আর কতো মারে দমবেন নুর? থামবে ছাত্রলীগ?
আর কতো মার খেতে হবে ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরকে। এতো মারেও সুস্থ হয়ে ওঠেন। বেঁচে আছেন এই বেচারা। আবার মার দেওয়া ছাত্রলীগও থামছে না। ক্লান্তও হচ্ছে না। কেউ থামাচ্ছেও না তাদের। লুকোচুরির কিছু নেই, নুরকে মারা উচিৎ কাজ বলে গর্ব করছে তারা। মার খাওয়া নুরুর বৈশিষ্ট্য-সৌন্দর্য্যের মতো জায়গায় এসে ঠেকলেও সর্বশেষ মারটার পর প্রশ্ন উঠছে আর কতো? পেটাতে পেটাতে মেরে ফেলা ছাড়া অন্যান্য সবই তো করা হয়েছে।
সর্বশেষ মারের ধরনে ভিন্নতার সঙ্গে বাড়তি কিছু প্রশ্ন সামনে এসেছে। ভাবিয়ে তুলেছে সচেতন তথা কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্নদের। এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু ভবনে নিজ রুমেই দরজা বন্ধ করে ভিপি ও তার সংগঠনের নেতাকর্মীদের বেদম পিটিয়েছে ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের সংগঠনের নেতাকর্মীরা। টানা দুই ঘন্টা ভিপি নুরের রুমে ও ভবনের সামনে ফ্রিস্টাইলে চলেছে তাদের তাণ্ডব। মেরে দোতলা থেকে নিচেও ফেলে দেয়া হয়েছে একজনকে। হামলার প্রমাণ হিসেবে ডাকসুর সিসিটিভি ফুটেজও নেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে। হামলা করতে আসা ছাত্রলীগের কর্মীরা সিসিটিভিসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি নিয়ে গেছে।
এ কাজের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে গেছে তারা। নুরের রুমে ঢুকে লাইট বন্ধ করে হাতুড়ি, রড, লাঠি ও বাঁশ নিয়ে হামলা চালায়। মারের চোটে একপর্যায়ে নুর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তার মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে থাকে। ডাকসুর জিএস ছাত্রলীগ নেতা গোলাম রাব্বানীকে আহতদের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি সাংবাদিকদের সোজাসাপ্টা জানিয়ে দেন, নুর বেঁচে আছেন না মারা গেছেন, তা বিবেচ্য নয়।’
গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ফাতরামিটা পাণ্ডামিতে স্থায়ী করার কোনো আয়োজন চলছে না তো? এমনিতেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ঢুকেছে রাজাকার। আবার রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা। এর মাঝে মুক্তিযোদ্ধা নামাবলীতে মারপিটের ওস্তাদি।‘মুক্তিযোদ্ধা’ নাম ব্যবহার করে মঞ্চ বানিয়ে ছাত্রলীগকে সঙ্গী করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতে দেয়া মানে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করাকে মদদ দেয়া। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ যা করছে এটা এখন আর কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু- দশজন শিক্ষার্থী বা নুরু- মোক্তার- জাহাঙ্গীর- রাম- রহিমের ইস্যু নয়। এর সঙ্গে দেশের বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়টির পুরো পরিবারের নিরাপত্তা ইস্যু।
এই মঞ্চঅলারা কারা? কাদের মদদে অবাধে-দাপটে যাচ্ছেতাই করে যাচ্ছে-তা গোপন পর্যায়ে নেই। কোত্থেকে রসদ পাচ্ছে-সেটাও ওপেন সিক্রেট। পরিবহণ শ্রমিক নেতা, আওয়ামী লীগের নতুন প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খানসহ ছাত্রলীগের কিছু নেতার একনিষ্ঠতায় গড়ে ওঠা কথিত মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে হামলা-চাঁদাবাজিতে এরইমধ্যে একটা আলাদা অবস্থান গড়ে তুলেছে। আরো বড় নেতা হওয়ার দিকে এগুচ্ছে।
গত কয়েক মাস ধরে এরা একের পর ঘটিয়েছে নানা কাণ্ড। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই সংগঠনের ব্যানারে কর্মসূচি, সাধারণ ছাত্রদের ওপর হামলার মতো একাধিক ঘটনায় ক্ষমতাসীন কোনো কোনো মহলে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামে এক্সট্রা আদর-কদর পাচ্ছে। আবার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে তাদের মধ্যে গোলমালও চলছে। দুয়েকবার ভাঙন ধরলেও অর্থ ও ক্ষমতার স্বার্থে মিলমিশও হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন দলবাজ শিক্ষক তাদেরকে বিশেষ ফোর্স হিসেবে যত্ন-আত্তিতে হৃষ্টপুষ্ট রাখছেন। মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দ ব্যবহার করে সংগঠন বানিয়ে এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে সহায়তা দেয়া শিক্ষকদের নিয়ে ছি: ছি: হচ্ছে শিক্ষকদের মধ্যেও। প্রক্টর কেন নুরুকে উদ্ধার কাজে যেতে ঘন্টা খানেক সময় নিলেন-সেটা নিয়েও কথা আছে। তারওপর ভিসির কণ্ঠে হামলাকারীদের পক্ষে সাফাই। নুরুকে বহিরাগত নিয়ে ঘোরাফেরার জন্য দোষারোপ।
