ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

জয় বাংলা : বাঙালির জয়মন্ত্র

শান্তা মারিয়া | প্রকাশিত: ১০:১৭ এএম, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯

আমার বিদেশি ছাত্রটি যখন ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে বলে ওঠে ‘জয় বাংলা’ তখন আনন্দে ভরে যায় মন। মনে পড়ে সেদিনের কথা যখন চীনের মহাপ্রাচীরে হাজার ধাপ সিঁড়ি ভেঙে উঠি। সেখানে উঠে জিন্স আর টিশার্টের উপর গায়ে জড়িয়ে নেই লাল-সবুজ শাড়ি। হাতে ছিল প্রিয় পতাকা, সবুজের বুকে লাল বৃত্ত। বাংলাদেশের সেই পতাকা হাতে বলে উঠি জয় বাংলা।

সুদূর কুনমিংয়ে আমার ক্লাসে বিদেশি ছেলেমেয়েদের কণ্ঠে শুনি এক মোহময় সংগীত। ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’।নিজের অজান্তেই চোখ সজল হয়ে ওঠে। এই সেই প্রাণপ্রিয় সংগীত, যে সংগীত প্রচারিত হতো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। যে সংগীত শুনে রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া মায়ের অতি আদরের কিশোর ছেলেটি সাহসে বুক বাঁধতো শত্রু দমনে। যে সংগীত শুনে আশ্রয় শিবিরের শত কষ্টের ভিতরেও আশার দীপ জ্বেলে রাখতো লাখো বাঙালি। জয় বাংলা—কি মধুর উচ্চারণ।বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে, মুক্তিপ্রিয় সকল বাঙালির কাছে এ শব্দ অতি পবিত্র।

যুদ্ধক্ষেত্রে বাঙালির কণ্ঠে জয় বাংলা শব্দ শুনলেই আতংকিত হতো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পিশাচরা। জয় বাংলা শুধু একটি স্লোগান নয়, এটি বাঙালির জয়মন্ত্র। এই স্লোগানের মধ্যে সুপ্ত রয়েছে বাঙালির চার হাজার বছরের ইতিহাস।বাঙালি জাতি প্রাচীন কালে দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তিশালী সমুদ্র অভিযাত্রী জাতি হিসেবে পরিচিত ছিল। শ্রী বিজয়া সভ্যতা ছিল বাঙালি প্রতিষ্ঠিত সভ্যতা। লাকলোং এর নেতৃত্বে ভিয়েতনামে এবং বিজয় সিংহের নেতৃত্বে শ্রীলংকায় স্থাপিত হয়েছিল বাঙালির রাজ্য। জয় বাংলা স্লোগানে আমি সেই রাজ্যকে দেখতে পাই।সে সময় শৌর্যে অপরাজেয় বাঙালি জাতিকে সমীহ করেছিলেন গ্রিক বীর আলেকজান্ডারও। গ্রিক ঐতিহাসিকরা বাঙালির রাজ্যকে নাম দিয়েছিল গঙ্গারিডাই ও প্রাসি। আমি দেখতে পাই সেই প্রাচীন জনপদের প্রকৃতিপুঞ্জকে, জনজীবনের প্রাত্যহিক স্নিগ্ধতাকে।

আমি যখন এই স্লোগানটি শুনি তখন আমার চোখে ভেসে ওঠে নন্দ বংশের মহারাজ মহাপদ্ম নন্দর মুখ। তিনি ছিলেন নন্দ বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট। নন্দ বংশের রাজারা ছিলেন বাঙালি। নন্দ সাম্রাজ্য ছিল বাঙালির ইতিহাসে গৌরবের যুগ। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে বাংলাসহ সমগ্র উত্তর ভারতে ছিল বাঙালির প্রাধান্য। নন্দ রাজারা দক্ষিণ ভারতও জয় করেছিলেন।

