সিটি নির্বাচন : সাঈদ খোকনের কান্না এবং বাস্তবতা
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের পর বর্তমান মেয়র সাঈদ খোকনের কান্নার দৃশ্যটি টেলিভিশনের পর্দায় নিশ্চয়ই আপনি দেখেছেন। সেই কান্না কতটা ভেতর থেকে আসা আর কতটা মেকি, সেই বিচারের ভার দর্শকের। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কাঁদলেই যে সব সময় অন্যের সমানুভূতি বা সিমপ্যাথি পাওয়া যায়, তা নয়। সবার কান্না ঠিক ভালোও দেখায় না। কান্না পেলেও সব সময় কাঁদতে হয় না। কিছু সময় কান্না চেপে রাখতে হয়। আবার প্রিয়জনের মৃত্যুর শোকে কেউ যদি কাঁদে, তাকে গিয়ে এ কথা বলা অশোভন যে, কাঁদবেন না। ফলে কান্নারও একটা ব্যাকরণ আছে—যেটি সাধারণ মানুষের চেয়ে রাজনীতিবিদদের একটু বেশি জানতে হয়। কিন্তু সাঈদ খোকন কেন কাঁদলেন?
তিনি বোঝাতে চেয়েছেন গত পাঁচ বছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে তিনি অনেক কাজ করেছেন। মানুষের পাশে থেকেছেন। পরিবর্তনের সূচনা করেছেন। সুতরাং তিনি বিশ্বাস করেন, দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা তাকে আবারও মনোনয়ন দেবেন। তো এই কথা বলতে গিয়ে কাঁদতে হলো কেন? এখানে কান্নার কী উপলক্ষ্য তৈরি হয়েছে? তার মানে তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে এবার আর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাচ্ছেন না? আর যদি তিনি মনেই করেন বা বিশ্বাস করেন যে তিনি পাঁচ বছরে অনেক কিছু করে ফেলেছেন, দক্ষিণ সিটিতে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিয়েছেন, ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করেছেন, তাহলে এই কথা তো তার বুক উঁচু করে জোর গলায় সাহসিকতার সঙ্গে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলার কথা। কান্নাজড়ানো কণ্ঠে এ কথা বলে তিনি ভোটার ও তার নগরবাসীকে কী বার্তা দিলেন? তিনি যে বার্তাই দিতে চান না কেন, বস্তুত তার এই কান্নার দৃশ্যটি যারা টেলিভিশনে দেখেছেন, তাদের অনেকেরই পছন্দ হয়নি। কারণ তাদের মনে হয়েছে, এই কান্নার ভেতরে অভিনয় আছে।
আমরা স্মরণ করতে পারি ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের কথা। তিনি যখন দায়িত্ব নিলেন এবং সত্যিই একটা বড় পরিবর্তনের সূচনা করলেন, তার হাত ধরে উত্তর সিটি আসলেই বদলে যেতে শুরু করলো, ঠিক তখনই নিয়তির নির্মম পরিহাসের শিকার হয়ে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। তার এই অকস্মাৎ বিদায়ে এই মহানগরীর মানুষ ঠিকই কেঁদেছে। এখনও তাকে স্মরণ করেন এই নগরীর মানুষ। কারণ তিনি সত্যিই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
পক্ষান্তরে দক্ষিণ সিটিতে সাঈদ খোকন আসলে কী করেছেন? সরকারি অর্থ বরাদ্দ থাকলে কিছু কাজ নিয়মমাফিক হবেই। তাতে মেয়রের চেয়ারে যিনিই থাকুন অথবা ওই চেয়ারে যদি নির্বাচিত কেউ নাও থাকেন। ফলে প্রকল্পভিত্তিক কাজে মেয়রের কোনো ইনোভেশন বা দূরদর্শী চিন্তার ছাপ রাখা কঠিন। একজন সফল মেয়র হচ্ছেন তিনি, যিনি তার নগরীর সমস্যাগুলো জানেন-বোঝেন এবং নাগরিকদের সঙ্গে নিয়ে সেই সমস্যা সমাধান করেন। সাঈদ খোকন তার এলাকার মোটা দাগে কতগুলো সমস্যার সমাধান করতে পেরেছেন? উল্টো এডিস মশার কামড়ে যে মানুষগুলো ডেঙ্গিতে মারা গেলো, হাজার হাজার