পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন কোর্স এবং টেকসই উন্নয়ন
প্রবাসী আমার এক পরিচিতজন আছে। জীবনের বিভিন্ন টানাপড়েনে, বিভিন্ন পারিবারিক জটিলতায় সে উচ্চশিক্ষা সম্পূর্ণ করতে পারে নাই। এ নিয়ে তার ক্ষোভের অন্ত নেই! একদিন আমাকে বিদেশ থেকে ফোন করে জিজ্ঞেস করছে যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদাভাবে পড়াশোনার সুযোগ আছে কিনা? তার কণ্ঠের মধ্যে একটা আতঙ্ক, চাপা কষ্ট অনুভব করলাম। সে ভাবছে যদি করা না যায় তাহলে জীবনের শেষ ইচ্ছাটা অপূর্ণই থেকে যাবে। সে তো বাংলাদেশের একজন নাগরিক। পারিবারিক বিভিন্ন জটিলতায় সে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারে নাই কিন্তু পরবর্তীতে সে যদি উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার ইচ্ছা পোষণ করে তাহলে কি দেশ তাকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবে? শিক্ষা তো প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার। এটা কোন সুযোগ নই। এই স্লোগান আমরা সবাই জানি, আমরা সবাই দেই কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তার বাস্তবায়ন আমরা যথার্থভাবে করি কিনা।
গত শুক্রবারে সান্ধ্যকালীন কোর্সের একজন বয়স্ক ছাত্রী বলছিল যদি এই ডিগ্রীর মেয়াদ আরো বেশি হতো তাহলে আমাদের জন্য আরো ভালো হতো। অনেক কিছু শিখতে পারতাম। তার কথায় যেন আক্ষেপের শেষ নেই! কেন জ্ঞান অর্জনের এই বাঁধাধরা সময়কাল! আমি ব্যক্তিগতভাবে একজন শিক্ষক হিসেবে এইসব বয়স্ক ছাত্র-ছাত্রীদেরকে সম্মান জানাই তাদের শিক্ষার প্রতি, জ্ঞান অর্জনের প্রতি আগ্রহ দেখে। তারা তাদের অর্জিত জ্ঞানে সন্তুষ্ট না। তারা তাদেরকে আরও সমৃদ্ধ করতে চায়। দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে চায়। কর্মক্ষেত্র মহিমান্বিত হতে চায়।
আমরা তো সবাই জানি সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা শেষ হয়েছে ২০১৫ সালে। এখন আমরা টেকসই উন্নয়নের যুগে আছি। তাই যে সকল শ্রেণীপেশার মানুষ জীবনের প্রয়োজনে উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করতে পারে নাই, উচ্চশিক্ষার উজ্জ্বল আলোতে আলোকিত হবার আগেই চাকরিতে প্রবেশ করেছে তারা যদি নতুনভাবে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অবদান রাখতে চায় সেক্ষেত্রে সেটা কি তাদের বেশি চাওয়া হবে বা অন্যায় হবে? নাকি আমরা যদি শিক্ষক হিসেবে, আলোকিত, সমৃদ্ধ উন্নত মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে তাদেরকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করি সেটা অন্যায় হবে ?
অন্যদিকে কারো যদি শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক বা সামাজিক কারণে শিক্ষা ক্ষেত্রে গ্যাপ তৈরি হয় এবং তারা যদি পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে জীবনে আবার নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে চায় / উদ্যোক্তা হতে চায় তাহলে কি তাদের সেই চাওয়াটা খুব বেশি অযৌক্তিক হবে? একজন শিক্ষক হিসেবে আমরা তো জ্ঞান বিতরণের ক্ষেত্রে কৃপণতা দেখাতে পারি না! জ্ঞান কুক্ষিগত করে রাখতে পারি না। জ্ঞান তো এমন এক সম্পদ যা বিতরণে কখনো কমে না বরং বাড়ে।
এইযে বৈকালিক বা সান্ধ্যকালীন বা নৈশকালীন নামে যে ডিগ্রী দেওয়া হচ্ছে এটা তো দেশের উন্নয়নের জন্য আমি বলবো একটা সুদুরপ্রসারি প্রভাব রাখছে। কারন খুব সহজ ভাবে যদি আমরা চিন্তা করি একজন মানুষ যে কিনা উচ্চশিক্ষা অসম্পূর্ণ রেখে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছিল সে যদি তার এই অসম্পূর্ণ জ্ঞান দিয়েই কর্মজীবন শেষ করে সেটা কি দেশের উন্নয়নের জন্য ভালো নাকি কর্মজীবনের কোন এক পর্যায়ে এসে আবার সে যদি তার দক্ষতা উন্নয়নের জন্য সর্বোপরি দেশের উন্নয়নের জন্য আরো বেশি জ্ঞান অর্জন করতে চাই, দক্ষতা বাড়াতে চায় সেটা ভালো? তারা যদি নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করতে চায় তাহলে তাদেরকে এই সুযোগ থেকে কি আমাদের বঞ্চিত করা ঠিক হবে?
মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের আচার্যের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেই বলছি উনি যে সান্ধ্যকালীন কোর্সের বিষয়ে যে নৈতিক আহ্বান করেছেন এটা সম্পূর্ণভাবে যুক্তিযুক্ত এবং যথার্থ। যে সকল বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে বৈকালিক বা সান্ধ্যকালীন কোর্স চালানোর জন্য নিয়মিত একাডেমিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে বা ছাত্রছাত্রীরা বঞ্চিত হচ্ছে সেসব জায়গা গুলো খুজে বের করা প্রয়োজন এবং সেই অনুযায়ী সুব্যবস্থা গ্রহণ করলে এই সমস্যার অনেকাংশে সমাধান সম্ভব।
১৬ কোটিরও বেশি মানুষের এই বাংলাদেশে এখন যখন সাক্ষরতার হার ৭২ দশমিক এর উপরে কিন্তু যদি আমরা ১৫ বা ২০ বছর আগে তাকাই তখন কি সাক্ষরতার হার এবং উচ্চ শিক্ষার হার এমন ছিল? এমন ধনাত্মক চিত্র কিন্তু ছিল না। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র এবং অপুষ্টির দুষ্টচক্র আমাদেরকে বিভিন্ন ভাবে ঘিরে রেখেছিল কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই ধনাত্মক চক্র শুরু হয়েছে। শিক্ষার ধনাত্মক চক্র শুরু হয়েছে। পুষ্টির ধনাত্মক বা ভাল চক্র শুরু হচ্ছে।এগুলো অর্থপূর্ণ বার্তা বহন করে। দেশে যে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে তারা তো রাষ্ট্রের নাগরিক তাই তাদের উন্নয়নের কথা, দেশের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে আরো পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা সমূহ অর্জন করতে গেলে অপরিপূর্ণভাবে শিক্ষিত মানুষদেরকে পরিপূর্ণ শিক্ষায় শিক্ষিত হবার যে প্ল্যাটফর্ম বা সুযোগ আছে তা যদি আমরা না দিই তাহলে প্রকৃত অর্থেই দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে ।
যেহেতু আমি খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞানের শিক্ষক তাই পুষ্টি নিয়ে কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। ধরুন একজন উন্নয়নকর্মী যে পুষ্টি নিয়ে কাজ করে সে হয়তো উচ্চশিক্ষা অসম্পূর্ণ রেখে বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন না করে তার কর্মক্ষেত্র প্রবেশ করেছিল। জীবনের প্রয়োজনে হয়তো তার এই চাকুরিটা নিতে হয়েছিল কিন্তু সেই সীমিত জ্ঞান দিয়ে বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংকীর্ণ জ্ঞান দিয়ে সে আসলে কতখানি পুষ্টিমান উন্নয়নে, একটা পুষ্টিসমৃদ্ধ জাতি গঠনে ভূমিকা রাখতে পারবে?
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে খাদ্য ও পুষ্টি বিভাগ আছে যেখান থেকে নিয়মিত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করে ছেলেমেয়েরা দেশের উন্নয়নে, দেশের পুষ্টি মান উন্নয়নে সর্বোপরি একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। কিন্তু যারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন অর্গানাইজেশনে পূর্ব থেকে কর্মরত অবস্থায় আছে তাদের যদি বিষয় ভিত্তিক এবং কর্ম সংশ্লিষ্ট জ্ঞানের ঘাটতি থাকে বা দুর্বলতা থাকে তাহলে তারা দক্ষতার সাথে, আত্মবিশ্বাসের সাথে দেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারবে না। তাই অদূর ভবিষ্যতে যদি আমরা একটি উন্নত দেশ দেখতে চাই তাহলে অবশ্যই সেই দেশের সমস্ত শ্রেণি-পেশার, সমস্ত বয়সের মানুষের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাহলে যদি এই শ্রেণীর তথা এই বয়সের মানুষেরা তাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ থেকে কর্ম সংশ্লিষ্ট বিষয়ক প্রয়োজনীয় উচ্চশিক্ষা নিয়ে (স্নাতকোত্তর) নিজেকে উন্নত করতে চায় তবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি সেই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে? আমরা দেখেছি আমার দেশে অনেক প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন আছে যারা কিনা বয়স্ক শিক্ষা নিয়ে কাজ করে । এই " বয়স্ক শিক্ষার" যে সুদূর প্রসারী উদ্দেশ্য সেটা কি বিদ্যালয়ের বৈকালিক বা সান্ধ্যকালীন শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক? এ প্রশ্ন তো মনে আসতেই পারে!
