ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

গুলতেকিনের বিয়ে ও ম্রিয়মাণ চন্দ্রকথা

ফারহানা মিলি | প্রকাশিত: ০৩:৫৭ পিএম, ২১ নভেম্বর ২০১৯

কবি-শিক্ষক গুলতেকিন খানের বিয়ে নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। তিনি সুপরিচিত মুখ হওয়ায় এমনটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া তিনি ভেঙেছেন সামাজিক কিছু প্রথা— নারীদের বিয়ে প্রসঙ্গে সমাজের গতানুগতিক ধারণার বাইরে গিয়ে। সর্বোপরি তিনি প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী ছিলেন একসময়। যে লেখকের লেখা বইগুলো তার জীবিতকালে তো বটেই, তার মৃত্যুর পরও তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে।

সব মিলিয়ে গুলতেকিন এখন আলোচনার শীর্ষে। তবে সুখের বিষয়, তার বিয়ে নিয়ে নেতিবাচক আলোচনার ফুলঝুরি এ যাবত নজরে পড়েনি। সমাজবদ্ধ প্রাণী হিসেবে অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে মানুষ আলোচনা করতে পছন্দ করে। তাছাড়া আমাদের এ সমাজে এখনও অনেকটা প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছে পুরনো সব মূল্যবোধ। সেগুলোর বিচারে একজন পরিণত বয়স্ক নারী... যিনি একজন মা এবং প্রথিতযশা লেখকের সাবেক স্ত্রী— তাকে পুনরায় বিয়ের পিঁড়িতে দেখতে অভ্যস্ত নয় এ সমাজ। একেবারেই পরিপূর্ণ বয়সে এবং সন্তান-সন্ততি নিয়েও কোনো নারী নিজের জীবন নিজে যাপনের কথা ভাবতে পারেন, সমাজে সাধারণত এর অনুমোদন নেই।

তারপরও বিপুলসংখ্যক লোক গুলতেকিনকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন, সেটি এই সমাজের বাস্তবতায় বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। দেড় শতক ধরে চলা নারীবাদী আন্দোলনের চতুর্থ ঢেউ চলছে এখন। ২০১২ সাল থেকে শুরু এ ঢেউয়ের। যেখানে প্রযুক্তি হলো মাধ্যম। হাতিয়ার হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। নারীর সামাজিক ও আইনি অধিকার অর্জনের পাশাপাশি ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ ও তার ওপর ঘটে চলা যৌন সহিংসতাসহ নানা ধরনের যৌন আক্রমণগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে এ সময়। ফলে দশ-বারো বছরের মধ্যেই আমাদের সমাজে সাধারণের চিন্তা জগতেও যেন খানিকটা পরিবর্তনেরই আভাস পেলাম।

এর প্রভাব নানাভাবে দেখা যাচ্ছিল আগে থেকেই। পথেঘাটে-কর্মক্ষেত্রে-ক্যাম্পাসে যৌন হয়রানির কথা এখন প্রকাশ্যেই বলছেন নারী, তথাকথিত সতীত্বের বেড়াজালটি ভেঙে ফেলে। ফেনীর মফস্বলে বেড়ে ওঠা টিনএজ নুসরাত যৌন হয়রানির প্রতিবাদে যখন মামলা করেন, অটল থাকেন তার অবস্থানে, তখন এই ইতিবাচকতা ‘অনেক কিছু’ বদলে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। একই সঙ্গে আবার পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সহিংস আক্রমণগুলোও নারীকে প্রতিবাদী অবস্থান থেকে সরিয়ে দিতে চায়। নুসরাতের বেলায় যেমনটি ঘটেছে। কিন্তু নারীবাদের চতুর্থ ঢেউটি আমাদের দেশেও আছড়ে পড়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল নুসরাতের মতো প্রতিবাদী তরুণীর হত্যার ঘটনায় ক্ষোভে-বিক্ষোভে উত্তাল। রাষ্ট্রও এখন এ বাস্তবতা এড়াতে পারে না। ফলে সম্প্রতি নুসরাতের হত্যাকারীরা পেয়েছে দৃষ্টান্তমূলক সাজার আদেশ। যদিও অনেক দূর চলার এখনও বাকি, তবু এই প্রাপ্তিগুলো আমাদের নারীদের সমানাধিকার অর্জনের পথে মাইলফলক হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে।