ডেঙ্গি রোগীতে হাসপাতাল উপচে পড়লো, তার দায় কি মি. খোকন এড়াতে পারেন? বরং তিনি মশা নিয়ে উল্টোপাল্টা কথা বলে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন। হাঁটুপানিতে নেমে কফির মগ হাতে নিয়ে জলাবদ্ধতার ফটোশ্যুট করে নিন্দিত হয়েছেন। লোকদেখানো পরিচ্ছন্নতা অভিযান করতে গিয়ে হাস্যরসের পাত্র হয়েছেন। রাতের বেলায় অফিস করে ব্যতিক্রমী কিছু করতে গিয়ে সমালোচিত হয়েছেন। অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ গমন এবং করপোরেশন পরিচালনায় তার দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সুতরাং সাঈদ খোকন কি বলতে পারবেন গত ৫ বছরে তিনি আসলে কোন কোন ক্ষেত্রে সফল এবং কেন তাকে আওয়ামী লীগ আবারও মনোনয়ন দেবে? কাজের চেয়ে লোকদেখানোর পাল্লাই কি তার ভারী নয়? সুতরাং তিনি যখন আবারও মনোনয়ন পাওয়ার জন্য কাঁদেন, সেটি মানুষের মধ্যে কোনো সিমপ্যাথি তৈরি করে না।
এসব বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়েই ঢাকা দক্ষিণে মেয়র পদে এমন একজন প্রার্থীকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যাকে নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই, অর্থাৎ যার ভাবমূর্তি ভালো। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও একাধিকবার এ কথা বলেছেন। যে কারণে দক্ষিণ সিটিতে এবার নাম আসে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের। মি. তাপস একদিকে সজ্জন ব্যক্তি, অন্যদিকে শিক্ষিত-মার্জিত এবং সংসদ সদস্য হিসেবেও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন।
অবশ্য সাঈদ খোকনকেও যখন আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিল, তখন তাকেও তার প্রয়াত পিতার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। কিন্তু মেয়র হানিফের ছেলে হিসেবে তিনি শেষমেষ নিজেকে কতটা উজ্জ্বল করতে পারলেন—তা নিয়ে নগরবাসীর মধ্যে সংশয় রয়েছে। বলা হয়, দায়িত্বপূর্ণ পদে বসার আগে কারো যোগ্যতা ও দক্ষতা বোঝা যায় না। অর্থাৎ আপনি কত ভালো ছাত্র, সেটি বুঝতে গেলে পরীক্ষা দিতে হয়। ফলে সাঈদ খোকনকেও আওয়ামী লীগ ভালো ছাত্র মনে করেই মনোনয়ন দিয়েছিল। কিন্তু তিনি পরীক্ষায় খুব ভালো ফল করতে পারেননি। কাজ যা করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন, সেখানে শো অফের মাত্রাটাই বেশি। সুতরাং এবার এই নগরীতে যিনিই মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হবেন, তাকে মোটা দাগে দুটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হবে। এক. পূর্বসূরির ভাবমূর্তি এবং দুই. ইনোভেশন।
তারপরও ঢাকা দক্ষিণের পরবর্তী মেয়রের জন্য শুভকামনা। নগরবাসীর প্রত্যাশা, তিনি কাজের চেয়ে কথা কম বলবেন, শোঅফ কম করবেন। কাজ যতটুকু করবেন, সেখানে জনস্বার্থকেই প্রাধান্য দেবেন। টেলিভিশনে চেহারা দেখানোর জন্য পরিস্কার রাস্তায় ময়লা ফেলে সেটি ঝাড়ু দিলে এখন আর গোপন থাকে না। সবার হাতে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট আছে। কে কোথায় কী করেন, কোনোকিছুই গোপন থাকে না। কারো না কারো ক্যামেরায় ঠিকই ধরা পড়ে যায়। অতএব, টেলিভিশনে চেহারা দেখানোর লোভ সংবরণ করতে পারাটাও নতুন মেয়রের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।
এইচআর/পিআর