ইয়াবার ছোবল এবং মেধাবী স্বর্ণার করুণ মৃত্যু
কক্সবাজারে ২১ ডিসেম্বর রাতে ঢাকার এ লেভেলের মেধাবী ছাত্রী স্বর্ণা রশিদ (২১) মারা গেছেন। তার মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়। পত্রিকান্তে যতটুকু জানতে পারা যায় তার মৃত্যু হয়েছে অতিরিক্ত ইয়াবা সেবনে। এমন শোক আমাদের প্রতিনিয়তই সইতে হচ্ছে। স্বর্ণা রশিদ রাজধানী ঢাকার কোতোয়ালি চকবাজারের ৭ নম্বর বেগম বাজার এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হারুন উর রশিদ পাপ্পুর কন্যা। স্বর্ণা তার মামার বাড়িতে যাবার কথা বলেই বন্ধুদের সঙ্গে কক্সবাজার চলে আসেন। তারা ছিলেন সংখ্যায় ১০/১১ জন। কক্সবাজার পৌঁছে একটি হোটেলে তারা কক্ষ ভাড়া নেন। বিকালে সৈকত ভ্রমণ শেষেই হোটেল কক্ষে ফিরে বন্ধু-বান্ধব সবাই বুঁদ হয়ে যান মাদক সেবনে। এভাবেই মাদকাসক্ত হচ্ছে আমাদের তরুণ যুবকরা। একদিকে আমরা আমাদের সন্তানদের খোঁজ রাখছি কম অন্যদিকে রাষ্ট্র হুঙ্কার দিলেও গোটা দেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাদক। তাই যা হওয়ার কথা তাইতো হয়। সন্ধ্যার পর পরই মাদকের ঘোরে হুঁশ হারিয়ে ফেলেন মেধাবী ছাত্রী স্বর্ণা রশিদ। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। ডা. শাহীনের মতে বেশি পরিমাণে (ওভার ডোজ) ইয়াবা সেবন করায় স্বর্ণা রশিদের মৃত্যু হয়েছে।
অনেক কষ্টের সংবাদ এটি। এমন মৃত্যু আমাদের ব্যথিত করে। মাদকের কারণে অনেক মেধাবীকে হারাচ্ছি আমরা। প্রতিনিয়তই মাদক কেড়ে নিচ্ছি তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী প্রাণ। মাদকের হিংস্র ছোবল থামবে না হয়তো। যেদিন আমাদের দেশ মেধাবী শূন্য হবে, যেদিন সর্বনাশ হয়ে যাবে সেদিন হয়তো আমরা, আমাদের রাষ্ট্র বুঝতে শিখবে মাদক আমাদের সমাজকে কতটা ধ্বংস করে গেছে। রাষ্ট্র চাইলে হয় না এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রধানমন্ত্রী মাদকের ব্যাপারে হুঙ্কার ছুড়ছেন, সে হুঙ্কার কি আমাদের প্রশাসনের কর্ণকুহরে পৌঁছে না। অর্থের মজায় বিভোর প্রশাসন। অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তি এমনকি এমপিও মাদকের অবৈধ পয়সায় মজা পেয়েছেন। তাহলে মাদক বন্ধ হয় কি করে?
কক্সবাজারে মাদক সেবনে মৃত্যুও ঘটনা নতুন নয়। মাঝেমাঝেই এমন সংবাদ পাই আমরা। কক্সবাজারে বিষাক্ত ইয়াবা সেবন ক’মাস আগে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনায় পুরো কক্সবাজারজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। নকল বিষাক্ত ইয়াবায় বিষ ছড়িয়ে পড়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে সেবনকারী ও তাদের স্বজনেরা। তবুও থেমে নেই ইয়াবা সেবন। ইয়াবাতো আমাদের দেশের মাদক নয়। ইয়াবা থাই শব্দ হলেও মাদকাসক্তদের কাছে এটি ইয়াবা নামেই বেশি পরিচিত। তরুণ-তরুণীরা একে বলেন, ‘ক্রেজি মেডিসিন’, ‘হিটলার চকলেট’। এ মাদকের লেনদেন হয় ‘বাবা’ নামে। ড্রাগ অ্যান্ড ক্রাইমের প্রতিবেদন অনুযায়ী মাদকাসক্তদের ৬৮ ভাগই এখন ইয়াবাসেবী। এদের মধ্যে ৩০ ভাগই নারী। ইয়াবা আসক্তদের সিংহভাগই তরুণ-তরুণী। স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা, চিকিৎসকও রয়েছে তালিকায়। সূত্র বলছে, বছরে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার ইয়াবা ঢুকছে সীমান্ত দিয়ে।
আগে ইয়াবা ছিল না। তরুণ সমাজ মুড়ি মুড়কির মত সেবন করছে ইয়াবা। এখন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাময়িক আনন্দ আর উত্তেজনার জন্য ইয়াবা সেবন করছে তরুণ-তরুণীরা। এটি সাময়িক আনন্দ ও উত্তেজনা তৈরি করে সাময়িক হলেও ভুলিয়ে দেয় জীবনের সব যন্ত্রণা, আসক্তরা বাস করতে থাকে স্বপ্নের জগতে। দীর্ঘদিন আসক্তির ফলে শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকে, মেজাজ হয় খিটখিটে, বাড়ে নাড়ির গতি, রক্তচাপ, হেপাটাইটিস বি, সি ও এইডসের মতো জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়ে শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রমের ব্যত্যয় ঘটিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ইয়াবা সেবনের কারণে মস্তিষ্কের ভেতরকার ছোট রক্তনালিগুলো ক্ষয় হতে থাকে, এগুলো ছিঁড়ে অনেকের রক্তক্ষরণ হয়। স্মৃতিশক্তি কমে যায়, মানসিক নানা রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। সব ক্ষেত্রে ব্যর্থতা বা পিছিয়ে পড়তে থাকায় আসক্ত ব্যক্তিরা বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়। কারও মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়। একসময় সিজোফ্রেনিয়ার মতো জটিল মানসিক ব্যাধিও দেখা দেয়।
