পার্বত্য সংকট ও শান্তিচুক্তির দুই দশক
পার্বত্য শান্তি চুক্তির দুই দশক অতিক্রান্ত হচ্ছে। পার্বত্য সংকটের সূচনা হয় মূলত পঁচাত্তর পরবর্তি সময়কালে। বাস্তুহারা উপজাতি, বাঙালি বসতি ও সেনা ক্যাম্প স্থাপন নিয়ে প্রায় দু’যুগের বেশি সময় ধরে সশস্ত্র আন্দোলন অব্যাহত ছিল যার পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর। পাহাড়ে বিবদমান জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সঙ্গে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়। ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়িতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র সমর্পণ করেন সন্তু লারমাসহ ১ হাজার ৯শ ৬৮ জন শান্তিবাহিনীর সদস্য। শান্তি চুক্তির ফলশ্রুতিতে দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান হলেও বিভিন্ন পক্ষ ও মাধ্যম থেকে আলোচনা-সমালোচনা এবং হতাশাও ব্যক্ত করা হয়, আবার অনেক সমালোচনাই উদ্যেশ্যপ্রণোদিত। পার্বত্য সংকট একটি জটিল সমীকরণ, তাই প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির নির্মোহ মূল্যায়ন প্রয়োজন যা পার্বত্য এলাকায় বাস্তবিক অর্থে শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে।
পার্বত্য সংকটের নেপথ্যে:
পার্বত্য সংকটের মূলত বাঙালি ও চাকমা জনগোষ্ঠী কেন্দ্রিক। কিন্তু এ সংকটের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় বলতে গেলে অনালোচিত থেকে গেছেন। ত্রিদিব রায় ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভাগের বিরোধী ছিলেন এবং পার্বত্য এলাকাকে ভারতের অংশ রাখতে চেয়েছিলেন। দেশভাগের পর তিনি কট্টরপন্থী পাকিস্তান সমর্থক বনে যান। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করায় তার অনেক অনুসারী পাকবাহিনীর সহযোগি হিসেবে বাঙালিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। স্বাধীনতার আগেই পাকিস্তানে আশ্রয় গ্রহণ করেন ত্রিদিব রায় এবং পাকিস্তানের আনুগত্য করে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।
বলা হয়, বৃটিশ শাসনামলে উপজাতিদের বিশেষ মর্যাদা সংরক্ষিত ছিল যার ব্যত্যয় ঘটে পরবর্তিকালে। অনেকেই বৃটিশ শাসনের প্রশংসাও করেন। প্রকৃতপক্ষে, ১৭৭৭ থেকে ১৭৮৭ সাল পর্যন্ত চাকমাদের সঙ্গে বৃটিশদের যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান ছিল। ১৮৬০ সালে লর্ড ক্যানিং এর নেতৃত্বে পার্বত্য এলাকার প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি শুরু হয়। ১৮৬৮ সালে পার্বত্য অঞ্চলকে terra nullius (belonging to no one) হিসেবে গণ্য করা হয়, যেখানে ভূমির মালিকানা কারও ছিল না। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯০০ সালে চাকমা রাজার মাধ্যমে অধিবাসীদের করের আওতায় আনা হয়। ১৯৩৫ সালে যে মর্যাদা দেয়া তাতে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার বিধান ছিল, নিয়ন্ত্রণমুক্ত ছিল না। আর বাঙালি বসতি স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয় বৃটিশ আমলেই যার লক্ষ্য ছিল অধিক কর প্রাপ্তি।
কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বাঁধ স্থাপনের প্রস্তাব ওঠে ১৯০৬-০৭ সালে এবং ১৯২২ সালে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ১৯৪০ সালে প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর ১৯৫৫ সাল থেকে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের নেতৃত্বে প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়।
বৃটিশ আমলেই ত্রিদিব রায়কে সার্কেল চিফ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। ত্রিদিব রায় ও তার সহযোগীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বাঁধ নির্মাণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বাধ নির্মাণের কারণে ১৮ হাজার পরিবারের প্রায় ১ লক্ষ লোকের কৃষি জমি ও বসতবাড়ি ডুবে যায়। এতে জুম্মদের পাশাপাশি বাঙালিও বাস্তুহারা হয়েছিল।
