সাধারণের জন্য অসাধারণ জাল!
নিয়ম সবার জন্য সমান হলেও নিয়মের বলি হতে হয় অনেক সাধারণ মানুষকেই। কিংবা নিয়মের চক্রে ঘুরপাক খেতে হয় আমজনতাকেই। সম্প্রতি এরকমই এক নাকানি-চুবানিতে তিক্ত অভিজ্ঞতা জমা হলো আমার ঝুড়িতে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ইস্যু করা আমার পাঁচ বছর মেয়াদী একটি সঞ্চয়পত্র কোনভাবে হারিয়ে গেছে। তার রেজিস্ট্রেশন নম্বরটা শুধু আমার কাছে আছে।
মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর, ঐ রেজিস্ট্রেশন নম্বরটি নিয়ে গেলাম বাংলাদেশ ব্যাংকে। তারা যে নিয়ামাবলি দেখালো তাতে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। ঘটনা শুনে অনেকেই বলেছিলেন, বাদ দিতে। যেহেতু টাকার অংকও কম। কিন্তু আমি বললাম, দেখি কতটা করা লাগে। আমার টাকা, প্রমাণ তো একটু আছেই। এরপর নিয়মাবলী অনুসারে রেজিস্ট্রেশন নম্বরটি দিয়েই প্রথমে জিডি করলাম, দু'টি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলাম, হলফনামা ও ইনডিমনিটি বন্ড নোটারি করলাম। দুই/আড়াই ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে চালান এবং আরো আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করে পুরো ফাইল জমা দিলাম। মাঝখান থেকে এইসব কাজে আরো দেড়/দুই হাজার টাকা বেরিয়ে গেল।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ফাইলের নথিপত্র চেক করে দেখে গ্রহণ করে বললেন, মাসখানেক পর খোঁজ নিতে। দিন পঁচিশেক পর, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেই ফোন এলো। দেখে ভাবলাম, যাক কাজ হয়ে গেছে বোধ হয়। কিন্তু যা শুনলাম, তাতে বিরক্তি আরো চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছালো। সরেজমিনে গিয়ে দেখলাম- রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিয়ে করা জিডি, বন্ড, হলফনামা, পত্রিকার বিজ্ঞাপন কিছুই কাজে আসবে না। আবার মূল সঞ্চয়পত্রের নম্বর দিয়ে সব প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। বিরক্তি সংবরণ করতে না পেরে বললাম, থাক্, যথেষ্ট হয়েছে। আপনারা অনেক কষ্ট করেছেন, তাই ধন্যবাদ। টাকাটা আমার লাগবে না, আপনাদেরকে দান করলাম।
সংশ্লিষ্ট কর্মকতা হাসতে হাসতে বললেন, আপা আমাদের নয়, বাংলাদেশ ব্যাংককে। তবে পাঁচ টাকার নথি হারালেও এই একই পদ্ধতিতেই যেতে হবে। এত্তসব বিরক্তি আর ঝুট-ঝামেলা এড়াতেই বোধ হয় মানুষ বেসরকারি ব্যাংকের দিকে ঝুঁকে। যদিও সেখানেও সাধারণ গ্রাহকের জন্য নিয়মের বালাই কম না। আধুনিকতা আর নিয়ম-নীতির নামে ঝুট-ঝামেলাও কম নয়।
প্রশ্ন জাগে, এতো নিয়মাবলী আছে তো হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি হয় কিভাবে? বড় বড় ব্যবসায়ীরা চিহ্নিত ঋণখেলাপীর তালিকায় থেকেও নতুন করে ঋণ পায় কিভাবে? অনেকে বলেন, তাদের জন্যই সবকিছু। কারণ তারাই তো ধরাকে সরা জ্ঞান করে। তাহলে নিয়ম-নীতি কি শুধুই সাধারণের জন্য! দুর্ভোগ কি তাদের কপালেই?
আমার মাথায় ঢোকে না, সহজ বিষয়গুলো কেন জটিল করে বাংলাদেশের প্রশাসনিক যন্ত্রটা। হ্যাঁ, গ্রাহক বা ক্রেতা হিসেবে আমারও দোষ আছে। আমি একটি নথি কেন যত্ন করে রাখলাম না। কিন্তু পাঁচ বছরের পুরোনো একটি কাগজের জন্য এতো হাবুডুবু খেতে হলে তো, কারো আর এ ধরনের সেবা নিতে আগ্রহী হওয়ার কথা নয়। তারপরও বলছি, যেহেতু রেজিস্ট্রেশনের নথি আমার কাছে প্রমাণ হিসেবে ছিল, তাহলে অফিসিয়াল রেকর্ডপত্রে তো তার নজির পাওয়াই যেত। হয়তো কর্মকতা আর কর্মচারীদের একটু কাজ বেড়ে যেত। তাতে কি, কিন্তু সহজে তো একজন গ্রাহক সেবা পেতো।
বড় বড় দুর্নীতিবাজ, অসাধু ব্যবসায়ীরা দিনের পর দিন নিত্যনতুন ব্যাংক ঋণ, নানা ধরনের ব্যাংকিং সেবা নিয়ে নিচ্ছে। আর সাধারণ মানুষকে নাজেহাল করার যত্তো রকম কায়দা আছে, ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান তার সবটাই করার জন্য তারা তথাকথিত নিয়মের জাল বিছিয়ে রেখেছেন। সাধারণ জনগণের জন্য সে জালে কোন ফুটো-ফাটা নেই। তবে রাঘববোয়ালদের জন্য বলা চলে কোন জালই নেই, একেবারে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে যেতে তাদের জন্য উন্মুক্ত সবক'টি দ্বার।
ব্যাংক জালিয়াতি ঠেকাতে, লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরে নানা কায়দা-কানুন ও প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তারা সহজ সাবলীল কিছু পথ বেরই করতে পারে না সোজাসাপ্টা জনসংযোগে। এক্ষেত্রে কি ধরনের পন্থা অবলম্বন করলে আমার মতো ছা-পোষাদের ভোগান্তি কমবে, দীর্ঘ মেয়াদী সঞ্চয় বা ঋণের ক্ষেত্রে গ্রাহকের তথ্যাদি কোথায়, কোন পদ্ধতিতে সংরক্ষিত হবে-এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্টদেরই গ্রহণযোগ্য ভূমিকা নিতে হবে। প্রয়োজনে তারা ব্যাংকিং সিকিউরিটি এবং প্রিজারভেশন নিয়ে গবেষণাও করতে পারেন। যদিও এসব নিয়ে যারা নিয়মিত কাজ করেন, তারাই আমার চেয়ে এ বিষয়গুলো আরো ভালো বোঝেন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, বাংলাভিশন।
এইচআর/এমএস