বিক্ষোভে অশান্ত ভারত, আমরাও উদ্বিগ্ন
১২ ডিসেম্বর নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর থেকে ভারতের প্রায় সর্বত্র আগুন জ্বলছে। আগুন জ্বলছে ট্রেন বাস ও রাজপথে। বিশেষ করে আগুন জ্বলছে নাগরিকত্ব আইনের সম্ভাব্য প্রয়োগে যেসব রাজ্যের নাগরিকদের অধিকার হারানোর আশংকা আছে সেসব রাজ্যে আগুনের প্রজ্বলন মানুষের স্বাভাবিক মানসিকতা ছাপিয়ে রাজপথ পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। তাই আগুন জ্বলছে বাসে, ট্রেনে এমনকি দমকল বাহিনীর গাড়িতেও। শোনা গেছে অ্যাম্বুলেন্সও অগ্নিসংযোগ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। অর্থাৎ বলা যেতে পারে ভারতজুড়েই অশান্তি ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে বিগত কয়েক দিনে যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
আসামে পুলিশের গুলিতে নিহতের ঘটনা ঘটলেও অন্যান্য অনেক স্থানেই পুলিশ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে তেমন বাধা দিচ্ছে না। তবু কোথাও কোথাও পুলিশি আক্রমণ ঘটলে সেখানে বিক্ষোভের আগুন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। লোকসভায় পাস হয়ে যাবার পর নাগরিকত্বের বিলে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মাধ্যমে তা এখন আইনে পরিণত হওয়ায় সাধারণের মধ্যে এই উত্তেজনা ও বিক্ষোভ। ভারতেরই অনেকগুলো রাজ্য এরূপ নাগরিকত্ব বিল বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিল দীর্ঘদিন থেকেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজেপির রাজনৈতিক আকাঙ্খা পূরণের জন্য বিলটি পাস করা হয়। আর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর সংশ্লিষ্ট রাজ্য এখন এই আইনের আওতায় চলে আসায় সাধারণের মধ্যে অসন্তোষ যেমন তীব্রতর হয়েছে তেমনি তীব্রতর হয়েছে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের রাজ্য সরকারগুলো বিরোধিতাও।
আগামীতে যেসব রাজ্য এনআরসির আওতায় আসবে সেখানেও এই উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। তারা এখনো ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে ‘নো এন আরসি, নো ক্যাব’। এনআরসির বিরুদ্ধে মমতা ব্যানার্জির অবস্থান স্পষ্ট। তার বক্তব্যও স্পষ্ট- তিনি বলেছেন পশ্চিমবঙ্গে কোনো এনআরসি হবে না। আবার পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি নেতা দিলিপ ঘোষও ঘোষণা করেছেন পশ্চিমবঙ্গেই সর্বপ্রথম এনআরসি কার্যকর করা হবে। তিনি মমতাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, এর আগে মমতা ৩৭০ ধারা বাতিল এবং নোট বাতিলের মতো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেও বিজেপির কাছে হেরে গেছেন এবারে এনআরসি নিয়েও মমতা বিজেপির হেরে যাবেন। তার মতে পশ্চিমবঙ্গই হবে এনআরসি চালু হওয়া ভারতের প্রথম রাজ্য।
এসব রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই ১৪ ডিসেম্বর সমগ্র ভারত জুড়েই আমরা দেখতে পেলাম অশান্তির আগুন। পশ্চিমবঙ্গেই পাঁচটি ট্রেন ও ১৫টি বাসে আগুন লাগানোর মতো ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভকারীদের আন্দোলনের ফলে বেশ কয়েকটি ট্রেন নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি। এক ধরনের আতংকও ছড়িয়ে পড়েছে যাত্রীদের মধ্যে। আতংক ছড়িয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যেও। মমতা ব্যানার্জি আন্দোলনকারীদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে পরিস্কার বলে দিয়েছেন কোনোরূপ সহিংসতাকে বরদাস্ত করা হবে না। তিনি বিক্ষোভকারীদের অনুরোধ করে বলেছেন, দয়া করে রেল ও সড়কপথ বন্ধ করবেন না। যারা সাধারণ মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টি করছেন, অগ্নিসংযোগ করছেন, জনগণের সম্পদ নষ্ট করছেন তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনার সতর্কবার্তাও দিয়েছেন তিনি। কিন্তু বিক্ষোভ থামছে না। বরং বিক্ষোভের বাতাসে উত্তেজনার আগুন ছড়িয়ে পড়ছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে অন্যান্য অনেক রাজ্যে।
আসামের অবস্থা আরো সংকাটাপন্ন। সেখানে নিয়মিত কারফিউ জারি করতে হয়েছে, ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ত্রিপুরা রাজ্যেও অস্থিরতা ও উত্তেজনা বিরাজ করছে। মমতার নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস নাগরিকত্ব আইন বাস্তবায়ন প্রতিরোধে পুরো মাস জুড়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করবে বলেও ঘোষণা রয়েছে। সংশোধিত আইনে ১৯৫৫ সালের ভারতীয় নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে যাওয়া হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ. জৈন, পারসিসহ অমুসলিম অবৈধ অভিবাসীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা আছে। মুসলমানদেরকে সেখানে সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
