হাইব্রিড মুক্ত আওয়ামী লীগই নতুন নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ
আওয়ামী লীগের সম্মেলনে বড় ধরনের কোনো চমক যে থাকবে না সেটা আগে থেকেই আঁচ করা গিয়েছিল, তবে দু’একটা চমক যে ছিল না সেটি নয় বিশেষ করে শাজাহান খানের কমিটিতে পদ পাওয়া বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। একসময়ে জাসদ করা এই নেতা আগে কেন্দ্রীয় কমিটির কোনো পর্যায়ের দায়িত্বে না থাকলেও এবার সরাসরি সভাপতিমÐলীর সদস্য হওয়াটা আলোচনার খোরাক হয়। তবে আজকের আলোচনা সে বিষয়ে নয়, ২২ ডিসেম্বর কমিটি ঘোষণার পর নেতাকর্মীরা দলের সভাপতি শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানাতে গণভবনে যান। সেখানে তিনি বলেছেন, দলের যাতে কোনো বদনাম না হয় সে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে।
একইসঙ্গে সজাগ থাকতে হবে। দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা এই দলটি এমন একটি সময়ে সম্মেলনটি করলো যে সময়ে দলে অনুপ্রবেশকারী, যাদেরকে সাধারণ সম্পাদকের ভাষায় ‘হাইব্রিড’ বা ‘কাউয়া’র উৎপাতে ত্যাগী নেতাকর্মীরাই উপেক্ষিত। তাই সম্মেলনে আসা নেতাকর্মীরা বারবার সেটা সম্মেলনের ভেতরে দেয়া বক্তব্যে বা সংবাদমাধ্যমের সামনে বলতে চেয়েছেন দল যেন হাইব্রিড মুক্ত হয়। দল যেন শুদ্ধ হয়। এবং নতুন যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব তৃণমূলের নেতাকর্মীদের আশার পাশাপাশি দাবি, দল হাইব্রিড মুক্ত করাই হোক নতুন নেতৃত্বের প্রধান কাজ।
আওয়ামী লীগের মতো বৃহৎ এবং ঐতিহ্যবাহী একটি দল যে কয়েকবছর ধরে হাইব্রিড বা অনুপ্রবেশকারীদের কবলে পড়ে কিছুটা সম্মান হারিয়েছে সেটি আর নতুন করে বলার নয়। সেজন্য দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদেরও নানা সময়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। তাই মাঠপর্যায়ের নেতাদের দাবি, দলের মধ্যে অনুপ্রবেশকারীদের যারা জায়গা দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। দলীয় পদকে ব্যবহার করে কেউ যেন ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
স্থানীয় নেতাদের সহায়তায় বিশেষ করে ১/১১ এর পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে লাখ লাখ অনুপ্রবেশকারী যোগ দিয়েছে আওয়ামী লীগে। এদের সবাই যে দলের জন্য ক্ষতিকর তা হয়তো নয়, কিন্তু দলকে সমৃদ্ধ করেছে কম বরং দল বিক্রি করে আখেরে নিজেদের গুছিয়েছে বেশি। যাদের বেশিরভাগই বিএনপি, জামায়াত-শিবির এবং ফ্রিডম পার্টি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েই ইউনিয়ন থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়ে বড় বড় পদ বাগিয়ে নিয়েছে। কেউ কেউ জনপ্রতিনিধিও হয়েছেন বঙ্গবন্ধুর প্রতীক নৌকা নিয়ে। তারাই এখন ছড়ি ঘুরাচ্ছেন জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়নে।
পরিস্থিতি এমন যে কোথাও কোথাও নব্য আওয়ামী লীগারদের হাতে আওয়ামী লীগ বা তার সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মার খাচ্ছেন, অপমান-অপদস্ত হচ্ছেন। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে এখন বিএনপি-জামায়াত খুঁজে পাওয়া দায়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এবার টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় পর্যায়ে যেন সবাই আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে। যাদেরকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ‘কাউয়া’ এবং ‘হাইব্রিড’ নামে অভিহিত করে আলোচিত হয়েছিলেন। এদের দাপটে মূল স্রোতের আওয়ামী লীগাররাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। আওয়ামী লীগ যেহেতু ক্ষমতায় কাজেই সেখানে অনুপ্রবেশকারী ভিড়বে সেটাই স্বাভাবিক।
