সড়ক আইন না থাকলেই ভালো!
সংসদে পাস হওয়ার ১৪ মাস পর ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ কার্যকর হতে না হতেই অকার্যকর হয়ে গেল? দেখে-শুনে বা বুঝে এমনটাই মনে হলো। মালিক-শ্রমিক ভয়ংকর ঐক্যের কাছে হেরে গেছে সরকার? মানুষ এমনটা ভাবছে, কারণ যেসব মোটামুটি কঠোর ধারা ছিল, সেগুলো সংশোধনের দাবি বিবেচনায় নিয়েছে সরকার। যেসব ধারার কারণে মালিক-শ্রমিকরা বড় ধরনের আর্থিক জরিমানায় পড়তে পারে, সেগুলোর প্রয়োগ আগামী বছর জুন পর্যন্ত স্থগিত করার পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক-শ্রমিকরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিয়েছে। নিত্যপণ্যের বাজার যখন গুজবের কারণে কিছুটা হলেও অস্থির তখন তারা সরকারকে বিপাকে ফেলে দাবি আদায় করে নিয়েছে।
পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা পেশিশক্তির বদৌলতে দাবি আদায় করে নিয়েছে, কিন্তু সাধারণ মানুষ? তারা ভাঙচুর করে না বলে, তারা ভদ্র বলে, অসংগঠিত বলে তাদের ওপর ব্যাপকহারে জরিমানা বহাল থাকবে? তাহলে আইনের ন্যায্য প্রয়োগ করল কি রাষ্ট্র বা সরকার?
দেশে সরকার আছে, আইন বাস্তবায়নের জন্য সংস্থা আছে, কর্তৃপক্ষ আছে, কিন্তু সবাইকে নাকানি-চুবানি খাইয়ে, জনগণকে নাকাল করে সন্ত্রাসী কায়দায় আন্দোলনের পর এদেরই আবার আদর করে ডেকে তাদের কথামতো আইন করার আশ্বাস দেয়া হলে পরিবহন খাতে আর সুশাসন আশা না করাই ভালো। হয়তো সরকারের দিক থেকে বলা হবে, এটি একটি কৌশল, কিন্তু আসলে এটি রাজনৈতিক প্রশ্রয়, যে প্রশ্রয়ের মাশুল সড়ক খাতে এদেশের মানুষ দিচ্ছে অনন্তকাল ধরে।
১৪ মাস পর গত ১ নভেম্বর আইন কার্যকরের দিন থেকেই আমরা সড়কমন্ত্রীর মুখে কেমন একটি নমনীয় ও কমনীয় ভাব লক্ষ করছিলাম এই সহিংস পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের প্রতি। দুই সপ্তাহ পর আইন প্রয়োগ শুরু হলে তিনি বলতে লাগলেন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যেন বাড়াবাড়ি না করে। ঠিক তখনই রাজনৈতিকভাবে মদদপুষ্ট পরিবহন শ্রমিকরা বুঝে ফেলে এ আইন বাস্তবায়ন করার সাধ্য নেই সরকারের, অন্তত তাদের ওপর এই আইন প্রয়োগ করার ক্ষমতা রাখে না সরকার।
ধর্মঘট নিয়ে প্রথম থেকেই নিরুত্তাপ থাকার নীতি নিয়েছিল সরকার ও পুলিশ প্রশাসন। পুলিশের সামনে তারা সব ধরনের সহিংসতা করেছে। সড়ক নিরাপত্তায় রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত নিবেদিতপ্রাণ কর্মী চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিতে জুতা নিক্ষেপ, তার বিরুদ্ধে অশ্লীল স্লোগান, মানুষের মুখে পোড়া মোবিল মেখে দেয়া সবই হয়েছে পুলিশের সামনে। তাদের জিঘাংসা থেকে মানুষকে বাঁচাতে পুলিশ সামান্য পদক্ষেপও নেয়নি। সেতুমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেননি, এই ধর্মঘট পুরোপুরি অযৌক্তিক।
কর্তৃপক্ষীয় কেউ একবারও বলল না সত্যিই ধর্মঘটের কোনো কারণ আছে, নাকি রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের অশ্লীল বলপ্রয়োগে একটি আইনকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র এটি।
সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন ২২৫ ইউনিয়ন প্রকাশ্যে কোনো ধর্মঘট আহ্বান করেনি। কিন্তু দেশজুড়ে ধর্মঘট হয়েছে। সারাদেশেই হয়েছে। মানুষ কষ্ট পেয়েছে, বিভিন্ন পরীক্ষায় ছাত্রছাত্রীরা অংশ নিতে পারেনি। এই ধর্মঘট সর্বাত্মক বন্ধের চেহারায় না থাকলেও সারাদেশেই আসলে এর প্রভাব পড়েছিল। অধিকাংশ সড়কে যান চলাচল করেনি। যারা নিজের গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে তাদের আটকানোর চেষ্টা হয়েছে সর্বত্রই, এমনকি রোগীরাও বাদ যায়নি।
পরিবহন শ্রমিকরা নানা অভিযোগ করেছে যার কোনোটিই আসলে সত্য ছিল না। কিন্তু তাদের ভুল বুঝিয়ে সহিংস করে তোলার প্রক্রিয়াটা অনেক পুরোনো। দেশে উন্নয়নের যে অগ্রযাত্রা, মানুষের মনে যে উন্নয়ন স্পৃহা, তার সঙ্গে এই সড়ক পরিবহন আইন নিয়ে সহিংস চক্রের কাছে সরকারের কিছু মন্ত্রীর কৈফিয়ত দেয়ার মতো কণ্ঠ যৌক্তিক শোনায় না। আমরা এগোতে চাই, কিন্তু আমরা আটকে থাকি পুরোনো পদ্ধতিতে। এদেশে প্রাচীনকাল থেকেই পরিবহন খাত এমন। আইন বা নিয়মের কথা এলেই সহিংস ধর্মঘট। তারপর মালিক-শ্রমিকদের বিপজ্জনক ঐক্যকে স্বীকার করে তাদের সঙ্গে বৈঠক এবং তাদের মতো করে সড়ক পরিচালনার অঙ্গীকার- এটাই চলে আসছে।
পুরো পরিবহন খাত বিশৃঙ্খলায় ভরা। এখানে অবৈধ পন্থায় দাবি আদায়ই বৈধ কৌশল। শাসন পরিচালনার পরিবর্তিত ভঙ্গি এবং সক্রিয় ও তৎপর প্রশাসন, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দৃঢ়তা ইত্যাদি বিষয়ে দেশব্যাপী আলোচনা চলছে। কিন্তু মানুষ দেখছে এদের সঙ্গে সরকার পারছে না। পরিবহন মালিক-শ্রমিক ছাড়া শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল এদেশের সব মানুষ। সরকার বুঝতে পেরেছিল সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কিছু করা দরকার। সে জন্যই এসেছিল এই আইন, কিন্তু কার্যকর করতে গিয়ে সহিংস শ্রমিক নেতাদের রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে নত হতে হলো আবার।
প্রশাসন সম্পর্কে সমাজের ধারণা একটা রূপ পাওয়া গেল এবার। সুশাসনের কথা মুখে বলাই যথেষ্ট নয়, তার পদ্ধতিও যথাযথ হতে হয়। একটা কথা হয়তো ভাবা যেতে পারে, সড়ক আইন না থাকলেই তো ভালো, তাহলে প্রয়োগ বা সংশোধনের ঝামেলাও থাকে না।
এইচআর/বিএ/জেআইএম