গুলতেকিন খানের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। পুরনো পৃথিবীতে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদকে নিকৃষ্ট বিষয় মনে করা হতো, যদিও তখন গোষ্ঠীস্বার্থে চালিত ক্ষমতাশালীরা সাধারণের অধিকার খর্ব করে নিজেরা ভোগবিলাসে ব্যস্ত থাকতেন। কয়েকশ বছর ধরে চলমান কয়েকটি শিল্প বিপ্লব বস্তুগত পরিবর্তনের পাশাপাশি ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের তাত্ত্বিক ভূমিও তৈরি করেছে। ফলে গোটা বিশ্বে পিছিয়ে পড়া প্রতিটি বর্ণগত, সম্প্রদায়গত ও জাতিগত গোষ্ঠী শ্রেণি নির্বিশেষে রাজনৈতিক, সামাজিক ও আইনি অধিকারগুলোর জন্য আন্দোলনের পথে হেঁটেছেন। কমবেশি তা অর্জিতও এখন। অন্তত তাত্ত্বিকভাবে। কিন্তু নারী কি এখনও তার মৌলিক মানবাধিকারের জায়গায় সমতার দেখা পেয়েছেন? মহামতি এঙ্গেলস তার বিখ্যাত বই ‘পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’-তে যেমন লিখেছেন, আধুনিক একক পরিবার ব্যবস্থাটি গড়ে উঠেছে নারীর প্রকাশ্য বা গোপন দাসত্বের ভিত্তিতে, এখানে পুরুষ ‘বুর্জোয়া’ আর নারী ‘সর্বহারা’— সেই সর্বহারার বিজয়গাথা লিখে ফেলা অত সহজ কর্ম নয় কিন্তু। মানব সমাজে পরিপূর্ণ সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য লৈঙ্গিক লড়াইটিই হবে শেষ লড়াই, সেটিও বলেছেন তিনি।

যাহোক, এঙ্গেলসের এই পরিবার ও সমাজ-দর্শন এবং নারীমুক্তির উপায় নিয়ে তার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে নানা মুনির নানা মতও রয়েছে। তবে পুরুষতান্ত্রিক এই পৃথিবীর বাস্তবতায় নারীবাদী আন্দোলনের কয়েকটি ঢেউ না এলে নারী সেই পুরনো অধস্তনতার জায়গায় থেকে যেতেন নিঃসন্দেহে। এসব আন্দোলনে তো খোরাক জুগিয়েছেন এঙ্গেলসের মতো মহতী দার্শনিকরাই। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আত্মমর্যাদাবোধ। নারীকে সেখানেই বঞ্চিত করা হয়েছে হাজার বছর ধরে। নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার সক্ষমতার জন্য পারিবারিক, সামাজিক, আর্থিক ও আইনগত দিক থেকে নারীর ক্ষমতায়ন ঘটানো তাই জরুরি ছিল।

সুখের বিষয়, নারীবাদী আন্দোলনের পথ ধরে জাতিসংঘ চার দশকেরও বেশি আগে নারী দশক পালন করেছে। বছরের একটি দিনকে নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে জতিসংঘেরই উদ্যোগে। যদিও ক্লারা জেটকিনের হাত ধরে ২০১০ সাল থেকে নারী দিবস পালিত হচ্ছিল- জাতিসংঘের স্বীকৃতি নারীর অধিকারকেন্দ্রিক ওই আন্দোলনগুলোকে সুগ্রন্থিত করেছে। তারপর এসেছে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ-সংক্রান্ত সনদ (সিডো) এবং নব্বই দশকের শুরুতে অ্যাকশন ফর বেইজিং প্ল্যাটফর্ম। এভাবেই নারীর অধিকারের জায়গাগুলো চিহ্নিত করে সুস্পষ্টভাবে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে।

এত কিছুর পরও মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ। সমাজ বদলায় নানা প্রভাবকের ওপর ভর করে। ইউরোপসহ অনেক অগ্রসর সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় পঞ্চাশ কী ষাটের কোঠার বয়সী নারীর বিয়ে সাধারণ ঘটনা। ‘দাদিমা’ বা ‘নানিমা’ হওয়ার পরও নারীরা নতুন করে জীবন শুরু করলে অভিনন্দন পান। আমাদের দেশে ফেনোমেনাটি নতুন।

তবে ‘গ্র্যান্ডমা’ হওয়ার পর, প্রজননক্ষম বয়স পেরিয়েও কোনো নারী সঙ্গী বেছে নিতে পারেন, এটির অনুমোদন সমাজকে দিতেই হবে একসময়। সময়ের পরিক্রমায়। নারীবাদের দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর সময়, সেই ষাটের দশকে নারীবাদী তাত্ত্বিকরা বিয়ে ব্যবস্থাকে ‘লিগ্যাল প্রস্টিটিউশন’ আখ্যা দিয়েছিলেন। যদিও পরিবার, বিয়ে, নারীর মুক্তি, এসব প্রসঙ্গে দার্শনিকদের ব্যাখ্যায় পার্থক্যও দেখা গেছে সব সময়। এসব নিয়ে হয়েছে, হচ্ছে প্রবল বিতর্ক।

