ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

রুম্পা হত্যার বিচার চাই

প্রভাষ আমিন | প্রকাশিত: ০৯:৩৯ এএম, ০৯ ডিসেম্বর ২০১৯

ফেসবুকে অনেকেই স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী রুবাইয়াত শারমিন রুম্পার লাশের ছবিটি শেয়ার করেছেন। আমি করতে পারিনি। আসলে বেশিক্ষণ আমি ছবিটির দিকে তাকাতেই পারিনি। থ্যাতলানো মুখে রক্ত ওঠা রুম্পার দেহটি পড়েছিল চিৎ হয়ে। পুলিশ এখনও রুম্পা হত্যা রহস্যের কিনারা করতে পারেনি। পুলিশের ধারণা, রুম্পাকে হত্যা করে ওপর থেকে ফেলে দেয়া হয়েছে। অনেকেই সন্দেহ করছেন, ধর্ষণের পর হত্যা করে রুম্পাকে কোনো উঁচু ভবনের ছাদ থেকে ফেলে দেয়া হয়।

বুধবার রাত সোয়া ১০টার দিকে সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় ওপর থেকে কিছু একটা পড়ার শব্দ শুনে আশপাশের ভবনের লোকজন প্রথমে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এ ফোন করেন। পরে সেখান থেকে থানায় বিষয়টি জানানো হয়। যে এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে, সেখানে পাশাপাশি তিনটি ভবনের একটি ১২ তলা, যার চারতলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক, এর ওপরে আবাসিক। বাকি দুটি আবাসিক ভবনের একটি তিনতলা, অন্যটি পাঁচতলা। রুম্পার লাশটি পড়ে ছিল তিনটি ভবনের মাঝখানে। কোন ভবন থেকে লাশটি ফেলা হয়েছে, তা এখনও নিশ্চিত নয় পুলিশ।

তিনটি ভবনের কোনোটিতেই সিসি ক্যামেরা নেই। তাই কোন ভবনটিতে শারমিন ঢুকেছিলেন, তা এখনও জানা যায়নি। তবে পুলিশ সৈকত নামে রুম্পার এক বন্ধুকে গ্রেপ্তার করে চারদিনের রিমান্ডে নিয়েছে। রুম্পার বাবা পুলিশের পরিদর্শক। তাই পুলিশ নিশ্চয়ই তার পরিবারের একজন সদস্যের এই মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার রহস্য উদঘাটনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। কিন্তু তাতে কি আর ফিরে আসবে সংগ্রামী এই মেয়েটি, যে চাকরিজীবী বাবার চাপ কমাতে টিউশনি করতো। দুটি টিউশনি করে বুধবার সন্ধ্যায় শারমিন শান্তিবাগের বাসার নিচে আসেন। ওপরে না উঠে তিনি মুঠোফোনে চাচাতো ভাইকে নিচে নামতে বলেন। তার কাছে আংটি, কানের দুল, মুঠোফোন, ব্যাগ দিয়ে দেন। এরপর পুরোনো এক জোড়া জুতা আনতে বলেন। চাচাতো ভাই জুতা নিয়ে আসার পরে সেই জুতা পরে তিনি চলে যান। আর ফিরে আসেননি রুম্পা। তবে কি তিনি জানতেন, যেখানে যাচ্ছেন, সেখানে তার ঝুঁকি আছে?

কী হয়েছে, তার বিস্তারিত এখনও জানা যায়নি। রুম্পা আত্মহত্যা করেছেন, নাকি তাকে মেরে ওপর থেকে ফেলা দেয়া হয়েছে, নাকি ওপর থেকে ফেলে দেয়ার কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে, নাকি হত্যার আগে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে? অনেক প্রশ্ন। উত্তর নিশ্চয়ই জানা যাবে। কিন্তু রুম্পা আর কখনোই ফিরে আসবে না। এটাই বাস্তবতা এই শহর আমার বোনের জন্য, আমার কন্যার জন্য নিরাপদ নয়।

কদিন আগে এক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ: নারী সাংবাদিকদের নিরাপত্তা’ বিষয়ে কিছু প্রস্তুতিমূলক পরামর্শ দিয়েছেন। তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় হয়েছে। চলুন আরেকবার সেই শিক্ষকের পরামর্শগুলো দেখে আসি। তিনি লিখেছেন, ১. ফ্ল্যাট স্যান্ডেল, জুতো পরিধান, দৌড়াতে সুবিধাজনক। ২. বিয়ের চিহ্নস্বরূপ আংটি অথবা অন্য কিছু পরিধান, ৩. দামী অলঙ্কার পরিহার, ৪. ভেজা চুলে বাইরে যাওয়া যাবে না, কোন কোন সংস্কৃতিতে এটা যৌন সংকেত, ৫. ঝুলানো গলার হার বা অন্য কিছু যা সহজে টান দেয়া যায়, পরিহার, ৬. বুলেট প্রুফ জ্যাকেট যদি প্রয়োজন মনে হয়।

