ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ওসির জেল : বিচার হয়, বিচার করা যায়

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা | প্রকাশিত: ১২:২২ পিএম, ৩০ নভেম্বর ২০১৯

এক বছরের বেশি সময় আগে কার্যকর হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কোন মামলায় প্রথম কোন রায় হল এবং সেটি হয়েছে এক পুলিশ কর্মকতার বিরুদ্ধেই। ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনের ৮ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তাকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। বেআইনিভাবে নুসরাত জাহান রাফির ভিডিও করার দায়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৬ ধারায় ওসি মোয়াজ্জেমের ৫ বছর কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। সেই ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ায় ২৯ ধারায় তাকে ৩ বছর কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

ওসি মোয়াজ্জেমের আট বছরের কারাদণ্ড হওয়ার ঘটনায় বাদী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন বলেছেন, বাংলাদেশের থানাগুলোতে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা নিজেদের জমিদার মনে করেন, জমিদারের মতো আচরণ করেন, তাদের জন্য এই রায় অশনিসংকেত। সব ওসি বা পুলিশ কর্তা বা সরকারি কর্মকর্তা রাষ্ট্রীয় অফিসকে জমিদারী মনে করেন, তা নিশ্চয়ই নয়।

ফেনীর আলোচিত নুসরাত হত্যা মামলায় জেলার এসপি ও ওসির কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পাওয়া না গেলেও সামগ্রিকভাবে পুলিশ প্রশাসন যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে এবং পিবিআই যে পেশাদারীত্বের সাথে ঘটনার তদন্ত ও চার্জশিট দিয়েছে, এজন্য তাদের অভিনন্দন জানাতেই হয়। আমরা দেখেছি আসামিদের গ্রেফতারে, মামলার তদন্ত ও চার্জশিট নিষ্ঠা ও দ্রুততার সাথে করার কারণেই এই হত্যা মামলায় দ্রুত দুটি রায় পাওয়া সম্ভব হয়েছে।

মানুষ আবারো বুঝল আন্তরিকতার সাথে চাইলে যেকোন অপরাধের দ্রুত ও প্রত্যাশিত পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা পুলিশ বাহিনীর আছে। এ জন্য যদি আইন বা বাহিনীর কাঠামোগত কোন সংস্কার করা দরকার হয় তবে সেটিও করা প্রয়োজন। ফৌজদারি মামলার তদন্তের দায়িত্ব পুলিশের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তদন্ত সম্পন্ন হতে সময় বেশি লাগে। ফৌজদারি বিচারপ্রক্রিয়ার এই দিকটি পুলিশ বিভাগ থেকে বিশেষ নজরের দাবি রাখে। প্রতি বছর কি পরিমাণ মামলার তদন্ত বকেয়া থেকে যায় সেই পরিসংখ্যান ধরে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিলে নিশ্চয়ই এই বিলম্বের অবসান ঘটানো যায়।

পুলিশের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, নৃশংসতা, এফআইআর নথিভুক্ত করতে অনীহা, তদন্তে গাফিলতি এবং ভুয়ো তথ্য দেওয়ার অভিযোগ অনেক পুরোনো। কিন্তু নিজেদের একজন সদস্যেরও যে বিচার করা যায়, পুলিশ বাহিনী সেটি প্রমাণ করল ওসি মোয়াজ্জেমের ক্ষেত্রে।

ফেনীর ঘটনা ও ওসি মোয়াজ্জেমের কাণ্ড কিছু বিষয় সামনে এনেছে। নানা সময় পুলিশের সংস্কারে কমিশন হয়েছে। মুশকিল হল, সেগুলোর রিপোর্টে শুধু ধুলোই জমেছে। তবে সবসময় আলোচনায় থাকছে- পুলিশবাহিনীতে কর্মিসংখ্যা কত হওয়া প্রয়োজন, কর্মী-নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণের পদ্ধতি কী হবে, এবং সেই বাহিনীতে কী ধরনের শৃঙ্খলা প্রয়োজন, কী ধরনের অস্ত্র, এবং আনুষাঙ্গিক রসদ প্রয়োজন এমনসব বিষয়। এসবের বাইরে আলোচনা আছে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বের থেকে তদন্তের দায়িত্বকে কী ভাবে পৃথক রাখা হবে, পুলিশের হাতে কতখানি ক্ষমতা থাকবে এবং তার কর্তব্য কী হবে, কী ভাবে নথি বজায় রাখা হবে, কীভাবে বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির মোকাবিলা করা হবে এবং পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক কী হবে।

সাধারণ মানুষের সাথে সবচেয়ে নিবিড় সম্পর্ক পুলিশের। নিরাপত্তার প্রয়োজনে, বিচারের আশায় মানুষ থানায় যায়। থানাও উদ্যমী হয়ে মানুষের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু ক্ষমতাহীন সাধারণ মানুষ কতটা নির্ভরতা পায় সেটিই বেশি বিবেচ্য। ফেনীর নুসরাতের পরিবার সেরকম একটি পরিবার এবং তারা ওসি মোয়াজ্জেম থেকে তাদের প্রাপ্য বিচার ও মর্যাদাটি পায়নি। অথচ থানা থেকে বা থানার কর্তাদের কাছে থেকে সদাচরণ পাওয়া তাদের নাগরিক অধিকার।

দেশের প্রতিটি মানুষের বিচার চাওয়ার অধিকার থাকতে হবে এবং বিচার পাওয়া যায় সেই আস্থার পরিবেশটাও থাকতে হবে। যদি যথার্থ বিচার না-ই পাওয়া যায়, তবে বিচার চাওয়ার অধিকার থেকে লাভ কী? সেই বিবেচনায় সরকারকে, পুলিশ প্রশাসনকে এবং সর্বোপরি বিচার বিভাগকে ধন্যবাদ জানাই নুসরাত হত্যার মামলাটির সুষ্ঠু পরণতিনর দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। তবে এ দেশে প্রতি দিন যে পরিমাণ মামলা জমা পড়ে, আমাদের পুলিশ ও বিচারব্যবস্থার পক্ষে তা সামলে উঠা সত্যি খুব কঠিন। বিচারাধীন মামলার সংখ্যা কমিয়ে আনা গেলে আরও অনেক মামলার রায়ই সুষ্ঠুভাবে শেষ করা সম্ভব হতো।

এতে করে জেলখানায় বন্দির আধিক্যের সমস্যাও কমবে। কারাগারগুলোয় বন্দির সংখ্যাধিক্যের সমস্যা প্রকট। কারাগার সমূহে ঠেসাঠেসি ভিড় কমাতে হলে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি প্রয়োজন এবং সেটা করা সম্ভব পুলিশ কতটা নির্মোহভাবে মামলা করে, তদন্ত করে এবং দ্রুততা ও দক্ষতার সাথে চার্জশিট দেয় তার উপর। ওসি মোয়াজ্জেমের ঘটনায় প্রমাণ হলো, আসামি শক্তিশালী হলেও বিচার হয়, বিচার করা যায়।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এমএস