মাদকবিরোধী গবেষক দেখা গেছে, ইয়াবা সেবনকারীদের এক ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্ভরশীলতা তৈরি করে। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে ইয়াবা সেবনের পরিমাণ। এই ট্যাবলেট সাময়িক আনন্দ ও উত্তেজনা তৈরি করলেও পরবর্তীতে আসক্ত ব্যক্তি নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। পরিকল্পিতভাবে দেশের মেধাবী প্রজন্ম ধ্বংস করতেই ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে ইয়াবা। পরিবার উদ্যোগী হলে এবং সঠিক কাউন্সিলিং ও চিকিৎসা করা গেলে আসক্ত ব্যক্তিকে নেশা থেকে ফেরানো সম্ভব।
থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারে এর উৎপাদন সবচেয়ে বেশি। শুধু বাংলাদেশকে টার্গেট করেই ইয়াবা তৈরি করছে মিয়ানমার। ১৯৯৮ সালের দিকে দেশে আসতে শুরু করে ইয়াবা। প্রথমে উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের টার্গেট করে ছড়িয়ে দেয়া হয় এই মরণ নেশা। নকল ইয়াবা তৈরি করে দাম কমিয়ে উচ্চবিত্তের গতি ছাড়িয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত তরুণ-তরুণীদের মধ্যেও ইয়াবার বিস্তার ঘটে। গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, প্যাথেডিনের পথ ধরে বাংলাদেশেও এখন এটি সহজলভ্য।
ইয়াবার আগ্রাসন থেকে যুব সমাজকে রক্ষা করতে প্রয়োজন সামগ্রিক প্রতিরোধ। প্রতিবেশী দেশ থেকে যেসব সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা ঢুকছে, সেসব জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে। ইয়াবার কুফল সম্পর্কে সবাইকে বিশেষত উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীদের সচেতন করতে হবে। এমন নয় যে, আসক্ত ব্যক্তিরা আর কখনোই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে না। এজন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা। পারিবারিক কাউন্সিলিং বড় বেশি প্রয়োজন। আমরা আসলে আমাদের সন্তানদের আদর করতে ভুলে যাচ্ছি। অনেক বাবা মা সন্তানদের ব্যাপারে অনেক উদাসীন। তাদের সন্তানরা কী করছে কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে কোনই খোঁজখবর রাখেন না। কক্সবাজারের অতিরিক্ত ইয়াবা সেবনে মারা যাওয়া স্বর্ণা মামা বাড়ি যাবার কথা বলে কক্সবাজারে বন্ধুদের সাথে কিভাবে বেড়াতে গেলো। এখনতো আর আগের যুগ নেই ভিখারীর হাতেও মোবাইলফোন থাকে এখন। তাহলে মেয়ে মামার বাড়ি বেড়াতে গেল কিনা তার খোঁজ দেয়া দরকার ছিল স্বর্ণার পরিবারের।
আমাদের অনেক সন্তানই এখন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। সন্তানের ব্যাপারের উদাসীন মা-বাবা। অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবাও মাদকাসক্ত হয়। বিষণ্ণতায় ভোগে সন্তান। আর এ থেকেই মাদকাসক্তি। তরুণীদের মধ্যে মাদকাসক্তির আরেকটা কারণ আছে। ইয়াবা সেবনে ক্ষুধা কমে যায় বলে বেশিরভাগ তরুণী প্রথমে এটি সেবন করেন স্লিম হওয়ার ওষুধ হিসেবে। তরুণ-তরুণীরা এর ক্ষতিকর প্রভাব বুঝে ওঠার আগেই আসক্ত হয়ে পড়ে। ইয়াবার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এতটাই ভয়ঙ্কর যে টানা সাত থেকে ১০ দিনও জেগে থাকতে বাধ্য হয় সেবনকারীরা। এক সময় শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকে, মেজাজ হয় খিটখিটে, গলা-মুখ শুকিয়ে আসতে থাকে অনবরত। প্রচণ্ড ঘাম আর গরমের অসহ্য অনুভূতি বাড়তে থাকে। বাড়ে নাড়ির গতি, রক্তচাপ, দেহের তাপমাত্রা আর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি। দীর্ঘদিনের আসক্ত ব্যক্তিরা উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন। এক সময় যার পরিণতি মৃত্যু।
আমরা আমাদের সন্তানদের আর হারাতে চাই না। ওরা একটু আদর চায়। ওরা চায় ওদের ভালোবেসে আমরা একটু জড়িয়ে ধরি। চুমুখাই। কজন বাপ-মা এটা করেন। প্লিজ আপনার সন্তানদের একটু সময় দিন। ওদের কাছে কাছে রাখুন। এটাইতো ওদের ভুল করারর সময়। ওদের ভুল করতে দেয়া যাবে না। ওদের মাদকসক্ত হতে দেয়া যাবে না। ওরা মাদকাসক্ত হলে, আগামী প্রজন্ম ধ্বংস হলে কি হবে দেশের। আমরা মাদক মুক্ত সমাজ চাই। মেধাবীপূর্ণ সমাজ চাই।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/এমকেএইচ