হা হা হা। এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের পরামর্শ শুনে হাসবো না কাঁদবো, বুঝতে পারছি না। এমন মানসিকতার একজন মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলো কী করে। তবে একটা কথা বলতে পারি, তার এই পরামর্শও নারী সাংবাদিক বা নারীদের নিরাপত্তা দিতে পারবে না। রুম্পা নারী সাংবাদিক ছিলেন না। কিন্তু অজান্তেই তিনি সেই শিক্ষকের পরামর্শ মেনে চলেছেন। জুতা বদলে তিনি পুরোনো জুতা পরে নিয়েছিলেন। সাথে মূল্যবান কিছু ছিল না। রুম্পা ভেজা চুলেও বাইরে যাননি। টিউশনি শেষে ক্লান্ত বিধ্বস্ত রুম্পা নিশ্চয়ই কাউকে কোনো যৌন ইঙ্গিতও দেননি। তবুও তিনি বাঁচতে পারেননি।

কদিন আগে ভারতের হায়দরাবাদে প্রিয়াঙ্কা রেড্ডী নামে ২৭ বছর বয়সী এক নারী চিকিৎসককে ধর্ষণের পর পুড়িয়ে মারে চার দুর্বৃত্ত। দিল্লীর নির্ভয়ার মতই; প্রিয়াঙ্কার ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় বিক্ষোভে উত্তাল গোটা ভারত। মানুষের ক্ষোভ প্রশমন করতে অভিযুক্ত চার ধর্ষককেই ক্রসফায়ারে হত্যা করেছে পুলিশ। ক্রসফায়ারের পক্ষে-বিপক্ষে এখন বিভক্ত ভারত। অনেকেই চার অভিযুক্ত ধর্ষকের ক্রসফায়ারে খুশি। বলছেন, এটা ভগবানের বিচার। তবে মানবাধিকার কর্মীরা বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় ক্ষুব্ধ। তারা বলছেন, ক্রসফায়ার হলো বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার প্রমাণ।

এক নারীর ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় পাশের দেশ ভারতে তোলপাড়। আর আমাদের দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় এক নারীর বিয়ে নিয়ে। মিথিলা কেন ভারতে গিয়ে বিয়ে করলো, কেন একজন হিন্দুকে বিয়ে করলো, সৃজিতের মত একটা প্লেবয়কে কেন বিয়ে করলো, বিয়েটা কোন ধর্মমতে হলো, মিথিলা বিয়ে করলো কেন, মেয়ে নিয়েই তো জীবনটা পার করতে পারতো। এমন হাজারটা প্রশ্ন, হাজারটা কৌতূহল। এসব তো ভদ্র প্রশ্ন। এর বিপরীতে কত লাখ অশালীন প্রশ্ন এবং কৌতূহল যে আছে, তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।

দেখতে ভদ্র মানুষের মত হলেও আমাদের ভেতরটা যে কত নোংরা, ফেসবুক মাঝে মাঝে তা প্রকাশ করে দেয়। এর আগে গুলতেকিন খানের বিয়ে নিয়েও আমাদের ফেসবুকবাসীর ব্যাপক কৌতূহল ছিল। এর আগে মিথিলার ছবি নিয়েও তোলপাড় কম হয়নি। আরে ভাই কে কাকে পছন্দ করবে, কাকে বিয়ে করবে; সেটা একান্তই তাদের ব্যাপার। আপনার-আমার সেখানে নাক না গলালেও চলবে। আমি খুবই দুঃখিত, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রীর লাশ পড়ে থাকে রাজধানীর প্রাণ কেন্দ্রে, তাতে আমাদের প্রাণ কাঁদে না। আমরা মেতে থাকি একজনের বিয়ে নিয়ে।

গত কয়েকদিনে মিথিলার বিয়ে নিয়ে ২০টি স্ট্যাটাসের বিপরীতে রুম্পার জন্য হয়তো বরাদ্দ ছিল একটি। প্রিয় ফেসবুকবাসী মিথিলা বিয়ে করেছে; তার নিজের সম্মতি তো আছেই, তার পরিবারেরও সম্মতি আছে। খুশি তার মেয়েও। তাই মিথিলা-সৃজিত দম্পতির জন্য শুভ কামনা ছাড়া আর কিছু করার নেই আপনার। বরং আসুন রুম্পা হত্যার বিচারের দাবিতে সোচ্চার হই। বাংলাদেশে এখন প্রধান বিরোধী দল হলো ফেসবুক। ফেসবুকে সোচ্চার প্রতিবাদ না হলে ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। তাই আপাতত মিথিলাকে ভুলে আসুন রুম্পার পরিবারের পাশে দাঁড়াই। প্রধান বিরোধী দল হিসেবে ফেসবুককে আরো বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে।

এইচআর/পিআর