জয় বাংলা ধ্বনিতে আমার চোখে ভেসে ওঠে পুণ্ড্রবর্ধনের মহানগর, অঙ্গ, বঙ্গ, গৌড়, সুহ্ম, সমতট, রাঢ়, হরিকেলনিবাসী জনগণের জীবন। দেখতে পাই চন্দ্রদ্বীপবাসী গুরু মীননাথকে। শুনতে পাই চর্যাপদের সান্ধ্যভাষা। ভুসুকু, কাহ্নপা, চর্যপদের বাঙালি কবিদের। শশাংক, গোপাল, মহীপাল, দেবপাল, ধর্মপালের মতো শক্তিমান রাজনদের বজ্রস্বর ভেসে আসে জয় বাংলায়। মহাস্থানগড়ের প্রাচীন শিলালিপিতে, পোড়ামাটির ফলকে উৎকীর্ণ শিল্প যেন মূর্ত হয়ে ওঠে। ধীমান পালের শিল্পকর্মে যেন লেখা আছে এই জয়ধ্বনি।

জয় বাংলা শব্দে মিশে যায় আলাওল, চণ্ডীদাস, কাশীদাস, মুকুন্দরাম, আব্দুল হাকিম, ভারতচন্দ্র, শাহ গরীবুল্লাহ, চন্দ্রাবতী, ময়মনসিংহ গীতিকার মধুর উচ্চারণ। জয় বাংলায় মিশে আছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, লালন সাঁই। বাংলার সবুজ, করুণ প্রকৃতি তার সবটুকু স্নেহ নিয়ে ফুটে ওঠে জয় বাংলায়। পদ্মা, মেঘনা, যমুনার কল্লোলে আপনি কি জয় বাংলা ধ্বনি শুনতে পান না?

জয় বাংলা উচ্চারণের মধ্যে আপনি কি সালাম, রফিক, বরকতসহ সকল ভাষাশহীদকে দেখতে পান না? আমি দেখতে পাই। দেখতে পাই শহীদ মিনার ও অগণিত ভাষা সৈনিকের প্রদীপ্ত অবয়ব।
জয় বাংলায় কি চোখে ভেসে ওঠে না শহীদ আসাদের রক্তমাখা শার্ট?

ঊনসত্তরের গণ জোয়ারের শিহরণ জাগে না?
জয় বাংলা শব্দে আমি দেখতে পাই বীরশ্রেষ্ঠ, বীরপ্রতীক বীরবিক্রমদের। দেখতে পাই বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের। জয় বাংলায় মিশে আছেন শহীদ বুদ্ধিজীবীরা। মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার, আলীম চৌধুরী, মফাজজল হায়দার চৌধুরী, সিরাজুদ্দীন হোসেন, আলতাফ মাহমুদ, গোবিন্দচন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ধীরেন দত্ত, সেলিনা পারভীনসহ সকল শহীদ বুদ্ধিজীবীর কণ্ঠস্বর শুনি জয় বাংলায়।দেখতে পাই স্মৃতিসৌধ, অপরাজেয় বাংলা।

জয় বাংলা ধ্বনিত হলেই কানে গুঞ্জরিত হয় ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে জয় বাংলা শোনার সঙ্গে সঙ্গে কি আপনি শিহরিত হন না?

জয় বাংলা বাঙালির মুক্তির দীর্ঘ ইতিহাসকে ধারণ করে। জয় বাংলা শ্লোগান বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাণশক্তিকে ধারণ করে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধারণ করে, ধারণ করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের। ধারণ করে একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার বাঙালি নারীদের অনমনীয় মনোবলকে, যারা নির্যাতনে শহীদ হয়েছেন তবু শত্রুর সঙ্গে আপোস করেননি। জয় বাংলা ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়কে। তাই জয় বাংলা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিজয়। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের বিজয় গাথার শিরোনামবাচক শব্দগুচ্ছ হলো জয় বাংলা।

লেখক : কবি, সাংবাদিক, শিক্ষক। বর্তমানে চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন।

এইচআর/জেআইএম