আসন্ন সিটি নির্বাচন ও ঢাকার দূষণ ভাবনা
কেন্দ্রীয় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন আসন্ন। ইতোমধ্যে পুরো ঢাকা দূষণের শহর হিসেবে জগতজুড়ে খ্যাতি পেয়েছে। এমন একটা অপবাদ সাথে করে নিয়েই নতুন প্রতিশ্রুতি নিশ্চয়ই আমরা শুনব নির্বাচনের প্রার্থীদের কাছ থেকে। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক গুলশান-বনানীর কিছু সড়ক আধুনিক করে গড়ে গিয়েছিলেন। এর বাইরে এই শহরের রাস্তাঘাটের বেশিরভাগই এখন চলাচলের অযোগ্য। দ্রুত বাড়ছে জনবসতি। একটা আধুনিক শহর হিসেবে এটি গড়ে উঠবার আগেই কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। শহর বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে যেসব সমস্যা মাথাচাড়া দিয়েছিল সেই মধ্য আশির দশকে তার সুষ্ঠু সমাধান অধরাই থেকে গেছে।
যদিও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজধানীর অনেক কাজের জন্য সিটি কর্পোরেশনকে নির্ভর করতে হয় অনেক কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর, তবুও মানুষের অনেক প্রত্যাশা মেয়র আর কাউন্সিলরদের কাছে। এই যে দূষণ, এই যে এত ধুলার আক্রমণ, ডেঙ্গুর বিস্তার, বৃষ্টির আগেই ভেসে যাওয়ার সমস্যা, যানজট- এমন অসংখ্য সমস্যার সমাধান নাগরিকরা আশা করে সিটি কর্পোরেশনের কাছেই।
আমাদের উন্নয়ন প্রয়োজন এবং জনগণ সরকারের উদ্যোগে চলতে থাকা ব্যাপক উন্নয়ন কাজকে স্বাগতও জানায়। কিন্তু উন্নয়নকাজের কারণে যে ব্যাপক দূষণ চলছে তার থেকে পরিত্রাণও চায়। এখানে অবশ্যই সিটি কর্পোরেশনের ভূমিকা আছে। নির্মাণসামগ্রী থেকে দূষণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই কথা হচ্ছে। এমনকি বায়ুদূষণের পেছনেও অন্যতম কারণ যে এই নির্মাণসামগ্রীর দূষণ, একাধিক রিপোর্টে ইতোমধ্যেই তা প্রমাণিত। কিন্তু সব জানা সত্ত্বেও সিটি কর্পোরেশন চোখ বুজে আছে বলে মনে করে নাগরিকসমাজ। নির্মাণস্থলের দূষণ ঠেকাতে কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে সামান্য তৎপরতা চোখে পড়ছে না।
আমরা আশা করেছিলাম, কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হবে যে, রাস্তায় বেআইনিভাবে নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখলে সংশ্লিষ্ট নির্মাতাসংস্থা বা স্থাপনামালিকের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে। শহরের কোথায় কোথায় রাস্তাজুড়ে নির্মাণসামগ্রী পড়ে রয়েছে, তা সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা হবে। কিন্তু কিছুই দেখলাম না।
বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ নির্মাণস্থলের দূষণ। এটি ঠেকাতে সিটি কর্পোরেশেনের নিয়মিত নজরদারির কোনো বিকল্প নেই। নির্মাণকাজ চলাকালীন নির্মাণস্থল পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা, নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, সেই জিনিসপত্র লরিতে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার সময় ঢেকে রাখাসহ একগুচ্ছ নিয়ম আছে এবং এই কাজগুলো এমন শৃঙ্খলার সাথে করতে ঠিকাদাররা চুক্তিবদ্ধ। কিন্তু কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি। এর কারণ শহর ঘুরে কোন কোন রাস্তায় নির্মাণসামগ্রী কীভাবে যত্রতত্র পড়ে আছে তা দেখার স্বদিচ্ছা বা কাঠামো কর্পোরেশনের নেই। হয়তো কর্পোরেশনের কর্তারা বলবেন এত অত লোক তারা কোথায় পাবেন? তাছাড়া বলতে পারেন, শুধুতো এই একটা কাজই নয়, রোজ আরও অজস্র কাজ থাকে তাদের।
শুষ্ক মওসুম চলছে। তাই ধুলায় ধূসর রাজধানী। বাতাসে ভাসছে ধুলা আর ক্ষতিকর উপাদান। এই দূষণ অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে এখন। বায়ুর মান নিয়ন্ত্রক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর শীর্ষ বায়ুদূষণের শহরের একটি ঢাকা। ভারতের ‘গ্যাসচেম্বার’ আখ্যা পাওয়া দিল্লির বাতাসের চেয়েও বেশি দূষিত হয়ে পড়ছে ঢাকার বাতাস। বায়ুর মান নিয়ে গবেষণা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী সম্প্রতি টানা তিনদিন ধরে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহরের তালিকার শীর্ষে ছিল ঢাকা। বিশ্বের বায়ুর মান যাচাইবিষয়ক প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়াল প্রতিদিনই বায়ুর মান নিয়ে তথ্য প্রকাশ করে। এ তথ্য প্রকাশ করা হয় প্রতি ঘণ্টায়।
সিটি কর্পোরেশন কতটা কী করতে পারবে, জানা নেই। কিন্তু নির্মাণস্থলের দূষণ অন্যতম উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ নির্মাণকাজ চলার সময় বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার (পিএম ১০) পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। প্রতিবছর সারা শহরে কোটি টন নির্মাণবর্জ্য তৈরি হয়। সেই বর্জ্য থেকে দূষণ কমানোর জন্য সরকারের সাথে দুই সিটি কর্পোরেশনকে জরুরিভাবে বসতে হবে। একটি ‘ডাস্ট মিটিগেশন’ নির্দেশিকা প্রয়োজন দ্রুততার সাথে। নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণের কাজ এবং ভাঙাভাঙির কাজের সময় কী কী নিয়ম মানতে হবে, সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে বলে দিতে হবে নির্মাণকারী ও তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
নির্মাণস্থলের দূষণের বিষয়টি পিডব্লিউডি, সড়কবিভাগ এবং পরিবেশ অধিদফতরের কাজ হলেও সমন্বয়ের কাজটি উদ্যমী হয়ে সিটি কর্পোরেশনকেই নিতে হবে। কোনো বাড়ির একটি তল তৈরি হয়ে গেলে আর রাস্তার ওপর নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখা যাবে না। সেসব বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে নিতে হবে। তারপরও রাস্তায় নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখলে সংশ্লিষ্ট নির্মাতাসংস্থাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে, প্রয়োজনে কাজ বন্ধ করে দিলে হয়তো বা একটি বড় সচেতনতা সৃষ্টি হতে পারে।
সামগ্রিক নগরপরিকল্পনায় সুসংহতির অভাব, নাগরিক সমাজকে বিচ্ছিন্ন রেখে সিটি কর্পোরেশন যে বেশি দূর এগুতে পারে না তার আভাস দিয়ে গেল ডেঙ্গু। আশা করছি দূষণ রোধে একটা উদ্যম চোখে পড়বে দুই কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে।
এইচআর/বিএ/এমএস