রুম্পাকে কেন মরতে হলো?
রুম্পা নামের অর্থ চমৎকার, সুন্দর, প্রশংসনীয়। স্ট্যামফোর্ড বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষার্থী রুম্পার মধ্যে এর সব গুণই ছিল। পুলিশ পিতার স্বল্প আয়ের সংসারের বোঝা কমাতে রুম্পা নামের মেয়েটি দুটি টিউশনি করতো। লেখাপড়ার পাশাপাশি সংসারের হালও ধরেছিল সে। এভাবেই চলছিল নিত্যনৈমিত্তিক জীবন। কিন্তু বিধিবাম হলেন। সুন্দর একটি ফুল পূর্ণ বিকশিত হওয়ার আগেই ঝরে গেল। ঘাতকের নিষ্ঠুর জিঘাংসায় নিভে গেল তার জীবন প্রদীপ।
নিত্যকার মতো টিউশনি করে বাসায় ফিরেছিল সেদিনও। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে নতুন স্যান্ডেল বদলে পুরনো স্যান্ডেল পরে, দুল খুলে রেখে আবার বাইরে চলে গেল। নিশ্চয়ই ফোনে কারো সাথে কথা হয়েছিল কিংবা জরুরিভিত্তিতে তাকে কেউ ডেকেছিল। তা না হলে সে হয়তো বের হতো না সন্ধ্যায়। নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বের হয়েছিল রুম্পা। কী ছিল সেই উদ্দেশ্য? তাকে ডেকে অথবা ফোন করে কেউ ব্ল্যাকমেল করেনি তো?
তার ফোনকল থেকেও অনেক তথ্য উঠে আসতে পারে। হয়তো খুনের আগে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এমনও হতে পারে তাকে ভালোভাবে ডেকে নিয়ে চেতনানাশক খাইয়ে ধর্ষণ করে পরে তাকে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ঘুমের মধ্যেও ধর্ষণ হয় এমন নজির আছে এদেশে। এমনকি মৃতদেহও ধর্ষণ হয়। ৩-৫ বছরের নারীশিশুও ধর্ষণ হয় এমনও ঘটনা আছে। আর এসব অপকর্ম ঢাকতে ভিকটিমকে মেরে ফেলা হয়। স্বামী দ্বারা বহু আগে থেকেই স্ত্রী ধর্ষণ হয়। এসব সত্যকথা শুনলে একশ্রেণির মানুষের গা জ্বালা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু কথা সত্য। যুগেযুগে এত নারী হত্যা কেন? কেন এত নারী শিশুহত্যা?
গত একবছরের হিসাব অনুযায়ী সারাদেশে নারীকে ধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, এসিডে ঝলসে মারা হয়েছে।ধর্ষণ শেষে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। নারীর মৃতদেহ জঙ্গলে, নদীর ধারে ফেলে রাখা হয়েছে। নারী শিশুকে ধর্ষণ করে কেটে টুকরো টুকরো করে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। সবশেষে রুম্পাকে ধর্ষণ এবং ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে গত বুধবার রাত এগারোটার দিকে। কে বা কারা এভাবে নৃশংস হত্যা করল? কেন করলো?
একজন নারী খুন হলে আমাদের সমাজের কিছু মানুষ সেই নারীর দোষগুলো খুঁজতে থাকেন। মুখ বাঁকিয়ে বলতে থাকেন অমুক মেয়ের চলাফেরা ভালো ছিল না, পোশাক ভালো ছিল না। চলাফেরা ভালো না বলতে তারা কী বুঝায়? একজন নারী যার সাথে খারাপভাবে চলে সে কী পুরুষ ছিল না? তবে কেন পুরুষটিকে আড়ালে রেখে শুধু নারীর চলাফেরা নিয়ে কথা তোলা হয়?
