ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আন্তঃধর্মীয় আলোচনা : সম্প্রীতির নতুন ঠিকানা

ড. মিল্টন বিশ্বাস | প্রকাশিত: ১০:১৬ এএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯

বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, জঙ্গিবাদের উত্থান, মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং অর্থনৈতিক অসাম্যের মধ্যে আন্তঃধর্মীয় আলোচনাসভা ও সম্মিলিত কর্মপন্থা গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। অশান্ত বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মীয় বিভেদ ভুলে একত্রে কাজ করার সিদ্ধান্তসমূহ আমাদের পথ দেখাতে পারে। ধর্মে ধর্মে বিভেদের পরিবর্তে সম্প্রীতি ও শোষণমুক্ত সুষম সমাজ; অসত্য অমঙ্গল অকল্যাণের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হয়ে দেশের মঙ্গল কামনায় সকলে হতে পারি উজ্জীবিত।

সাম্প্রদায়িক হানাহানি মুক্ত সুন্দর সমাজ সৃজনের পক্ষে আজ আমরা। পৃথিবীর দেশে দেশে যে ধর্মীয় উগ্রবাদিতার জন্ম হয়েছে তা থেকে মুক্তি প্রত্যাশা করি প্রত্যেকে। উগ্রবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সর্বধর্ম সম্প্রদায়ের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে জাগ্রত করতে হলে পারস্পরিক সৌহার্দ্য সৃষ্টির বিকল্প নেই। এশিয়ার মধ্যে ভারত, বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার দুই বৃহৎ ধর্ম-সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমান পরস্পর বিভেদে জড়িয়ে পড়েছে বারংবার। এর পশ্চাতে আছে কতিপয় রাজনৈতিক দলের ইন্ধন। এই সাম্প্রদায়িক বিভেদ সচেতন মানুষকে ব্যথিত করে। প্রত্যেক ধর্মের বোধবুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন মানুষ হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ সম্প্রীতি প্রত্যাশা করেন।

প্রকৃতপক্ষে মানবধর্মের কথার মধ্যেই আছে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির মৌল ভিত্তি। সম্প্রদায়গত সম্প্রীতির কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতিভাবনার নানা দিক আমাদের সামনে উন্মোচন করা দরকার। মানবতা, বহুমাত্রিক ঐতিহ্য-পরম্পরা, বহুত্ববাদী সংস্কৃতি ও সাম্যচিন্তা আমাদের এশিয়ার সমাজব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার জন্য দরকার সামাজিক স্থিতিশীলতা। অসহিষ্ণু পৃথিবীর ধর্মীয় মৌলবাদিতা দূর করার জন্য মানুষে মানুষে মৈত্রীর বন্ধন দৃঢ় করতে হবে। আর এর জন্যই প্রয়োজন বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গের মধ্যে আলোচনা। আলোচনার বিষয় হতে হবে বিশ্বে শান্তি স্থাপনে সচেষ্ট হওয়ার কর্মসূচি। আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা এশিয়ার সমাজ ও সভ্যতার কেন্দ্রীয় ভিত্তি। এই ভূখণ্ডে একত্র হয়েছে বহু ধর্ম, এখানে পাশাপাশি বাস করেন নানা ধর্মাবলম্বী মানুষ। একের মধ্যে বহুর অস্তিত্ব আমাদের সমাজের মতো পৃথিবীর আর কোনো অঞ্চলে নেই। এশিয়ায় হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ সংখ্যাধিক্য। তবে বর্তমান বিশ্বে ধর্মের উদার বাণীসমূহ পৃথিবীর সর্বত্রই বারবার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।

ধর্মে ধর্মে বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক হানাহানির বাস্তবতায় আন্তঃধর্ম আলোচনা সভার মাধ্যমে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বলে আমরা মনে করি। একের ধর্ম বিশ্বাস অন্যের বিশ্বাসের সঙ্গে বিভেদ সৃষ্টি না করে পরস্পরে প্রীতি সঞ্চার করতে পারে। নিজের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনে ব্যস্ত পৃথিবীর মানুষ অন্য ধর্মবিশ্বাসীর ধর্মীয় আচার-আচরণকে সম্মান করে নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্কের বিকাশ ত্বরান্বিত করবে এটাই কাম্য। মানবতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আলাপ-আলোচনাসভার আয়োজন করার বিকল্প নেই। অনগ্রসর কিংবা নিপীড়িত মানুষের পাশে থাকা এবং মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠা আমাদের অন্যতম কাজ হওয়া উচিত।

