ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

অজয় রায়ের শূন্যতা সহজে পূরণ হবে না

বিভুরঞ্জন সরকার | প্রকাশিত: ০৯:৫৯ এএম, ১০ ডিসেম্বর ২০১৯

অধ্যাপক ড. অজয় রায় দুই সপ্তাহ বারডেম হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করে শেষপর্যন্ত পরাজিত হয়েছেন। গত ২৫ নভেম্বর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন গতকাল সোমবার (৯ ডিসেম্বর) দুপুরে। অজয় রায়ের এই চলে যাওয়া আমাদের বিষাদ-আক্রান্ত করেছে। তার সঙ্গে যাদের সামান্য পরিচয় ছিল, তারাই জানেন কী অসাধারণ মানবিক গুণসম্পন্ন একজন মানুষ ছিলেন তিনি।

বলা হয়ে থাকে, এক জীবনে মানুষ অনেক কিছু করতে পারে না। অজয় রায় ছিলেন তার উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি তার জীবনকে কাজের জন্যই নিবেদন করেছিলেন। একনিষ্ঠ এই কর্মসাধকের চলে যাওয়া যে শূন্যতা তৈরি করল, তা প্রকৃতপক্ষেই পূরণ করা সহজ হবে না। তার মতো মেধা ও মনন নিয়ে বহু মানুষের জন্ম হয় না। তার মতো মানুষ সংখ্যায় অল্প হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে এমন আলোকরশ্মি থাকে যা বহু মানুষকে আলোকিত করে, অন্ধকার থেকে আলোর পথে যেতে অনুপ্রাণিত করে। আলোর পথযাত্রী অজয় রায়ের মৃত্যু তাই আমাদের সামনে কিছুটা কালোরঙ ছিটিয়ে দিল।

তার জন্ম ১ মার্চ, ১৯৩৫ সাল। সে হিসাবে ৮৪ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া কাটালেন। মোটামুটি দীর্ঘজীবনই পেয়েছিলেন বলা যায়। সারাটা জীবন তিনি মানুষের জন্য কাজ করেছেন। কী করলে, কোন পথে চললে মানুষের জীবন অর্থবহ হবে, তার সন্ধান নিজে করেছেন, অন্যদেরও মানুষের সঙ্গী হতে প্রেরণা দিয়েছেন। মানবতাকে যখনই বিপন্ন হতে দেখেছেন, মানুষকে অধিকারবঞ্চিত হতে দেখেছেন, সেখানেই তিনি ছুটে গেছেন। তার জীবনের মন্ত্র ছিল : মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই, নহে কিছু মহীয়ান।

অজয় রায় অধ্যাপনাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৫৯ সাল থেকে শুরু করে ২০০০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। বিজ্ঞানের শিক্ষক, তাই ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক। কার্যকারণ সম্পর্ক দিয়েই পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করতেন। কুসংস্কার, কূপমণ্ডুকতাকে ঘৃণা করতেন। তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী এবং মননশীল। পরিচিতি পেয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে। ২০১২ সালে একুশে পদকও পেয়েছেন পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য।

মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের সব গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল আন্দোলনে অজয় রায়ের অংশগ্রহণ ছিল প্রত্যক্ষ। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সম্মানিত সদস্য ছিলেন। তাছাড়া তিনি কলকাতায় বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশেও নানা ধরনের সমিতি-সংগঠনের সঙ্গে তিনি নিজেকে জড়িত রেখে কর্মব্যস্ত থাকতে পছন্দ করতেন। স্থবিরতা নয়, চলমানতাই ছিল তার জীবনদর্শন। এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ, সম্প্রীতি মঞ্চসহ বিভিন্ন সংগঠনে তিনি দায়িত্বপূর্ণ পদাধিকারী ছিলেন।

জীবনের পড়ন্তবেলায় এসেও তিনি ক্লান্তিহীনভাবে এমন সব কাজে নিজেকে জড়িয়েছেন, যেগুলো তার জীবনের জন্যও ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের খবর শুনলে তিনি ছুটে যেতেন, নিগৃহীত বিপন্ন মানুষের পাশে সহায় হয়ে দাঁড়াতেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার শুরু হলে অজয় রায় সমমনাদের সঙ্গে নিয়ে ‘সংখ্যালঘু নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিদেশে অবস্থানরত তার প্রাক্তন ছাত্রদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে ঘরবাড়ি হারানো, সম্ভ্রম হারানো অনেক নারী-পুরুষের মাথাগোঁজার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি।

