সড়কে ওরা কেন আরও বেপরোয়া?
অনেক হয়েছে। ভেবেছিলাম সড়ক এবার হয়তো নিরাপদ হবে। সড়ক নিরাপদ হয়নি। আরও অনিরাপদ হয়েছে। অবৈধ চালকগণ প্রশ্রয় পেয়ে আরও দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে। ওরা প্রতিদিন অকাতরে মানুষ হত্যা করছে। সর্বশেষ শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) ঢাকা চট্রগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুন্ডে ফৌজদারহাট বাইপাস সড়কে একই পরিবারের দুই মেয়েসহ বাবা নিহত হয়েছেন। মা-ছেলে হাসপাতালে মৃত্যুর মুখোমুখি। বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক প্রয়াত সাইফুজ্জামানের পরিবার বান্দরবানে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ঢাকায় ফেরার পথে তাদের প্রাইভেটকারটি দুর্ঘটনায় পড়ে।
এদেশে কত শত সাইফুজ্জামানের মৃত্যু হচ্ছে। প্রতিদিন সড়কে মূল্যবান প্রাণ যাচ্ছে। রাজীবের হাত যাচ্ছে, কারো পা যাচ্ছে, মাথা যাচ্ছে, মিশুক মুনীর, সাইফুর রহমানদের জীবন যাচ্ছে। থামছে না সড়কে মৃত্যু মিছিল। আমরা বিশেষ দু’একজনের জন্য আহ্ উহ্ করি। প্রতিদিন কত খালিদ, কত হৃদয় পঙ্গু হচ্ছে, জীবন দিচ্ছে তার খোঁজ কি রাখি? আমরা কেন মৃত্যুর মিছিল রোধ করছি না? কেবল আলোচিত ঘটনায় মন্ত্রী, এমপিরা ছুটে যান, স্বজন কিংবা লাশের পাশে। আমরা মায়াকান্না করি; লাভ কি তাতে?
এদেশে আইন হয় আইনের প্রয়োগ হয় না কখনো। দুঃখজনক হলেও সত্য এদেশে আইন নিয়ন্ত্রণ করেন সড়ক পরিবহন নেতারা। আরও কষ্টের কথা হলো এদেশের সড়ক পরিবহনের শীর্ষ নেতা সরকার দলের শীর্ষ পদের। সড়ক নিরাপদ করতে নয়া আইন হয়েছে। তা বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার কথা ছিল ১ নভেম্বর ২০১৯ থেকে। শুরুতে তর্জন গর্জন শুনেছি। পরে দেখলাম শ্রমিক নেতাদের দেনদরবারে হঠাৎ থমকে গেছে সরকার ও প্রশাসনের আইন প্রয়োগের কার্যক্রম। সড়ক নিয়ে আন্দোলনে নামা ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ এর প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চন উল্টো শাহজাহান খানের হুমকির মুখে পড়েন। থমকে গেছে সড়ক আন্দোলনও। তাই রাস্তায় আগের চেয়ে বেপরোয়া চালক। যা হবার তাই হচ্ছে সড়কে। মাঝে মাঝে আইন প্রয়োগের কথা উঠলে; বড় কোন দুর্ঘটনায় সরকার মহলের হুঙ্কার শুনলে তৃপ্ত হই এই ভেবে যে এই বুঝি সড়ক নিরাপদ হচ্ছে। নিরাপদ সড়কের জন্য হাজারো হুঙ্কার আন্দোলন, ধর্মঘট, মিছিল, সমাবেশ কতকিছুই না হয়; সড়ক আর নিরাপদ হয় না।
সম্প্রতি উচ্চ আদালত ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়কে না চলতে নির্দেশনা দিয়েছেন। ফিটনেসবিহীন গাড়ি এখনও সড়কে চলছে। তবে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান চললে সড়কে গাড়ির সংখ্যা কমে যায়। এতে জনগণের ভোগান্তির সৃষ্টি হয় উল্লেখ করে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “আমরা বিকল্প ব্যবস্থার বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করছি”। এটা কিন্তু সরকারের উল্টে পথে হাঁটারই লক্ষণ। সরকার শিথিল হলে আইনের প্রয়োগ না হলে সড়কে মানুষতো মরবেই।
এদেশে সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে মানবসৃষ্ট কারণে। এই হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতরা পরোক্ষভাবে হত্যারই শিকার। কিন্তু হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার কাঙ্খিত উদ্যোগ নেই। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা না কমে জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে। এরশাদ সরকারের আমলে সড়ক দুর্ঘটনা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেলে সরকার গাড়ির চালকের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করে। এতে চালকের দায়িত্বে অবহেলার কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যু ঘটলে চালককে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করার বিধান রাখা হয়। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে পড়ে তা রহিত করতে বাধ্য হয় সরকার। দায়ী চালকদের শাস্তি না হওয়া, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, লাইসেন্সবিহীন ও অদক্ষ চালক কর্তৃক গাড়ি চালানো, আনফিট গাড়ি রাস্তায় চালানো, সড়ক যোগাযোগে অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে এদেশে সড়ক দুর্ঘটনা মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত চালকদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর উদাহরণ খুব অনুজ্জ্বল। সব ক্ষেত্রেই দায়ী চালকরা পার পেয়ে গেছে।