কাপ্তাই এর বাস্তুহারা ও সেটেলার ইস্যু:
বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া যায়। জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা রচিত "ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় পরিষদ" এবং রাজা দেবাশীষ রায় কর্তৃক প্রকাশিত বিরাজ মোহন দেওয়ান রচিত "চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত" বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, ১৯৫৭ সালে বাধ নির্মাণের সময় থেকে ১৯৭৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কয়েক দফায় পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়।
পশ্চাৎপদ পার্বত্য জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে বঙ্গবন্ধু উদারতা থেকে উপজাতিদের বাঙালি হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তবে তার তেমন কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় নি। আর এর প্রমাণ ১৯৭৩ সালে তিনি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোয় পাহাড়ি ছাত্রছাত্রীদের জন্য সুনির্দিষ্ট আসন সংরক্ষণের জন্য নির্দেশনা দেন এবং ৭৫ এর ৩০ জুন পুনর্বাসন কর্মকাণ্ড সমাপ্ত করেন।
পক্ষান্তরে, উপজাতিদের একটি অংশের মতে ক্ষতিপূরণের কোনো টাকাই দেয়া হয় নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও উপজাতীয় সমস্যা নিয়ে লেখা অনেক বইয়ে ক্ষতিপূরণের অর্থের বড় অংশ আত্মসাৎ হতে পারে বলে উল্লেখ রয়েছে। যে সংকটের নেপথ্যে অন্যতম প্রধান ভূমিকা ত্রিদিব রায়ের, সেখানে তিনি এখনো শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব, এটা নিঃসন্দেহে উদারতার পরিচায়ক। এ উদারতা সকল ক্ষেত্রে আংশিক প্রয়োগ হলেও পাহাড় হয়ে উঠবে শান্তির নীড়।
অস্বীকার করা যাবে না যে, ১৯৫৭ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ পার্বত্য সমস্যাকে এতটা জটিল করে নি, যা হয়েছে আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের পরিবর্তে বলপ্রয়োগকে কৌশল হিসেবে বিবেচনা করে। উপজাতিদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টির সূচনা হয় ৭৫ পরবর্তি সময় থেকে, বিশেষত ৭৯ সালে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ভূমিহীন উদ্বাস্তুদের পাহাড়ি এলাকায় পুনর্বাসন করা শুরু হলে। বসতি স্থাপনে উৎসাহিত করতে বাঙালিদের মাসিক ভাতা ও রেশন দেয়া হয়েছিল। ফলে উপজাতিদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সৃষ্ট অসন্তোষ রাজনৈতিকভাবে সংকট নিরসনের চেষ্টা করা হয় নি। উপজাতিদের বোঝানোর চেষ্টা করা হয় নি যে, ৯০% বনভূমির স্বল্প জনবসতির পার্বত্য অঞ্চল সহ যেকোনো অঞ্চলে বাঙালি ও উপজাতিদের বসবাসের সমান অধিকার থাকা যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত। বাঙালি, উপজাতি বা ধর্ম বর্ণের বৈষম্য নিরসন ও সকল শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে গণমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের পরিবর্তে অসন্তোষ নিরসনের উপায় হিসেবে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বলপ্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয় স্থানীয় উপজাতিদের, প্রায় ৪০ হাজার উপজাতি আশ্রয় নেন ভারতে। অন্যদিকে স্বার্থ রক্ষার নামে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলোর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও তাদের সশস্ত্র অঙ্গসংগঠন ‘শান্তিবাহিনী’।
শান্তিচুক্তি কেন্দ্রিক কয়েকটি সমালোচনার দিকে আলোকপাত করা যাক।
উপজাতি বনাম আদিবাসী:
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাহমান নাসির উদ্দীনের মতে, "বাংলাদেশ আদিবাসীর মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে নি", "আদিবাসী অভিধাও সামরিক আমলাতন্ত্রের কারণে সরকার পক্ষ মানতে রাজি নয়।" - এ জাতীয় হাস্যকর ও বায়বীয় অভিযোগ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার অংশ কিনা জানি না!
