প্রসঙ্গ ভারতীয় ভিসা
গত শতাব্দীর শেষ দিকের ঘটনা। ১৯৯৭ সাল সম্ভবত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন ক্ষমতায়। ঢাকার বিস (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিস) মিলনায়তনে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের মিডিয়া নিয়ে একটি আলোচনা ছিল। অনুষ্ঠানে অধিকাংশ সাংবাদিক ভারত-পাকিস্তান সফর করতে গিয়ে যে ভিসা জটিলতায় পড়েছেন তার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
তখন ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের প্রেস অ্যান্ড কালচারাল উইং প্রধান ছিলেন রীভা গাঙ্গুলী দাশ, বর্তমান যিনি হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অনুষ্ঠানের শেষ দিকে তার জবাবদানের পালা আসে। তিনি সরাসরি জবাব না দিয়ে কূটনৈতিক বুদ্ধি প্রয়োগ করেন।
তিনি বলেন, এখানে আনিস আলমগীর উপস্থিত আছে। আমি তার মুখে শুনতে চাই, সর্বশেষ সে যখন আমাদের ভিসা নিতে গিয়েছিল তখন কতক্ষণ লেগেছে- এক ঘণ্টা নাকি আধা ঘণ্টা?
ভারতীয় ভিসা পেতে সাংবাদিকদের যে সমস্যা হয় না, এটা অসত্য নয়। কিন্তু আমাকেও সত্যের পক্ষে গিয়ে বলতে হলো, আধা ঘণ্টা লেগেছিল। সত্যই আধা ঘণ্টা লেগেছিল সেদিন। রীভা গাঙ্গুলীর রুমে বসে চা খেতে খেতে পাসপোর্ট পাঠিয়ে ভিসা লাগিয়ে আমার হাতে আসতে লেগেছিল আধা ঘণ্টাই। তখন হাইকমিশন ধানমন্ডিতে ছিল। অ্যানালগ কাজ-কারবার ছিল। এখনও আমি বিশ্বাস করি, হাইকমিশনের লোকজন দায়িত্ব নিলে দিনে দিনেই ভিসা পাওয়া কঠিন নয়।
যাক, সে অনুষ্ঠান শেষে কয়েকজন আমাকে বলল, ‘ভারতীয় দালাল। ভিসার জন্য এখন থেকে তোমাকে বলব।’ ভারতীয় হাইকমিশনের ভিসা আসলে তখনও সহজ ছিল না, সাংবাদিকদের জন্য। অনেককে শুনেছি কালো তালিকাভুক্ত করতে। ভারত ভিসা দিত না ইনকিলাবসহ কিছু পত্রিকার সাংবাদিকদের। ভারতের না দেয়ার পক্ষে যুক্তিও ছিল। সেই সময় ইনকিলাবের মতো বাংলাদেশের কয়েকটি মিডিয়া আজান দিয়ে ভারত বিরোধিতা করত। যুক্তি ছাড়া, লাগাম ছাড়া লেখা। ভারতকে বিবেচনা করত শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে।
এমনকি আমরা যারা দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়ন নিয়ে, ট্রানজিট দেয়া, বন্দর ব্যবহার করতে দেয়া, ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন, বাণিজ্য বৃদ্ধির পক্ষে লিখতাম তাদের ওইসব মিডিয়া ভারতীয় দালাল বলত। বাস্তবতা হচ্ছে আজ শেখ হাসিনার এই আমলে এসে এর সবই বাস্তবায়িত হয়েছে এবং দুই দেশের সম্পর্ক এখন সর্বোচ্চমাত্রায় সম্প্রীতির মধ্যে আছে। ছিটমহল বিনিময়, সীমান্ত চিহ্নিতকরণসহ অনেকগুলো দ্বিপাক্ষিক সমস্যা সমাধান হয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, সাংবাদিকদের ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তানও তাই করত। যেমন আমার প্রথম পাকিস্তান সফরের ভিসা ঢাকা থেকে সংগ্রহ করতে পারিনি, নিয়েছিলাম নতুন দিল্লি থেকে। কারণ পাকিস্তান হাইকমিশন তখন আজকের কাগজ, জনকণ্ঠ এমন কিছু পত্রিকার সাংবাদিকদের ভিসা দিত না।