সরকারি হিসাবে গত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেছে ৩৪ হাজার ৯১৮ জন। প্রতি বছর মারা যায় ৩ হাজার ৪৯১ জন। থানায় মামলা হয়েছে এমন দুর্ঘটনার হিসাব নিয়ে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে দায়িত্বশীলদের তরফে। বেসরকারি হিসাবে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে ২০ হাজার ৩৪ জন। প্রতিদিন গড়ে মারা যাচ্ছে প্রায় ৫৫ জন। সরকারি তথ্য ও বেসরকারিভাবে প্রাপ্ত তথ্যের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান থাকার কারণ হলো, দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের ৬৭ ধরনের প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করে প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। এ ঝামেলার কারণে অনেক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বিষয়টি যথাযথভাবে রেকর্ডভুক্ত হয় না। পুলিশের দেয়া তথ্যানুযায়ী ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ২ হাজার ১৪০ জন। মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে ১ হাজার ১৮৬ এবং সামান্য আহত হয়েছে ১৫৭ জন। অন্য একটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী ২০১০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৭২ হাজার ৭৪৮টি। মারা গেছে ৫২ হাজার ৬৮৪ জন। আহত ও পঙ্গু হয়েছে আরো কয়েক হাজার মানুষ। ২০১৯ সালে প্রকাশিত এক আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এশিয়া, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়ার ১৫টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার নেপালে বেশি, দ্বিতীয় বাংলাদেশে। সবচেয়ে কম হার যুক্তরাজ্যে। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার নিবন্ধিত যানবাহনের দুর্ঘটনায় নেপালে মারা যায় ৬৩ জন এবং বাংলাদেশে ৬০ জন। যুক্তরাজ্যে এ হার মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ।
সড়ক দুর্ঘটনাজনিত ক্ষয়ক্ষতির সাম্প্রতিক এক গবেষণা তথ্যে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় ফি বছর ৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদহানি হয়। এই হার দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৯৫ শতাংশের সমান। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির হার উন্নত দেশগুলোর তুলনায় শতকরা ৫০ ভাগ বেশি। অন্য এক গবেষণা জরিপ থেকে জানা যায়, ৪৮ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্যে দায়ী যাত্রীবাহী বাস, ৩৭ শতাংশ দায়ী ট্রাক। দেশে সন্ত্রাস দমনে যদি বিশেষ বাহিনী গঠন করা যায়, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এ জাতীয় বাহিনী গঠন করা হচ্ছে না কেন? জানমাল রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আইন না মানাই হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ। সবাইকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে।
দুর্ঘটনার অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, ২. গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার, ৩. অতিরিক্ত যাত্রী এবং পণ্য পরিবহন, ৪. ট্রাফিক আইন না মানা, ৫. সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা, ৬. চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অদক্ষতা ও অসতর্কতা এবং ৭. অরক্ষিত রেললাইন। কথা হলো, যে কোনো মৃত্যুই দুঃখজনক। মৃত্যু যদি অকাল ও আকস্মিক হয় তবে তা মেনে নেয়া আরো কঠিন। প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে একের পর এক অকালমৃত্যু আমাদের শুধু প্রত্যক্ষই করতে হচ্ছে না এই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক বিভীষিকাময় ও অরাজক পরিস্থিতিও মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সবার প্রচেষ্টায় এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির নিরসন করতেই হবে। এভাবে চলতে পারে না। এভাবে মানুষের জীবনপ্রদীপ নিভে যেতে পারে না।
যে কোনো মৃত্যুই দুঃখজনক। সে মৃত্যু যদি অকাল ও আকস্মিক হয়, তবে তা মেনে নেয়া আরও কঠিন। প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে একের পর এক অকালমৃত্যু আমাদের শুধু প্রত্যক্ষই করতে হচ্ছে না, এ দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক বিভীষিকাময় ও অরাজক পরিস্থিতিও মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যা আমাদের কারও কাছেই কাম্য নয়। আমরা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পরিবহন মালিক ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে সমন্বিত আন্তরিক, সচেতন, দৃঢ় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা আশা করি।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/পিআর