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপজাতি জনগোষ্ঠীকে দেশের মূলধারার আনার ঘোষণা প্রদান করে ১৯৭২ সালের ২২ জুন ‘ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পপুলেশনস কনভেনশন, ১৯৫৭’এ অনুস্বাক্ষর করেন।
১৯৮৯ সালের আইএলও কনভেনশন-১৬৯কে গ্রহণ না করার কারণ ছিল, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি ঝুঁকি বিবেচনায় রাষ্ট্রের স্বার্থের বিপক্ষে যাচ্ছে - এই মর্মে বেশিরভাগ দেশই তাতে অনুমোদন দেয় নি। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র এই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। এশিয়ার একমাত্র স্বাক্ষরকারী দেশ নেপাল এবং বাংলাদেশ ভোট দানে বিরত ছিল। এছাড়া, বাংলাদেশ জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ। ২০০৭ সালের জাতিসংঘ আদিবাসী সনদে ‘আদিবাসী এলাকায় সেনা চলাচল করা যাবে না’ এমন বেশ কিছু শর্ত রয়েছে। কোনো দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা যদি আদিবাসীদের আবাসস্থল হয় তাহলে কোনো দেশই এমন সনদে স্বাক্ষর করবে না।
২০০৭ সালের আগ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো আঞ্চলিক দল বা নেতা আদিবাসী স্বীকৃতি চাননি। উপজাতি থেকে আদিবাসী স্বীকৃতি পেলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত হবে - এটি মোটেই যৌক্তিক কথা নয়। সবচেয়ে বড় কথা, আদিবাসী শব্দটির সার্বজনীন কোনো সংজ্ঞা নেই। অস্ট্রেলিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের আদিবাসী এবং বাংলাদেশের আদিবাসী প্রেক্ষাপট মোটেই এক নয়। কারণ বাঙালির ইতিহাস ৪ হাজার বছরের। বাংলাদেশের কোনো নৃগোষ্ঠীকে কেউ কখনোই Son of the Soil বা Aborigines হিসেবে উল্লেখ করেন নি, পক্ষান্তরে বাঙালিদেরই ভূমিপুত্র বলে অভিহিত করা হয়েছিল।
পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন মানে কি উন্নয়ন?
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমার মতো অনেক মানবাধিকার কর্মি প্রশ্ন রাখেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার ধরন কী অর্থনৈতিক বা উন্নয়ন সমস্যা, নাকি রাজনৈতিক সমস্যা?
এটি কৌশলী প্রশ্ন যা শুনতে যৌক্তিক মনে হয়। আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি লাভের যে কারণ দেখানো হয় সেখানে জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার ফলাফল হিসেবে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উত্তরণের কথাই বলা হয়, যা প্রকারান্তরে উন্নয়নেরই ফলাফল। একটি রাষ্ট্রে অধিকার মানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে শত্রু ভাবাও নয়। একইভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা কাউকে সংখ্যালঘুর অধিকার হরণ, তাদেরকে বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ বা শক্তিমত্তা প্রতিষ্ঠার সনদ দেয় না। তাই উপজাতি ও বাঙালি উভয় পক্ষের উদার মানসিকতা ও একে অপরকে আপন করে নেয়ার প্রবণতা না থাকলে কোনো উদ্যোগই সফল হয় না।
সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার:
বাংলাদেশে উপজাতিদের পক্ষ থেকে পার্বত্য এলাকার সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের দাবিই সবচেয়ে বেশি তোলা হয়। ভারতের কাশ্মীর, কিংবা মনিপুর রাজ্যে সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা দেয়া আছে যা বাংলাদেশে নেই। শান্তিচুক্তির প্রতি আন্তরিক বলেই পাঁচ শতাধিক সেনা ক্যাম্পের প্রায় অর্ধেক সরানো হয়েছে। কিন্তু এ প্রত্যাহার কোন মাত্রায় হবে সে দাবি অবশ্যই যৌক্তিক, গ্রহণযোগ্য ও সময়োপযোগী হতে হবে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ সেনাবাহিনীকে দক্ষতা, নিষ্ঠা ও সততার প্রতীক হিসেবে গণ্য করে ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করে। পার্বত্য এলাকা সীমান্তবর্তী, তাই নির্দিষ্ট সংখ্যক সেনাবাহিনী ও বিজিবি থাকা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। রাজধানী ঢাকায়ও সেনানিবাস রয়েছে, কেউ কখনোই এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন নি। সুশীলরা যে জাতিসংঘের দোহাই দেন, সেটির শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের অন্যতম অংশীদার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তাই সেনাবাহিনীর প্রতি বৈরি মনোভাবের উদ্দেশ্য আর যাই হোক মহৎ হওয়ার কোনো কারণ নেই।