অবশ্য পাকিস্তান পরবর্তীতে আজকের কাগজের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছিল খোলাখুলি আলাপের পর। তাদের যুক্তি ছিল আজকের কাগজ পাকিস্তানবিরোধী। আমি তাদের প্রমাণ দিতে বলায় তারা এমন কিছু বিষয় তুলে ধরেছিল, যেগুলো ছিল ১৯৭১ সংশ্লিষ্ট। আমি তাদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে একাত্তর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌবরগাঁথা ইতিহাসের অধ্যায়, পাকিস্তানকে এখানে ছাড় দেয়ার কিছু নেই। আমরা যখন একাত্তরের কথা বলি, তখন পাকিস্তানের নিন্দার কথা আসবেই। কারণ আমাদের যুদ্ধটা হয়েছিল পাকিস্তানের সঙ্গে। এখানে আমরা আমাদের ইতিহাসকে তুলে ধরি, হয়তো তোমরা তার সঙ্গে একমত নও। তোমাদের দেখাতে হবে আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, তার অস্তিত্বের বিরুদ্ধে কিছু লিখছি কিনা। আমার এই যুক্তির বিরুদ্ধে তারা কোনো অজুহাত দাঁড় করাতে পারেনি।
যাক, ভারতের ভিসার ক্ষেত্র এখন অনেক বিস্তৃত হয়েছে। বাংলাদেশে যত বড় ভিসাকেন্দ্র ভারত স্থাপন করছে সেটা তারা অন্য কোনো দেশে করেনি। অত্যন্ত আধুনিক পদ্ধতিতে ঝামেলাহীনভাবে বাংলাদেশিরা এখন ভিসা সংগ্রহ করে। প্রচুরসংখ্যক বাংলাদেশি ভারতে সফর করে প্রতি বছর।
সাম্প্রতিক মিডিয়ায় খবর হয়েছে, ভারতে প্রতি পাঁচজন বিদেশি পর্যটকের একজনই বাংলাদেশি। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিন বছরে প্রায় দুই কোটি ৯৪ লাখ বিদেশি পর্যটক ভারত সফর করেছে। তাদের মধ্যে বাংলাদেশি পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৫৮ লাখ। এ সংখ্যা ভারত সফরকারী বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ভারতে পর্যটকদের উৎস দেশের তালিকায় বাংলাদেশের পরই আছে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, শ্রীলঙ্কা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, চীন, জার্মানি ও রাশিয়া। পর্যটক ভিসার পাশাপাশি অন্যান্য ক্যাটাগরির ভিসা যোগ করলে বাংলাদেশ থেকে ভারতে সফরকারীর সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে। ভারতের লোকসভায় উত্থাপিত এক পরিসংখ্যানে এ তথ্য দেয়া হয়েছে।
২০১৭ সালে বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশন ১৩ লাখ ৮০ হাজার ভিসা ইস্যু করেছে। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৭০ হাজারে। বর্তমানে সারাবিশ্বের মধ্যে ভারতের সবচেয়ে বড় ভিসা আবেদন কেন্দ্র বাংলাদেশে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দীর্ঘমেয়াদি ও ‘মাল্টিপল এন্ট্রি’ ভিসা ইস্যু করা হয়। ফলে একই ভিসা নিয়ে একাধিকবার ভারতে যাতায়াত করা যায়। এছাড়া ভারতে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বন্দর ব্যবহারের যে বিধি-নিষেধ ছিল তাও পর্যায়ক্রমে উঠে যাচ্ছে।
তবে শিল্পী-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের কাউকে কাউকে ভিসা না দেয়ার ব্যাপারটি প্রায় পত্রিকায় আসে। আমার মনে হয়, যারা ভিসার ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করে তাদের চিন্তায় গলদ আছে, যেমনটা আমি পাকিস্তানের ক্ষেত্রে বলেছি। রাষ্ট্র হিসেবে কেউ ভারত বিরোধিতা করে নাকি ভারত সরকারে কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে সেটা দেখতে হবে।
বাংলাদেশে এখন উঠেপড়ে ভারত বিরোধিতা করার লোক সংখ্যা কমে গেছে। যেটা বেশি দেখা যায় সেটা হচ্ছে- মোদি-অমিত শাহ জুটির কিছু উদ্ভট এবং সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা হচ্ছে। আমি নিজেও যে ভারতরাষ্ট্র দেখে বড় হয়েছি, ভারত সফর করে দেখেছি- সেটি বর্তমানের ভারত নয়। আমার ভারতীয় অনেক বন্ধুও তাদের সরকারি সিদ্ধান্তগুলো, বিশেষ করে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানের যে চেষ্টা হচ্ছে, তাতে লজ্জা প্রকাশ করছেন। কোনো বিবেকবান মানুষ মোদি-অমিত শাহের সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড সমর্থন করতে পারে না। আমিও করি না।
