ইডেনে গোলাপী তাণ্ডবের সাক্ষী স্কোরকার্ড
ম্যালকম ডেনজিল মার্শাল। ঠিক বিশ বছর বিশ দিন আগে ব্রিজটাউনের কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে শেষ হয়ে গিয়েছিল তাঁর জীবনের ইংনিস। জীবনের স্কোর মাত্র ৪১! কিন্তু সেই তিনি ক্রিকেট বিশ্বের খুব কম মাঠ আছে, যেখানে ব্যাটসম্যানের রক্ত না ঝরিয়েছেন। ক্রিকেট বল। রক্ত। চোখের জল। মার্শাল মানে ব্যাটসম্যানের এই তিন স্টাম্প আগলে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা। ক্রিকেট মাঠের ধূসর বাইশ গজকে মার্শাল মৃত্য উপত্যকা বানিয়ে ফেলতেন।
ইডেনে সুনীল গাভাস্কারের মত টেকনিক্যালি সাউন্ড ব্যাটসম্যানের স্টাম্প উপড়ে ফেলেছেন! মাইক গ্যাটিং এর মত বাঁহাতির নাক দিয়ে গল গল করে রক্ত ঝরেছে। আর বলের সিম থেকে রক্ত খুঁটে মুছতে মুছতে নির্বিকার বোলিং মার্কে ফিরে গেছেন ম্যাকো! মার্শালের মত ক্রিকেট মাঠে এত রক্ত আর কেউ দেখেননি। এবং সেটা হেলমেট যুগে।
ম্যালকম মার্শাল ক্রিকেট মাঠে ব্যাটসম্যানদের জন্য ‘মার্শাল ল’ জারি রাখতেন। সামান্য ভুল হলেই রক্ত ঝরবে। কিন্তু ইডেনে গোলাপী বলের দিন-রাতের টেস্টে ইশান্ত-শামিরা কী বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের জন্য মার্শাল ল জারি রাখলেন? রক্ত হয়তো ঝরেনি। কিন্তু মাঠ ছাড়তে হয়েছে।‘কনকাশন সাব’ হিসেবে চারজনকে মাঠে নামতে হয়েছে! ইডেনের গোলাপী উৎসব বিবর্ণ –ধূসর হয়ে গেছে বাংলাদেশের জন্য। আর এদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের হৃদয় ভেঙে রক্তাক্ত হয়েছে।
সিটি অফ জয় –কলকাতা দিন কয়েকের জন্য রুপ নিয়েছে পিংক সিটিতে। সেটা দেখে সত্যিকার পিংক সিটি জয়পুরের হতাশা বাড়তেই পারে। কিন্তু গোলাপী উৎসবে কলকাতা যে ভাসছে আনন্দ-উৎসবে। আর গঙ্গাপাড়ে ভারতীয় পেসাররা যে ঝড় তুলেছেন তাতে এলেমেলো বাংলাদেশের ক্রিকেটীয় সৌধ। ক্রিকেট পর্যটক ইডেন টেস্টের চতুর্থ দিন মাঠে ঢুকে আবিষ্কার করবেন কি দমকা হাওয়া বয়ে গেছে সেখানে দিন টেস্টেও প্রথম দুই দিনেই। যেখানে বিধস্ত বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইন। দুই একজনকে হাসপাতাল পর্যন্ত ঘুরে আসতে হয়েছে! আর ইডেন টেস্টে বাংলাদেশের শোকগাথা হিসেবে পড়ে আছে স্কোরবোর্ড।
ইডেন টেস্ট বাংলাদেশের জন্য এক শোকগাথা হিসেবে পড়ে থাককে কেন? চটজলদি উত্তর- ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায়। এই প্রশ্নের উত্তরে মার্ক দিতে হলে, ওরকম উত্তরদাতাকে ফুলর্মাক দেয়া কি ঠিক হবে? ব্যর্থতার দায় কী শুধু ব্যাটসম্যানদের। দায় কী অন্য কারো থাকবে না? কেউ নিবেন না! আসলে ব্যর্থতা সে তো এতিম। আর সাফল্যের ভাগ নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। গোলাপী বলে টেস্ট খেলবেন, ভাল কথা। এই সিরিজের আগে কী একবারও ভেবেছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট কর্তারা। তার জন্য কী কোন মানসিক এবং প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি ছিল বাংলাদেশের?