অন্যদিকে শান্তির চুক্তির আলোকে যেসব এলাকা থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে, সেখানে খুন, অপহরণ ও সন্ত্রাসী তৎপরতার কারণে প্রতিস্থাপনের দাবি জানিয়েছে পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে একটি খ্রিস্টান মিশনারি তাদের কৃষি প্রকল্প বন্ধ করে দিয়েছে। সকলেরই অনুধাবন করা উচিত এক-পাক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি সংকট উত্তরণের পথ নয়।
এটা বললে অবশ্যই ভুল হবে না যে, চাকমা ও বাঙালিদের একটি নির্দিষ্ট অংশের কিছু দাবি অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য, সেটেলার ইস্যু তার একটি। দেশের নাগরিক হিসেবে পার্বত্য জেলার যেকোনো চাকমা অপর ৬১টি জেলার যেকোনো স্থানে চাইলেই জমি কিনতে পারেন বা সরকার থেকে খাস জমি পাওয়ার অধিকার রাখেন। কেউ বলবে না যে, এতে তার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তাই সাধারণ একজন নাগরিক খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তোলেন, ৯০% বনভূমির এলাকায় বাঙালি বসতি স্থাপন হলে উপজাতিদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে কেন বা কোন যুক্তিতে? প্রশ্ন তোলা স্বাভাবিক যে, চুক্তিতে বাঙালি উচ্ছেদের কোনো শর্ত না থাকলেও বাঙালি দ্বেষ পোষণ কেন? সেটেলার বলে যাদের বিরোধিতা করা হয়, সেই সেটেলাররাই কিন্তু উপজাতিদের জন্য শিক্ষা ও চাকুরিতে কোটা সহ শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখছে।
পক্ষান্তরে, শান্তিচুক্তি অত্যন্ত দূরদর্শী ও প্রজ্ঞাময় একটি পদক্ষেপ হলেও বাঙালিদের একটি অংশ এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির অপচেষ্টায় লিপ্ত। বাঙালিদের ইতিহাস ৪ হাজার বছরের হলেও, গত ৪/৫শ বছর যাবত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরাই সে এলাকায় বসবাস করছেন তা অস্বীকার করা যাবে না। তাই বাঙালি ও উপজাতি উভয়েরই বৈরি মনোভাব পরিহার করা উচিত। তবে উদারতা প্রদর্শনের প্রয়োজন বেশি বাঙালিদেরই। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বিশেষ অধিকার নিশ্চিত করা আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত একটি বিষয়। মধ্যযুগের মনোভাব পোষণ করা ব্যক্তিগণ বুঝতে অপারগ যে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষা করা ও সহায়তার মানসিকতা সংখ্যাগুরুর দায়িত্ব ও কর্তব্য।
শান্তিচুক্তির ২২ বছর পূর্ণ হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হলেও ক্রমশ ইতিবাচক গতিতেই অগ্রসরমান শান্তিচুক্তি। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান ঘটাতে পার্বত্য শান্তিচুক্তির অনন্য সাধারণ সাফল্যের কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে জননেত্রী শেখ হাসিনার। ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-জাতিগোষ্ঠী ও উপজাতিদের অধিকার ও মর্যাদার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে ধর্মীয় ও নৃ-জাতিসত্তাগত সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান ঘটিয়েছেন তিনি। অনগ্রসর ও অনুন্নত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সন্তানদের শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে বিশেষ কোটা এবং সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রাখতে শেখ হাসিনার আন্তরিকতা নিয়ে বিরোধীদেরও প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। শান্তিচুক্তির অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়েছে, তবে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমীকরণের চেয়ে বেশি প্রয়োজন আন্তরিক সহমর্মিতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব। বাঙালি ও উপজাতিদের মধ্যে যেদিন সকল দ্বন্দ্ব সংঘাতের নিরসন হয়ে শান্তি ও সম্প্রীতির সুবাতাস বইবে সেদিনই প্রকৃত অর্থে শান্তিচুক্তির সফল বাস্তবায়ন হবে।
লেখক : রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক।
[email protected]
এইচআর/জেআইএম