এ বাস্তবতার পরও বলতে হয়, রাষ্ট্রীয় ও আইনিভাবে গত এক শতকে নারীর ক্ষমতায়নের ফলে জন্ম নিচ্ছেন আত্মমর্যাবোধসম্পন্ন ‘নতুন’ নারী। তারা বিয়ে ও পরিবার নামের প্রতিষ্ঠানগুলোতে সর্বহারার ভূমিকায় আর যে থাকবেন না সেটি সুস্পষ্ট। অন্তত এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখতে গেলে নারীর সমভূমিকার বিষয়টি মেনে নিতেই হবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে।

গুলতেকিন খানের এই আপাত ‘সাহসী’ সিদ্ধান্ত আরেকটি দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ বলা যায়। দীর্ঘ একটি সময় আমরা দেখেছি, তাকে একজন ‘ভিকটিম’ বানিয়ে বন্দনা করা হয়েছে রীতিমতো। তথাকথিত হুমায়ূন-শাওন-গুলতেকিন ‘ত্রিভুজ প্রেম’র গদ্যে শাওন খলনায়িকা ও গুলতেকিন ছিলেন নায়িকা। গুলতেকিনের সাজানো বাগানে শাওন যেন ‘সাপ’। অথচ পরিপূর্ণ বয়সের হুমায়ূন আহমেদকে পুরোপুরি ছাড় দেওয়া হয়েছে। শাওনের সঙ্গে তার সম্পর্কটি স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু এজন্য একটি পরিবার ভেঙে যাওয়ার দায় বর্তায় দুজনের ওপরই, যা সনাতন সমাজ মেনে নিতে চায়নি।

আর সে কারণেই কয়েক বছর আগে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত গুলতেকিনের সাক্ষাৎকারটি অনেকের চোখে ছিল ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’। কারণ সেখানে হুমায়ূনের সঙ্গে তার দাম্পত্য জীবনের খুঁটিনাটি বিবরণ ছিল। তাতে উঠে এসেছিল বিয়ের পর স্কুলের মেধাবী মেয়েটির ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার বেদনার কথা। বিখ্যাত স্বামীর সঙ্গে সমমর্যাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে পরিবারে নিজের অবস্থান গড়ে তুলতে না পারার সত্যকথন। গতানুগতিক দাম্পত্যে নিজের চাওয়া-পাওয়ার চিন্তা বিলিয়ে দিয়ে গুলতেকিন তাই ক্রমশ হয়ে উঠেছিলেন কেবলই ‘একজন লেখকের স্ত্রী’।

গুলতেকিন সেসব ঘটনার বিবরণ দিয়েছিলেন শুধু। তাতেই উঠে আসা সত্যগুলো মেনে নিতে পারেনি এ সমাজ। কিন্তু ওই সাক্ষাৎকার এবং পরেও প্রদত্ত তার নানা বক্তব্যে বোঝা যায়, গুলতেকিন নিজেই ‘ভিকটিম’ হওয়ার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তার দাম্পত্য সম্পর্কটি ছিল বরাবরই ‘অ্যাবিউসিভ’। যেটি আমাদের মতো সনাতনী পরিবার কাঠামোতে খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। নারীর জীবন এখানে পুরুষকেন্দ্রিক— পুরুষ সূর্য আর নারী চন্দ্রের মতো কেবল তাকে প্রদক্ষিণ করে। ফলে বেশিরভাগ নারী এমনকি ‘অ্যাবিউস’টি চিহ্নিত করতেও পারেন না। নীরবে সয়ে এক জীবন কাটিয়ে দেন।

গুলতেকিন অ্যাবিউসটি বুঝতে পেরেছিলেন সম্ভবত। তবে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সয়ে- কিছু অতিকাঙিক্ষত স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার বেদনা নিয়ে। তবু তিনি জীবনকে ভালোবেসেছেন। বোঝা গেল, পরিবার এবং সন্তান-সন্ততিকে অবহেলা না করেও একজন নারী জীবনের এই সময়ে এসে লেখালেখি, সাহিত্য-আ্ড্ডায় সময় দিতে পারেন। পারেন পথচলার জন্য একজন সঙ্গী বেছে নিতেও।

এভাবেই সমাজ মেনে নেবে, নারী শুধু একটি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে থাকা চন্দ্র নন- তিনি নিজেও একটি সূর্য- নিজের ভুবনে।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/পিআর