দেশে দেশে সামাজিক ন্যায্যতা ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠায় মুক্ত আলোচনার আয়োজন করতে হবে। যা কার্যকর হবে ধর্মীয় গোড়ামি ও অন্ধতা দূর করার ক্ষেত্রে। ধর্মের নামে বিশ্বজুড়ে সহিংসতার অবসান-কল্পে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার উপর জোর দিতে হবে। ধর্মীয় জীবনে বিশ্বাসীদের মানবিক বিকাশে সংলাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি। সমাজে ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্য আন্তঃধর্ম আলোচনাসভা জীবনের শক্তিকে মানুষের মঙ্গলে কাজে লাগানোর প্রণোদনা। দায়বদ্ধতা, সাহস ও উদারতা দিয়ে এশিয়ার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে এই ধারার অনুষ্ঠান।

ভারতীয় উপমহাদেশ সহিষ্ণু জাতির বসতির অঞ্চল। বহুবর্ণ, বহুভাষীর বসতি এখানে। সকলে একই মানববৃত্তে বন্দি। এই সমাজের মানবিকতাই সকলকে একত্রিত করেছে। এ সমাজ পরস্পর পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা অনুভব করে। অর্থাৎ এখানে স্বতন্ত্র ও ভিন্নতা সত্ত্বেও মানুষ বহুত্ববাদে বিশ্বাসী; একত্রে থাকতে আগ্রহী। অমানবিক সমাজ ও রাষ্ট্রে মানবতা দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। বিশ্বজাগতিক ভ্রাতৃত্ব আমাদের ঐক্যসূত্রে বেঁধেছে। সামাজিক জীবনে একে অপরের প্রতি প্রীতি-মমতা প্রদর্শন করতে হবে। বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের প্রকাশ করে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ। ধর্মের ভিন্নতা ঈশ্বরেরই দান এবং সেই পরিচয় সকলে মেনে নিয়েই বেঁচে থাকে। ভিন্নতার মাঝে ঐক্যের সুর বাজে প্রাণে।

আন্তঃধর্মীয় সভা সম্পর্কে বিভ্রান্তি ও নানা কুসংস্কার অবসানকল্পে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। মানবসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতার অবসানে ধর্মীয় বিধানের সাংস্কৃতিক জাগরণের কথা বলা আবশ্যক। এশিয়ার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো থেকে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের পার্থক্য আছে। থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন কিংবা ভারতের সংখ্যালঘুদের বাস্তবতা ও সংকট বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া থেকে ভিন্ন। বাংলাদেশে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার জায়গাটি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরতে হবে। উপরন্তু শান্তিপূর্ণ জীবনের জন্য বিভিন্ন ধর্মীয় নেতাদের প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার।

ধর্মীয় কুসংস্কার দূরীকরণ, বিচিত্র বিশ্বাসে একত্রে বসতি, সামাজিক সংহতি ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠার জন্য সংলাপের প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সৃষ্টির জন্য এবং খ্রিস্টান-হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-শিখ সম্প্রদায়ের ঐক্য স্থাপনে বলা যায়- এশিয়ার বিচিত্র ধর্ম ও সামাজিক সাংস্কৃতিক ভিন্নতা সত্ত্বেও একই সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ফিলিপাইন ছাড়া অন্য দেশগুলোতে খ্রিস্টানরা ক্ষুদ্র বা সংখ্যালঘু। এসব অঞ্চলে বর্তমান পরিস্থিতিতে ধর্মীয় স্বাধীনতা হুমকির মুখে। ধর্মীয় মৌলবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বর্ণ এবং সাংস্কৃতিক, জাতিগত বিভেদ ও অসহিষ্ণুতা দিন-দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে কুক্ষিগত করছে অপরাজনীতি অনেকক্ষেত্রে রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এজন্য ধর্মীয় গ্রন্থের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ যথার্থ হতে হবে।

মূলত ধর্মীয় বিভাজন দূর করার জন্য আন্তঃধর্মীয় সংলাপ ও আলোচনা জরুরি। কারণ আমরা ধর্মীয় অনুপ্রেরণা, অংশগ্রহণ এবং সংলাপের মধ্য দিয়ে নিজেদের উন্নততর আদর্শে উন্নীত করতে সক্ষম হবো। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-শিখ-খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বিজ্ঞজনদের আলোচনা ও আলোকপাত থেকে আমরা জানতে পারব অসাম্প্রদায়িকতা ধর্মহীনতা নয়, বরং তা সকল সম্প্রদায়ের ধর্মমতকে শ্রদ্ধা করার এক পরম অভিজ্ঞান। ধর্মীয় ও পারিবারিক ঐতিহ্য সূত্রে নিজের ধর্মের রীতিনীতি ও আদর্শ আত্মস্থ করলেও নিজধর্মের মাঝেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। অর্থাৎ বিশেষ কোনো ধর্ম নয়, বরং সকল ধর্মের প্রতিই আমাদের ভক্তি ও ভালোবাসা থাকবে অফুরান। তাহলেই সম্ভব হবে সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করা।

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় । [email protected]

এইচআর/জেআইএম