২০১৫ সালে অজয় রায়ের জীবনে ঘটে একটি চরম দুঃখ ও বেদনার ঘটনা। তার বড় ছেলে ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়কে ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি বইমেলার কাছে কুপিয়ে হত্যা করে কয়েকজন জঙ্গি-দুর্বৃত্ত। প্রিয় সন্তান অভিজিতের এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে অজয় রায়ের মতো উন্নত শির, দৃঢ়চেতা মানুষকেও মানসিকভাবে ভেঙেচুরে তছনছ করে দিয়েছিল। তিনি পুত্রহত্যার বিচার দাবি করে নিষ্ক্রিয় বসে না থাকে জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠনে ভূমিকা পালন করেছেন। পরিতাপের বিষয়, তিনি পুত্রহত্যার বিচার দেখে যেতে পারলেন না।

অজয় রায়ের জন্ম দিনাজপুরে। আমারও বাড়ি বৃহত্তর দিনাজপুরে। দিনাজপুরে থাকতে তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। তবে তার সম্পর্কে জানতাম। ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্র হওয়ায় অজয় রায়ের সঙ্গে পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা হয়। ‘দেশি’ হিসেবে স্যারের কাছে অতিরিক্ত স্নেহ এবং প্রশ্রয় পেয়েছি। স্যার যে কতটা ন্যায়পরায়ণ ছিলেন তা আমরা নিজেরাও নানা ঘটনায় প্রত্যক্ষ করেছি। অন্যায়, অসততাকে তিনি কখনই প্রশ্রয় দিতেন না।

১৯৭৪ সালে জগন্নাথ হলে ছাত্র ইউনিয়ন এবং তৎকালীন ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের মধ্যে বড় ধরনের একটি সংঘর্ষ হয়েছিল। ছাত্র ইউনিয়ন ছিল তখন জগন্নাথ হলে একক বৃহত্তম সংগঠন। ছাত্রলীগের সমর্থক সংখ্যা কম ছিল। ফলে ছাত্রলীগের কর্মীসমর্থকরা ছাত্র ইউনিয়ন সমর্থকদের হাতে বেধড়ক পিটুনি খেয়েছিল। পরে অবশ্য অন্য হল থেকে ছাত্রলীগের মাস্তান বাহিনী এসে ছাত্র ইউনিয়নকে জগন্নাথ হল ছাড়া করেছিল। অজয় রায় ছিলেন তখন জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট। ছাত্রলীগ তার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল ছাত্র ইউনিয়নের কয়েকজন নেতাকে হল ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের সুপারিশপত্রে স্বাক্ষর করার জন্য। কিন্তু অজয় রায় চাপের মুখে পদত্যাগ করলেও বহিষ্কার আদেশে সই করেননি।

কিছু সামাজিক ইস্যুতে স্যারের সঙ্গে একযোগে আমার কিছু কাজ করার সুযোগও হয়েছে। তাকে দিয়ে আমি কিছু কলামও লিখিয়ে নিয়েছি আমার সম্পাদিত পত্রিকার জন্য। স্যার লিখতেনও ভালো। তার নিজের লেখা এবং সম্পাদিত অনেকগুলো বই রয়েছে। ‘বিজ্ঞান ও দর্শন, জড়ের সন্ধানে' এবং ‘আদি বাঙালি, নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ’ তার লেখা বিখ্যাত দুটি বই। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত পাঁচ খণ্ডের বিজ্ঞান কোষ অজয় রায় সম্পাদিত একটি বড় কাজ। পত্রপত্রিকায় সমসাময়িক বিষয় নিয়ে তিনি বেশকিছু কলামও লিখেছেন।

অজয় রায়ের কর্মময় জীবনের অবসান ঘটল। তার জীবন থেকে একটু আলো যদি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিতে পারে তাহলে তার জীবনসাধনা সফল বলে বিবেচিত হবে।

অধ্যাপক অজয় রায়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এইচআর/বিএ/পিআর