এখন ভারতীয় হাইকমিশন যদি মোদির নীতির বিরোধী কাউকে ভারতবিরোধী বানায় এবং তার ভিসাজটিলতা তৈরি করে সেটা হাইকমিশনের দীনতা। মোদি এবং ভারত সমার্থক নয়। মোদি অস্থায়ী। আগামী নির্বাচনে তার অস্তিত্ব থাকবে কিনা সন্দেহ কিন্তু ভারত স্থায়ী। ভারত-বাংলাদেশও প্রতিবেশী হিসেবে স্থায়ী।
এর মধ্যে আরেকটি খবর এখন সোশ্যাল মিডিয়া, প্রধান মিডিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। প্রথম এটি বিবিসি বাংলায় আসে। এরপর দ্য হিন্দু রিপোর্ট করলে বাংলাদেশের সিংহভাগ মিডিয়ায় উঠে আসে। খবরে বলা হয়েছে, ভারতের নতুন ভিসানীতিতে নির্ধারিত মেয়াদের বেশি সময় ভারতে থাকার সাজা হিসেবে বাংলাদেশের মুসলিম নাগরিকদের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের তুলনায় অন্তত ২০০ গুণ বেশি জরিমানা গুনতে হচ্ছে। বছরখানেক আগে প্রথম ওই ভিসানীতি চালু করে ভারত। এই জরিমানার কাঠামো স্পষ্টই ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য সৃষ্টি করা। সাম্প্রদায়িতা ছড়ানোর ক্ষেত্রে উৎসাহ দান।
নিয়মানুসারে, ‘বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী’র জন্য ভিসা মেয়াদের অতিরিক্ত সময় ভারতে অবস্থান করার জরিমানা দুই বছরের বেশি সময়ের জন্য ৫০০ ভারতীয় রুপি, ৯১ দিন থেকে দুই বছর পর্যন্ত ২০০ রুপি এবং ৯০ দিন পর্যন্ত সময়ের জন্য ১০০ রুপি। অন্যদিকে ভিসার মেয়াদের বেশি সময় অবস্থান করা ব্যক্তিটি যদি ‘সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী’র সদস্য না হন (সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী বলতে সেখানে মুসলিম বাদে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীদের বোঝানো হয়েছে), তখন জরিমানার অর্থ হিসাব করা হচ্ছে রুপির বদলে মার্কিন ডলারে। এক্ষেত্রে দুই বছরের বেশি সময়ের জন্য ৫০০ ডলার (৩৫ হাজার রুপি), ৯১ দিন থেকে দুই বছর পর্যন্ত ৪০০ ডলার (২৮ হাজার রুপি) এবং ৯০ দিন পর্যন্ত সময়ের জন্য ৩০০ ডলার (২১ হাজার রুপি) জরিমানা গুনতে হচ্ছে।
আরও সহজ করে বললে, ভারত সফরে গিয়ে ভিসা শেষ হয়ে যাওয়ায় ২১ হাজার রুপি জরিমানা দিতে হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সদস্য সাইফ হাসানকে। তার ক্ষেত্রে লিটন দাস হলে জরিমানা লাগত ১০০ রুপি। সম্প্রতি একজন দরিদ্র বাংলাদেশি নারীকে এমন ঘটনায় দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে হয়েছিল। তিনি ভিসার মেয়াদের চেয়ে একদিন বেশি থেকেছিলেন। তাই তাকে ২১ হাজার রুপি দিতে বলা হয়েছিল। তার কাছে এত অর্থ না থাকায় কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশন টাকা তুলে তাকে ফেরত পাঠিয়েছে।
ধর্মের ওপর ভিত্তি করে কেন এমন বৈষম্য হবে? বাংলাদেশের উচিত অবিলম্বে এই বৈষম্যের প্রতিবাদ জানানো এবং এই নীতি প্রত্যাহারের দাবি জানানো। ভিসাদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশেই পরস্পরের প্রতি আরও বেশি উদার হবে, হয়রানি বন্ধ করবে, ভিন্নমতের মানুষদের প্রতি সহনশীল হবে আশা করি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]
এইচআর/বিএ/জেআইএম