মেয়েটির সঙ্গী পুরুষ বলে সে সমাজের চোখে নির্দোষ এবং ভালো থেকে যায়। বদনাম জোটে কেবল মেয়েটির কপালে। প্রেমের সম্পর্কে শিথিলতা আসতেই পারে, তাই বলে কী তাকে হত্যা করতে হবে? কিংবা কোন কারণে কোন বিষয়ে মতবিরোধ হতেই পারে, বনিবনা নাও হতে পারে তাই বলে কী তাকে হত্যা করতে হবে? মানুষ হয়ে এ কেমন মানসিকতা, যে ভালো না লাগলে বা মতের অমিল হলেই তাকে মেরে ফেলতে হবে, হত্যা করতে হবে?
‘হায়দ্রাবাদে চারজন ধর্ষককে পুলিশের এনকাউন্টারে খতম করা হয়েছে’ বাহ! দারুণ খবর বটে! তবে এভাবে কতজন ধর্ষককে মেরে ফেলা যাবে? ধর্ষক সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ওৎ পেতে আছে। বাঙালির উদরপূর্তির মতো নারীও তাদের কাছে সস্তা খাবারের মতো। পথের নেশাখোর টোকাই থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত যে কেউ এ খাবার খেতে অভ্যস্ত।
ধর্ষণ ও নেতিবাচক মনোভাব থেকে মুক্তি পেতে মানুষের উচিত নিজ মনের চর্চা করা। নিজের মনকে পরিচ্ছন্ন ও পরিশুদ্ধ রাখা। বিবেককে জাগ্রত রাখা। সেটি যদি হয় নিজ নিজ ধর্মকে মনেপ্রাণে বুঝে লালন করার মাধ্যমে তাহলেও খুব ভালো। কিন্তু কিছু মানুষ ধর্ম না বুঝে ধর্ম চর্চা না করে বানোয়াট ফতোয়া জারি করে এবং তার বক্তব্য সম্পূর্ণ একপেশে। ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা নারীদের বিপক্ষে কথা বলে। এ সকল মানুষই যুগে যুগে ধর্মকে বিকৃত করছে। এরা যেকোনো ধর্মের জন্যই হুমকিস্বরুপ। যে যেভাবে যে পরিস্থিতিতেই খুন করুক, কিংবা হত্যাকে হালকা করার চেষ্টা করুক, হত্যা হত্যাই। আর খুনি যেই হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। কারণ আইন ও বিচারবহির্ভূত খুন করার অধিকার মানুষের নেই।
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী রুম্পার ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’র ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তার কথিত প্রেমিক আব্দুর রহমান সৈকতকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আদালতে তোলা হলে চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। তবে এখনো হত্যারহস্যের কূলকিনারা হয়নি। আশা করি খুব দ্রুত রুম্পা হত্যার আসল অপরাধী সনাক্ত হবে এবং বিচার হবে। তবে ধর্ষণ বন্ধ করতে হলে এখনই ধর্ষণবিরোধী কঠিন আইন প্রণয়ন করতে হবে সরকারকে। বর্তমানে যে নারী ও শিশু নিরাপত্তা আইন আছে তা দিয়ে ধর্ষণের মতো ক্রিমিনাল অফেন্স থামানো সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের কাছে নাগরিক চায় নিরাপত্তা। অপরাধীর ব্যাপারে জিরো টলারেন্স দেখানো হবে- সেটিও প্রত্যাশা করে মানুষজন।
কোনো ইস্যুতে যেন রুম্পা হত্যা ধামাচাপা না পড়ে সেদিকে নজর দিতে হবে। আর যেন কোন হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে মানুষকে রাস্তায় নামতে না হয়, বিচার চেয়ে চেয়ে মুখে ফেনা তুলতে না হয়। দ্রুত আইনের আওতায় এনে অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে আর কোন রুম্পাকে এভাবে লাশ হতে হবে না।
লেখক : কবি ও শিক্ষক।
এইচআর/পিআর