এছাড়াও অনুপ্রবেশ ঘটেছে এই কারণে যে, নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি বুঝে নিজেদের বাঁচাতে, মামলার ভয়ে, ভোটের হিসেবে স্থানীয়ভাবে, সুযোগ সন্ধানীরা নানা পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতার সূত্রে আওয়ামী লীগে ভিড়েছে, স্থানীয় আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়েছে বিএনপি জামায়াত, আবার কেউ কেউ ব্যবসা বাণিজ্য বা অবস্থান টিকিয়ে রাখতে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে। কিন্তু দলে ঢোকা সুবিধাবাদীরা ক্ষতি করছে নানাভাবে। এরা প্রথমত কর্মীদের অর্থ দিয়ে কিনে ফেলছে। সে কারণে এখন ত্যাগী বা নিঃস্বার্থ কর্মী নেই বললেই চলে। টাকা ছাড়া আদর্শের টানে কেউ চলতে চায় না। এসব কর্মী জড়ো হচ্ছে দুষ্ট নেতাদের পেছনে। এর ফলে কর্মীরা ভুল নেতা নির্বাচন করছে। তৈরি হচ্ছে দুষ্টচক্র। কিন্তু প্রকৃত আওয়ামী লীগাররা চান এর অবসান হোক।
ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে দলকে বড় করে দেখুক সবাই। তাই শেখ হাসিনা যখন ছাত্রলীগকে দিয়ে দলে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছিলেন। একে একে ধরা পড়েছিলেন যুবলীগের হোমড়া চোমড়ারা। তখন প্রকৃত আওয়ামী লীগাররা সাধুবাদ দিয়েছিলেন। কারণ তারা চান দল শুদ্ধ হোক। তারা শেখ হাসিনার ‘আমি কোনো নালিশ শুনতে চাই না। ছাত্রলীগের পর যুবলীগকে ধরেছি। একে একে সব ধরব।’ এমন কথার প্রশংসা করেছিলেন। আশার কথা, তৃণমূলের এই চাওয়া নিয়ে কাজ করছে আওয়ামী লীগ। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর হাতে যেসব অশুদ্ধ নেতা রয়েছে তার সংখ্যা পাঁচ হাজারের মতো। এরইমধ্যে তাদের দেড় হাজারকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও স্বাধীনতা বিরোধিতাসহ আরো গুরুতর অভিযোগ আছে। পুরো তালিকা শেষ করতে আরো কিছুদিন হয়তো সময় লাগবে। এবং একইসঙ্গে দলের শীর্ষ পর্যায়ে অনুপ্রবেশকারী রয়েছে কি না তাও দেখা হচ্ছে।
এসব কিছু নিয়ে এগুলোই হয়তো আগামীতে পরিশুদ্ধ একটি দল হয়ে উঠবে আওয়ামী লীগ। যেসব বুদ্ধিজীবী, জ্ঞানী গুণিরা এখন আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তারাও হয়তো সাধুবাদ জানাবেন। কারণ আমরা কুষ্টিয়ার ইছহাক মিয়ার মতো আওয়ামী লীগ চাই। যিনি রাজনীতি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। আর ৭১ বছর বয়সে ‘শেখের বেটি’ শেখ হাসিনাকে শেষ বারের মতো দেখতে ছুটে এসেছেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। আওয়ামী লীগ যে গণমানুষের সংগঠন, মানুষের জন্য কাজ করে, হাইব্রিড বা কাউয়া যেন দলটিকে বিভ্রান্ত করতে না পারে সেটিই ছিল এবারের সম্মেলনের তৃণমূলের চাওয়া। শীর্ষ নেতৃত্ব সেই চাওয়াটিকে যতো দ্রæত মূল্যায়ন করবেন ততোই দল বা দেশের মঙ্গল।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
এইচআর/জেআইএম