রব্বানি-সাদ্দাম- সনজীতদের মেধাবী ছাত্র বলে প্রচারণা কম হয়নি। পরে কথিত এই মেধাবী-গুণধরদের বিনা পরীক্ষায় স্লিপ মারফতে ঢাকা বিশ্বিদ্যালয়ের মতো দেশের সেরা বিদ্যাপিঠে ভর্তির খবরও জেনেছে মানুষ। তাদের কেন এতো ক্ষোভ-বিরক্তি-তাচ্ছিল্য নুর নামের আনস্মার্ট-গোবেচারাকে নিয়ে? প্রশ্নটির স্পষ্ট জবাব নেই। নুর দেশের নামকরা কারো ছা-পোনা নয়। বড় কোনও সংগঠনের আশীর্বাদও নেই তার ওপর। তারপরও নুরকে মারার মধ্যে এক ধরনের মজাই পায় ছাত্রলীগ আর মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতাকর্মীরা। তারা মেরেধরে তাকে নিয়মিত ঢোলের মত বাজায়। কারো কারো আসকারায় মসকারার মতো ধোলাই কর্ম চলে আসছে তার ওপর। সেখানে শিক্ষকসহ বিশ্বিদ্যালয় প্রশাসনসহ কারো কারো ভূমিকাও দুঃখজনক।
যার কিছুটা উঠে এসেছে সেদিনের ঘটনা নিয়ে মর্মাহত এক শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক রুশাদ ফরিদীর অভিব্যক্তিতে। তার আকুতি ভরা ফেসবুক স্ট্যাটাসটি এমন... শিক্ষকতা ছেড়ে দেয়ার সময় হয়েছে। চোখের সামনে ডাকসু ভিপি নুরু আর অন্যান্য ছাত্রদের মেরে শেষ করে ফেলা হল। কিছুই করতে পারলাম না। নিজেদের ছাত্রদের রক্ষা করতে পারি না এই শিক্ষকতার কি দাম আছে? ডাকসু অফিসের দোতলায় উঠে দেখি কেউ কেউ পানি পানি বলে চিতকার করছে। কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ওরা দরজা বন্ধ করে বসেছিল। বার বার আশ্বাস দেয়ার পরেও ভয়ে দরজা খুলছে না। বলছিল, লাইট নিভিয়ে দিয়ে লোহার রড দিয়ে এলো পাথারি মারা হয়েছে। কয়েক বোতল পানি শুধু এগিয়ে দিতে পারলাম। এইটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়? আর আমিও একজন শিক্ষক? ছিঃ ছিঃ ছিঃ।
নুর আজ মার খায় কাল আবার সেলফি তোলে বলে কেউ নিশ্চিত নয়, কাল আবার মিলেমিশে তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের আদর্শ খুঁজবেন না বা আবার প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখা শুরু করবেন না। তাতে কেউ আশ্চর্য হবেন না। কিন্তু, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিজনেসের সঙ্গে এখন পাণ্ডামির বৈধতা দেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রক্তক্ষরণ। সরাসরি ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার না করে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ বা এই ধরনের কোন সংগঠনকে দিয়ে সন্ত্রাস- নৈরাজ্য চালানোকে লাভজনক ভেবে ক্ষমতাসীনদের একটি মহল সাময়িক পুলক পাচ্ছেন। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত তা বুমেরাং হতে বাধ্য। নুরকে নিয়ে তাদের চাতুরিও লাগাতার ফল দিতে থাকবে তা মনে করার কারণ নেই।
ভিপি নুরকে পিটিয়ে আহত করার পর ডাকসু জিএস রাব্বানী বলেছেন, নুরকে আর ডাকসুতে ঢুকতে দেয়া হবে না। চাঁদাবাজি-দুর্নীতিসহ নানা কাণ্ডকীর্তির কারণে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হলেও ডাকসুতে বহাল রাখা হয়েছে তাকে। সেই দুর্নীতিবাজই নুরকে বলছেন দুর্নীতিবাজ। অন্যদিকে, হাসপাতালে আহত নুরকে দেখতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নতুন প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক জানিয়েছেন- নুরকে পেটানোর সঙ্গে জড়িতদের বিচার করা হবে। এর মাঝে যুক্তির কথা শুনিয়েছেন, আওয়ামী লীগের স্পোকসম্যান ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, দুর্নীতির দায়ে বহিষ্কৃত রাব্বানী ছাত্রলীগের কেউ না। আবার নুরকে পেটানোর প্রমাণ সিসি টিভির ফুটেজ গায়েব করে ফেলা হয়েছে। মানুষ বুঝি কিছুই বোঝে না। এসব সার্কাসের চূড়ান্ত ফল কি শুভ হয় কখনো? ইতিহাস তা বলে না।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/জেআইএম