উত্তরে হয়তো পাল্টা যুক্তি দাঁড় করানো হবে, কেন ভারতও তো তাদের ইতিহাসের প্রথম দিন-রাতের টেস্ট খেলেছে গোলাপী বলে। হ্যাঁ তাই। কিন্তু ভারতের প্রস্তুতি ছিল না। সেটা হয়তো পুরোপুরি সত্যি না। কারণ, ঘরোয়া ক্রিকেটে কিছু ম্যাচ খেলেছে তারা গোলাপী বলে। তারচেয়ে বড় কথা গোলাপী বলে কিভাবে খেলতে হবে, গোলাপী বলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য কি হতে পারে , ব্যাটসম্যানদের জন্য সমস্যার দিক কী এবং বোলাররা কিভাবে বাড়তি সুবিধা পাবেন এই পাঠটা ভারতীয় ক্রিকেটাররা বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের চেয়ে ভালভাবে পেয়েছেন।
ডে-নাইট ওয়ানডে ম্যাচের আগে কম পরীক্ষা নীরিক্ষা হয়নি। রাতের ফ্লাডলাইটের আলোয় লাল বলকে সহজে দেখা যায় না। তাই অন্য রঙের বলের খোঁজ শুরু হয়। হলুদ ও কমলা বল দিয়ে পরীক্ষামূলক ভাবে খেলা চালিয়ে শেষ পর্যন্ত সাদাকেই বেছে নেয়া হয়। ভারতের মাটিতে দিন-রাতের টেস্টেও আগে আরো এগারটা দিন-রাতের টেস্ট হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় ব্যবহার করা হয়েছে কোকাবুরা বল। ইংল্যান্ডে ডিউক বল। আর ভারতে বেছে নেয়া হয়েছে এসজি বল। বেশ কয়েক বছর আগে থেকে দিন-রাতের টেস্ট নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করে আইসিসি। বলের রং নিয়েও অনেক কথা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত গোলাপী বলকেই ছাড়পত্র দেয়া হয়। কারণ ফ্লাড রাইটে গোলাপী বল দেখতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অন্য রং এর ক্ষেত্রে দৃষ্টিভ্রম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাছাড়া গোলাপী বল ক্যামেরায় বেশ উজ্জ্বল দেখা যায়। তবে গোলাপী বলের রং এর উজ্জ্বলতা এবং সিম লাল বা সাদা বলের চেয়ে কিছুটা আলাদা হয়।
আর বলের ঔজ্জ্বল্য বজায়ে রাখতে গিয়ে রং এর শেড বেশি দেয়া হয়। স্টিচ ও একটু মোটা। কিন্তু ব্যাটসম্যানদের জন্য সমস্যা হয় ভিশনে। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরাও সেই সমস্যায় পড়েছেন। ম্যাচ শুরুর আগের দিন থেকে হৈ চৈ শুরু হয় লিটন দাস গোলাপী বল দেখতে পাচ্ছেন না। সত্যি কথা। শুধু ব্যাটসম্যান লিটন নন। কিপার লিটনেরও সেই সমস্যা হতো। তবে একা লিটন নন। সমস্যায় পড়েছেন কম বেশি সবাই। গোলাপী বলে আই মুভমেন্ট ঠিক মত না হলেই বিপদ। সেই বিপদইে পড়েছেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা।
বল ডেলিভারির সময় বোলারের হাত দেখেই ব্যাটসম্যানরা সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু গোলাপী বলে বল ডেলিভারির পর একটু আগেই বলটা খেলতে হবে। এমন কথাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। আগে না খেললেই আই মুভমেন্টের কারণে ভিশন শিফট হয়ে যায়। বল শেষ পর্যন্ত ব্যাটসম্যান যেখানে দেখেছেন সেখানে আর থাকে না। তিনিও আর দেখেন না। তাই শরীরে আঘাত বেশি লাগছে। মোটা দাগে একটা সমাধানও দিয়েছেন ব্যাটিং কনসালটেন্টরা। মানুষের দুটো চোখের দুইটোই সমান দৃষ্টি সম্পন্ন নয়। ডান হাতি ব্যাটসম্যান তার ডান চোখে যদি অধিক ভাল দেখেন তাহলে তিনি ওপেন স্ট্যান্স নিয়েই ভাল খেলবেন। একইভাবে বাঁহাতি ব্যাটসম্যান যদি বাঁ চোখে ভাল দেখেন তাহলে তার জন্য ওপেন স্ট্যান্স নিয়ে খেলা সহজ। তা না হলেই বিপদ। বিরাট কোহলিটা পিচ পড়ার একটু আগে খেলেছেন। তিনি সফল। এটা তার স্কিল। ফিটনেস। কেউ হয়তো বলবেন; বিরাট কোহলিদের কাছে বলের রং কোন ব্যাপার নয়। হ্যাঁ, তাই। কিন্তু তাঁর মত গ্রেট কী সবাই।
গোলাপী বলে ফাল ডুপ্লেসি-র মত ব্যাটসম্যানও সেঞ্চুরি করেছেন। সেটা অস্ট্রেলিয়ানদের স্লেজিং শুনতে শুনতে। তিনি হয়তো বিরাটের মত বিরাট কোন ব্যাটসম্যান নন। কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দিতে হয় কীভাবে সেটা জানেন। তাছাড়া, ক্রিকেট এখন অনেক বিজ্ঞান নির্ভর হয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানের সেই পাঠটা যারা ভালভাবে নিতে পারবেন, তারাই এগিয়ে থাকবেন। সেটা বলের রং গোলাপী, লাল বা সাদা যাই হোক।
ম্যালকম মার্শালকে নিয়ে এই লেখা শুরু করার এটাই কারণ ছিল। তারচেয়ে বেশি রক্ত ক্রিকেট মাঠে অন্য বোলরারা দেখেননি। কিন্তু গোলাপী বলে দিন-রাতের টেস্টে বাঙালির হৃদয়ের রক্তক্ষরণ তিনি হয়তো স্বর্গে বসে দেখছেন। আর মনে মনে হয়তো বলছেন; ‘ইস! এই গোলাপী বলটা যদি আমি হাতে পেতাম। তাহলে অনেক দলের স্কোর হয়তো আমার জীবনের স্কোরের চেয়ে কম বানিয়ে দিতে পারতাম!’ তবে স্কোর ৪১ না কত হতো সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। মার্শালের জমানায় গোলাপী বল আর দিন রাতের টেস্ট হলে ক্রিকেটের সবুজ মাঠে আর বেশি রক্ত ঝরতো। জানি না, গোলাপী বল আগামী দিনে টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষৎ কী না।
লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।
এইচআর/পিআর