতে হয় । এ সকল কারণে সাধারণ যাত্রীরা নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছুতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে থাকেন।

এইক্ষেত্রে, আশেপাশে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি বা বই পড়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারলে যাত্রীদের দীর্ঘ ভোগান্তি কিছুটা হলেও লাঘব করা সম্ভব হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, দেশের বর্তমান পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় দূরপাল্লার বাস, লঞ্চ, রেল, কিংবা বিমানের অবদান অনস্বীকার্য। দূরপাল্লার এই পরিবহনগুলো প্রতিদিন যাত্রীদেরকে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে দেয়। তাই দূরপাল্লার প্রতিটি পরিবহনে ১০ টি করে ভাল বই বহন করার সকল ব্যবস্থা করে দিতে পারলে সাহিত্য চর্চায় নতুন মাত্রা যোগ হবে। যার বিনিময়ে ১০টি বই নতুন ১০জন পাঠকের মনে স্থান করে নিতে পারবে। এই প্রকল্প দেশের সাহিত্যচর্চায় পাঠকের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

হয়তো যাত্রীরা স্বপ্ন দেখেন, কোন একদিন তাদের বহনকৃত পরিবহনে নতুন নতুন কবিতা-সাহিত্য-গল্প-উপন্যাস ইত্যাদিতে সমারোহ থাকবে। যারফলে, পাঠক-শ্রেণীর যাত্রীরা জ্ঞান অন্বেষণে সাহিত্য চর্চায় বুঁদ হয়ে থাকবেন। হয়তোবা, পাঠক শ্রেণীর যাত্রী-সাধারণ গন্তব্যস্থলে পৌঁছে নিঃশ্বাস ছেড়ে বা তৃপ্তির ঢেকুর দিয়ে বলবে আজ অনেক কিছু জানলাম । জ্ঞানচর্চা বিফলে যায় না, তাই জ্ঞান চর্চার জন্য চাই সুচিন্তা এবং তার সঠিক বাস্তবায়ন। হয়তো অবসর পেলে সাধারণ যাত্রীদের পাশাপাশি পরিবহন চালকরাও একদিন বই পড়ার চর্চা শুরু করবেন ।

কিছু পরামর্শ:

প্রতিনিয়ত, মানুষ যাতায়াতে অনেক সময় ব্যয় করেন। কখনো কখনো এই সময় অনেক দীর্ঘায়িত হয় । দীর্ঘ সময়ে কিছু বই হাতের নাগালে থাকলে অনেক কাজে লাগে। যে কোন দূরপাল্লার যাত্রীবাহী পরিবহনের নির্দিষ্ট ব্যক্তির দায়িত্বে দশটি বই দেওয়া এবং যথার্থ তদারকির ব্যবস্থা করা সময়ের দাবি ।

বাস টার্মিনাল, লঞ্চ টার্মিনাল, রেলওয়ে স্টেশন কিংবা বিমানবন্দরের নির্দিষ্ট স্থানে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি তৈরি এবং সঠিক প্রচারণার ব্যবস্থা থাকলে পাঠক-শ্রেণীর সাধারণ যাত্রীরা উপকৃত হবেন ।

সারা বাংলাদেশে সড়ক, রেল, নৌ এবং আকাশপথে সবমিলিয়ে যদি ১ লক্ষ দূরপাল্লার যানবাহন থাকে। এমনকি, প্রত্যেকটি বাহনে ১০ টি করে বইয়ের ব্যবস্থা থাকে, তাহলে সর্বমোট ১০ লক্ষ পাঠক বই পড়ার সুযোগ পাবেন ।

প্রতিটি টিকেটের গায়ে দশটি বইয়ের নাম লেখা থাকলে যাত্রীরা ঐ বইগুলোর সম্পর্কে ধারণা রাখতে পারবেন ।
এই ক্ষেত্রে যানবাহনের মালিকরা নতুন নতুন বই সংগ্রহ করে তাদের যাত্রীদেরকে আরো উৎসাহিত করতে পারবেন ।
একটি ভালো বই একজন মানুষকে বদলে দিতে পারে। কয়েকজন ভালো মানুষ একটি সমাজকে বদলে দিতে পারে। কয়েকটি সমাজ একটি রাষ্ট্রকে নতুন করে সাজাতে পারে। এটাই নতুন করে ভাবার বিষয় যে, ভালো বইয়ের বদৌলতে পরিবহন মালিকরা পাঠকসমাজে নতুন রূপে আবির্ভূত হবেন। একটি ভালো বই বহন করে সমাজ পরিবর্তনে যেকোনো অবদান রাখতে পারাটাই হবে সরকার এবং পরিবহন মালিকদের নিরব আন্দোলন।

কিছু ভালো কাজ বেঁচে থাকে হাজার বছর। আর সেই ভালো কাজ যদি হয় জ্ঞানচর্চার চাষাবাদ তা তো মানুষের জন্য মঙ্গল বটে। আজ থেকে শুরু হোক সাহিত্য চর্চার নতুন যাত্রা। শুরু হোক জ্ঞানচর্চার এক নতুন পথ চলা। যা জ্ঞান চর্চার পাশাপাশি সমাজ এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যুগোপযোগী পরিবর্তন আনতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এমতাবস্থায়, সরকার এবং পরিবহন মালিকদের সদিচ্ছা ও সহযোগিতা পেলেই সাহিত্যচর্চায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে ।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ।

এইচআর/জেআইএম