আমরা বয়স্ক শিক্ষার দিকে মনোযোগ দিচ্ছি কারণ সেই সময়ে যখন তারা কিনা যুবক-যুবতী ছিল তখন হয়তো পড়াশোনার উপযোগী পরিবেশ বা পড়াশোনা চালানোর মতো সক্ষমতা তাদের ছিল না কিন্তু বর্তমানে দেশের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হয়েছে এবং গড় ইনকাম বেড়েছে তাই সেই সকল মানুষতো আর অপরিপূর্ণ থাকতে চাইবে না। তারা তো পরিপূর্ণ হতে চাইতেই পারে। এখন দেশের জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে অর্থাৎ জনগণের সেবক হিসেবে যদি মনে করা হয় যে তাদেরকে আমরা শিক্ষার দিক দিয়ে অসম্পন্ন থাকতে দিবো না। তাদেরকে প্রকৃত আলোকিত মানুষ হিসেবে নতুনভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অবদান রাখবো সেটা কি তাদের নৈতিকতার স্খলন হিসেবে ধরা হবে? তবে এখানে একটি বিষয় বলে রাখা প্রয়োজন যে আমাদের শিক্ষকদেরও মস্তিষ্ক ও মননে আরো বেশি উন্নত হওয়া প্রয়োজন।
আরেকটা বিষয় আমাদের দেশে বিদ্যমান চাকুরী ব্যবস্থা অনেকটা এই ধরনের অতিরিক্ত ডিগ্রির প্রয়োজনীয়তা তৈরি করে রেখেছে। যখন কিনা একজন নন-ব্যাংকিং বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে ব্যাংকে যোগদান করে তখন আসলে তার কর্মদক্ষতা বাড়ানো বা কর্ম পরিবেশ বজায় রাখার জন্য এ ধরনের অতিরিক্ত ডিগ্রীর প্রয়োজনীয়তা এসে যায়। কথিত আছে জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীনে যাও। জ্ঞান সে তো হবে অবারিত। শিক্ষা তো সৌন্দর্য, সুগন্ধ। তা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বা জ্ঞান বিতরণের ক্ষেত্রে আমাদের কি কৃপণ হওয়া উচিত হবে?
জ্ঞান বিতরণের জন্য এবং জ্ঞান সৃষ্টির জন্য যে সমস্ত প্ল্যাটফর্ম আছে সেগুলো যাতে সুষ্ঠুভাবে চলে, কোন অতিরঞ্জিতকরণ বা ভেজাল যাতে এসবের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে সেই বিষয়গুলো একজন শিক্ষক হিসেবে অবশ্যই আমাদের ধারণ করতে হবে এবং সেগুলোর যথার্থ প্রয়োগ করতে হবে। বৈকালিক বা সান্ধ্যকালীন কোর্স নিয়ে যে সমস্ত কথা পত্রপত্রিকায় বিভিন্নভাবে আসছে তার থেকেও একটা বিষয় ক্ষতিকর মনে হয় সেটা হচ্ছে শিক্ষক রাজনীতি। আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি যথার্থ বলেছেন যে অনেকে শিক্ষক রাজনীতি করতে করতে ভুলেই যান যে সে "একজন শিক্ষক"। খুবই যথার্থ বাণী! যখন দেখি একজন শিক্ষক তার দায়িত্ব বা কর্তব্য ভুলে গিয়ে পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ হয়ে যান তখন একজন শিক্ষকের জন্য তার থেকে অশোভন আর কী হতে পারে!
একদিকে জ্ঞান বিতরণের ক্ষেত্র বাড়ানোর প্ল্যাটফর্ম যা কিনা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ভূমিকা পালন করছে সেটা কতিপয় শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠানের সঠিক কর্মকাণ্ডের অভাবে বন্ধ হতে যাচ্ছে আবার অন্যদিকে যা কিনা শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষার গুণগত মান কমিয়ে দিচ্ছে সেটার দিকে অপেক্ষাকৃত কম মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। বিষয়গুলো আমাদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ এবং পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
লেখক : শিক্ষক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]
এইচআর/পিআর