নাগরিকত্ব সংশোধিত আইন পাসের পর থেকে ভারতজুড়ে অস্থির উত্তেজনা শুরু হয়েছে। এই উত্তেজনার কারণে জাপনের প্রধানমন্ত্রী তার আসন্ন ভারত সফর বাতিল করেছেন। বাংলাদেশের দুজন মন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় সফরও ভারতের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে বাতিল হয়ে গেছে। অশান্ত ভারতের সার্বিক বিষয় সম্পর্কে পর্যাপ্ত পরিমাণ সচেতন ও সতর্কতার সঙ্গে অবস্থান করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য তাদের নাগরিকদেরকে নির্দেশ দিয়েছে। উপরন্তু, সকল নাগরিককে পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত আসাম ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছে। হঠাৎ অশান্ত হয়ে ওঠা ভারতের পরিস্থিতি আগামী কয়েক দিনে কোন দিকে মোড় নিবে তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন বিভিন্ন মহলের বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ।
বিশ্লেষকগণ উদ্বিগ্নতার সাথে ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে যেমন ভাবতে শুরু করেছেন তেমনি ভাবতে শুরু করেছেন দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সম্ভাব্য নতুন নতুন সংকট নিয়েও। জোর করে অমানবিক এনআরসির বাস্তবায়ন একদিকে ভারতবর্ষের সামগ্রিক বৈচিত্র্যপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে সৃষ্ট মহাজাতীয়তাবাদের ওপর যেমন আঘাত হেনেছে তেমনি তার অন্তর্গত সৌন্দর্যকেও ক্ষত বিক্ষত করেছে। বিতর্কিত নাগরিকত্ব বিল নিয়ে উত্তাল ভারতের রাজনীতি আরেক নতুন দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে কংগ্রেসের ‘ভারত বাঁচাও’ নামক আন্দোলন কর্মসূচির কারণে।
ভারতের অর্থনৈতিক দুরাবস্থা, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন, কৃষকের দুরবস্থা, কর্মসংস্থানের সংকটসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ১৪ ডিসেম্বর সমাবেশের ডাক দেয়। রাজধানী দিল্লির এই সমাবেশে সোনিয়া গান্ধী, মনমোহন সিং, রাহুল গান্ধীসহ দলের শীর্ষনেতারা অংশ নেন। এখানে সোনিয়া গান্ধী বিজেপির দিকে ইংগিত করে বলেন তারা ভারতের হৃদয়কে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে। রাহুল গান্ধী অভিযোগ করেছেন বিজেপি ভারতের ঐক্য বিনষ্ট করেছে। কংগ্রেসের বিদেশি শাখাগুলোও বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভ প্রদর্শনের মাধ্যমে ‘ভারত বাঁচাও’ কর্মসূচি সফলের ঘোষণা দিয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক মুখপাত্র জেরেমি লরেন্স এক ব্রিফিং এ বলেছেন, ‘ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইনটি মৌলিক চরিত্রের দিক দিয়েই বৈষম্যমূলক। এবং এ বিষয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।
আমরা জানি যে, এই আইনের বৈধতা ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে এবং আমরা আশা করি মানবাধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনে ভারতের যে দায়বদ্ধতা রয়েছে আদালত তা বিবেচনায় নিয়ে নাগরিকত্ব আইনটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।’ নতুন এনআরসির ফলে সৃষ্ট সংকট থেকে উত্তরণে ভারতের পক্ষেও সহজে সম্ভব হবে না। সাধারণের মধ্যে যে অসন্তোষের আগুন জ্বলে উঠেছে তা নিবারণ কিংবা মানুষের মনের ভেতরকার ক্ষত শুকাতে অনেক সময় লেগে যাবে সন্দেহ নেই। কারণ এই একটিমাত্র আইনের কারণে অসংখ্য মানুষ নিজ দেশে ‘পরাশ্রয়ী’ কিংবা ‘উদ্বাস্তু’ পরিচয়ের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। উদ্বাস্তুর এই পরিচয় অনেক কষ্টের, শিকড়হীন হয়ে পড়বার যন্ত্রণার ক্ষত অনেক গভীরতর হয়। সে ক্ষতের কষ্ট দুর্বিষহ।
আমরা যদি ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করি তবে দেখতে পাবো যে, ভারতের প্রায় সকল ধরনের সংকটই বাংলাদেশকে স্পর্শ না করে ছাড়ে না। ভারতের বর্তমান চলমান অস্থিরতার ঢেউ থেকে বাংলাদেশ মুক্ত থাকতে পারবে কি না সেটাও বড় ধরনের চিন্তার বিষয়। আর এনআরসি নিয়ে যে বাঙালি ও মুসলমান জনগোষ্ঠীর যে উৎকণ্ঠা আছে তা বাংলাদেশকে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত কিংবা সম্পৃক্ত করবেই। ভারতের সেই জ্বলন্ত আগুনের উত্তাপ বাংলাদেশকে কীভাবে জর্জরিত করবে সে বিষয়ে বিশ্লেষকদের যেমন চৌকস ও বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন তেমনি রাজনৈতিকভাবেও দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ প্রয়োজন। দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, শান্তি, শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্য অনেকাংশেই ভারতের শুভ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। সকল প্রকার শুভশক্তির ও শুভচিন্তার জয় হোক এই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/এমএস